অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত
১৮৬৬ সালের জানুয়ারির এক শীতল অপরাহ্ণে, অফিসঘরে বসে স্কারলেট আন্ট পিটিকে একটা চিঠি লিখছিল। এই নিয়ে অন্তত দশবার ও বলে সেরেছে ওর, মেলানির বা অ্যাশলের কারোর পক্ষেই এখন অ্যাটলান্টায় গিয়ে ওঁর সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। লিখতে লিখতে একটু অধৈর্যই হয়ে পড়ছিল, কারণ আট পিটি যে প্রথম লাইনটা ছাড়া চিঠিটার আর কিছুই পড়বেন না, সেটা ওর ভাল মতই জানা। তারপরেই জবাব লিখতে বসবেন, “কিন্তু আমি যে একা একা থাকতে ভয় পাচ্ছি।”ঠাণ্ডায় হাত জমে গেছিল। তাই হাতে হাত ঘষার আর গোড়ালিতে জড়ানো পুরোনো কম্বলের টুকরোর ভেতরে পা দুটো আরও ডুবিয়ে দেবার জন্য চিঠি লেখায় সামান্য বিরতি দিল। স্লিপারের শুকতলা একদম ক্ষয়ে গেছে। একটুকরো কার্পেট লাগিয়ে একটু পোক্ত করা হয়েছে। কার্পেটটা মেঝের ওপর পা পড়া থেকে বাঁচালেও পা দুটো উষ্ণ রাখার ব্যাপারে অক্ষম। আজ সকালে উইল জোনসবোরোতে গেছে ঘোড়া নিয়ে, ওর জন্য একজোড়া জুতো কিনে আনতে। স্কারলেট ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবে ঘোড়ার পায়ে নাল পরানোর রেওয়াজ থাকলেও, মানুষের পা পোষা কুকুরের পায়ের মতই অনাবৃত থাকে।
চিঠি লেখা শুরু করার জন্য কলমটা তুলে নিয়েই আবার নামিয়ে রাখল। মনে হল উইল যেন ফিরে এসে পেছনের দরজার দিকে গেল। উইলের কাঠের পায়ের ঠক ঠক আওয়াজটা অফিসঘরের বাইরে, হল পর্যন্ত এসে থেমে গেল। কিছুক্ষণ ওর আসার অপেক্ষা করল, কিন্তু তারপরেও যখন এল না, ডাকল। উইল ভেতরে এল। ঠাণ্ডায় কানদুটো লাল হয়ে গেছে। রঙচটা গোলাপি চুল উস্কোখুস্কো। মুখে কৌতুকের হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকাল।
“মিস স্কারলেট,” জিজ্ঞেস করল ও, “নগদ ঠিক কত টাকা আছে আপনার কাছে?”
একটু চটে গিয়েই স্কারলেট পালটা জানতে চাইল, “কেন উইল, তুমি কী টাকার জন্য আমাকে বিয়ে করবার তাল করছ?”
“না ম্যা’ম। শুধু জানতে চাইছিলাম।”
জিজ্ঞাসু চোখে স্কারলেট ওর দিকে চাইল। উইলকে গম্ভীর বলে মনে হচ্ছিল না। অবশ্য গম্ভীর ওকে কোনোকালেই লাগে না। মন বলল কিছু একটা গোলমাল আছে।
“আমার কাছে স্বর্ণমুদ্রায় দশ ডলার আছে,” স্কারলেট বলল। “সেই ইয়াঙ্কিটার কাছে পাওয়া শেষ সম্বল।”
“ঠিক আছে ম্যা’ম। কিন্তু ওতে কিছু হবে না।”
“কী কিছু হবে না?”
“খাজনার টাকা মেটানো,” খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফায়ারপ্লেসের দিকে এগলো। তারপর নীচু হয়ে দু’হাতে গরম সেঁক দিতে লাগল।
“খাজনা?” স্কারলেট কথাটা আওড়াল। “সেকি? খাজনা তো আমরা মিটিয়েই দিয়েছি!”
“তা দিয়েছি, ম্যা’ম। কিন্তু ওরা বলছে ওটা নাকি যথেষ্ট নয়। আজ জোনসবোরোতে ওদের কথাবার্তা কানে এল।”
“কিছুই যে মাথায় ঢুকছে না উইল! কী বলতে চাইছ?”
“মিস স্কারলেট, এটা নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আমার খারাপই লাগছে। এমনিতেই আপনার মাথার ওপর হাজারটা ঝামেলা। কিন্তু না বললেও যে চলবে না! ওরা বলছে, আপনাদের নাকি আরও খাজনা দেবার কথা! টারার খাজনা ধার্য করার কাজটাই এখন করছে ওরা – একেবারে আকাশছোঁয়া খাজনা ধার্য করেছে – কাউন্টির অন্যান্য তালুকের চেয়ে অনেক চড়া হারে। দিব্যি কেটে বলছি!”
“কিন্তু একবার মিটিয়ে দেবার পর ওরা তো নতুন করে বেশি খাজনা মেটানোর জন্য আমাদের বাধ্য করতে পারে না!”
“মিস স্কারলেট, ইদানিং আপনি জোনসবোরোতে তো খুব একটা যান না – ভালই করেন – আজকাল ওখানে মহিলাদের না যাওয়াই ভাল। অবশ্য গেলে জানতে পারতেন, স্ক্যালাওয়াগ, রিপাবলিকান আর কার্পেটব্যাগার্সদের দাদাগিরিতে সবাই নাজেহাল। মাথা খারাপ হয়ে যাবে আপনার। তার ওপর রয়েছে নিগারগুলোর মস্তানি – সাদা চামড়াদের ফুটপাথ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে আর – ”
“তা এর সঙ্গে আমাদের খাজনার কী সম্পর্ক?
“সেই কথাতেই আসছি, মিস স্কারলেট। কোনো বদ মতলবে, শয়তানগুলো চড়া হারে টারার খাজনা বেঁধে দিয়েছে – যেন মনে হবে এখানে কম করে হাজার গাঁঠ তুলো ওঠে। তা কথাটা কানে আসতেই আমি মদের ঠেকগুলোর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম আর গুজবে কান পাতলাম। জানতে পারলাম একজন কেউ টারাকে সস্তায় কেনবার ধান্দা করছে – নীলামিতে – যদি আপনি বাড়তি খাজনা না মেটাতে পারেন। আর সবার ভাল করেই ওয়াকিবহাল, এই খাজনা মেটানো আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এই জায়গাটার ওপর কার নজর সেটা এখনো ধরতে পারিনি। তবে যতদূর বুঝছি, ওই ইতরস্ব ইতর হিল্টন লোকটা – মিস ক্যাথলীনকে বিয়ে করেছে যে – ও জানে – কারণ আমি যখন ওকে বাজিয়ে দেখতে গেলাম, এমন নোংরাভাবে হাসল – তাই মনে হচ্ছে।”
সোফায় বসে পড়ে উইল গোঁজ লাগানো পায়ে মালিশ করতে লাগল। ঠাণ্ডায় এই পাটা খুব কষ্ট দেয়, এক তো কাঠের গোঁজটায় কোনও প্যাডিং দেওয়া নেই, আর দুই মোটেই আরামদায়ক নয়। উদ্ভ্রান্ত চোখে স্কারলেট ওর দিকে তাকাল। কথাগুলো এমন হালকা গলায় বলল, যেন ও টারার মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিল। নিলামে চড়বে? তাহলে ওরা যাবে কোথায়? টারা অন্য লোকের হয়ে যাবে? না, না, একথা মনেও আনা যায় না!
টারার ফলন বাড়ানোর চক্করে এমন মজে ছিল যে আশপাশের দুনিয়ার দিকে নজরই দিতে পারেনি। জোনসবোরো আর ফ্যেয়াটভিলের কাজ কারবার আজকাল উইল আর অ্যাশলে সামলাচ্ছে। তাই প্ল্যান্টেশন ছেড়ে ওর বেরনোই হয় না। যুদ্ধ শুরু হবার আগে জেরাল্ডের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা ওর এক কান দিয়ে ঢুকত, আর অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। একইভাবে খাবার টেবিলে বসে উইল আর অ্যাশলের পুনর্গঠন আরম্ভ হওয়া নিয়ে কোনো আলোচনাই ওর কানে ঢোকেনি।
অবশ্য স্ক্যালাওয়াগদের কথা ওর জানা আছে – যে সমস্ত দক্ষিণী ফায়দা তোলার লোভে রাতারাতি রিপাবলিকানদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আবার কার্পেটব্যাগারদের খবরও ওর জানা। আত্মসমর্পণের পর, ওই ইয়াঙ্কি শকুনের দল নিজেদের যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি শুধুমাত্র কার্পেটের একটা ব্যাগে ভরে দক্ষিণে এসে ভিড় জমিয়েছে। ফ্রীডম্যান’স ব্যুরো নিয়েও ওর বেশ কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাছাড়া ওর কানে এটাও এসেছে যে কিছু স্বাধীন হওয়া নিগ্রো আজকাল বেশ দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। এই শেষের ব্যাপারটা ওর বিশ্বাস হয়নি, কারণ জীবনে কোনও দুর্বিনীত নিগ্রো ওর চোখে পড়েছে বলে মনে করতে পারেনি।
তবে অনেক কিছুই ছিল যা উইল আর অ্যাশলে ইচ্ছে করেই ওকে জানতে দেয়নি। যুদ্ধের ক্ষত সামলে উঠতে না উঠতেই পুনর্গঠনের নামে চরম নিপীড়ন শুরু হয়েছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে দুজনেই আলোচনা করার সময় এর ভয়াবহ দিকটা নিয়ে বাড়িতে উচ্চবাচ্য না করতে মনস্থ করেছে। স্কারলেট যখন ওদের আলোচনায় কান পাতত, ওদের বেশিরভাগ কথাই ওর এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেত।
অ্যাশলেকে বলতে শুনেছে যে দক্ষিণকে নাকি বিজিত প্রদেশ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে, আর প্রতিহিংসাপরায়ণতাই হচ্ছে বিজেতাদের মূল নীতি। তবে এই ধরণের কথাবার্তা নিয়ে স্কারলেটের একদমই মাথাব্যথা ছিল না। রাজনীতির কূটকচাল পুরুষমানুষদের এক্তিয়ারেই পড়ে। উইলকে প্রায়ই বলতে শোনে যে উত্তর যেন চায়ই না যে দক্ষিণ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। যত সব মনগড়া ধারণা নিয়ে মিছিমিছি দুর্ভাবনা করা পুরুষমানুষদের স্বভাব, স্কারলেট বিরক্ত মনে ভাবে। নিজেকে দিয়েই ও বুঝে গেছে যে ইয়াঙ্কিরা আগে যখন ওর ওপরে চাবুক চালায়নি, এখনও চালাবে না। আশু প্রয়োজন হল প্রাণপাত করে পরিশ্রম করা আর ইয়াঙ্কি সরকারকে নিয়ে অযথা মাথা ঘামানো বন্ধ রাখা। যুদ্ধ তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে।
দু’একটা কথা স্কারলেটের মাথায় ঢোকেনি। খেলার নিয়মকানুনগুলো সব পালটে গেছে আর শুধু সৎপথে থেকে পরিশ্রম করে গেলেই যে ন্যায্য পুরস্কার পাওয়া যাবে, একথাও আর জোর দিয়ে বলা যায় না। জর্জিয়ায় এখন অলিখিতভাবে হলেও সামরিক শাসন জারি হয়ে গেছে। ইয়াঙ্কি সেনাবাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলগুলো ঘিরে রেখেছে আর ফ্রীডম্যান’স ব্যুরো নিজেদের সুবিধে মত আইন বানিয়ে প্রতিটা ব্যাপারে নিজেদের শাসন কায়েম করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের তৈরি করা এই ব্যুরোর কাজ হল অলস হয়ে বসে থাকা এবং অধীর হয়ে পড়া প্রাক্তন ক্রীতদাসদের খেয়াল রাখা আর এদের প্ল্যান্টেশন থেকে তুলে এনে দল বেঁধে গ্রামে আর শহরে পাঠিয়ে দেওয়া। এরা নিজেদের খেয়ালখুশি মত চরে বেড়াত। ব্যুরো এদের ভরণপোষণ করত আর প্রাক্তন প্রভুদের বিরুদ্ধে এদের মন বিষিয়ে তুলত। স্থানীয় ব্যুরোর দায়িত্বে ছিল জোনাস উইল্কারসন – জেরাল্ডের সাবেক ওভারসিয়ার। আর হিলটন ছিল ওর সহকারী – ক্যাথলিন ক্যালভার্টের স্বামী। এরা দুজনে মিলে গুজব রটিয়ে দিল যে দক্ষিণীরা আর ডেমক্র্যাটরা একটা ভাল সুযোগের অপেক্ষায় আছে যাতে নিগ্রোদের আবার ক্রীতদাসত্বে ফিরিয়ে আনা যায়, আর এই বিপদ থেকে নিগ্রোদের বাঁচবার একমাত্র উপায় হল ব্যুরো আর রিপাবলিকান পার্টির ছত্রছায়ায় থাকা।
উইল্কারসন আর হিলটন নিগ্রোদের আরও বোঝাল যে ওরা সাদাদের থেকে কোনো অংশেই কম নয়, আর খুব শিগগিরই সাদা আর নিগ্রোদের মধ্যে বিয়ে করবার অনুমতিও দিয়ে দেওয়া হবে। ওদের প্রাক্তন প্রভুদের স্থাবর সম্পত্তিও ওদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। প্রত্যেক নিগ্রোকে চল্লিশ একর জমি আর একটা করে খচ্চর দেওয়া হবে। সাদারা ওদের ওপর কী রকম নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে তার নানা রকম কাহিনী শুনিয়ে ওরা নিগ্রোদের উত্তেজিত করে তুলল। ফলে ক্রীতদাস আর তাদের মালিকদের মধ্যে বহুচর্চিত সৌহার্দ্যের সম্পর্কের পরিবর্তে ঘৃণা আর অবিশ্বাসের জন্ম নিতে শুরু করল।
ব্যুরোর কাজে প্রত্যক্ষ মদত জোগাচ্ছিল সৈনিকরা। বিজিতদের আচার আচরণ কেমন হতে হবে সেটা নিয়ে সামরিক বাহিনী একের পর এক পরষ্পরবিরোধী ফতোয়া জারি করে চলল। জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেল। এমনকি ব্যুরোর কোনো কর্মচারীর মুখের ওপর কিছু বললেই গ্রেপ্তার হতে হত। স্কুল, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, জিনিসপত্র কেনাবেচা, এমনকি স্যুটের বোতাম কী ধরণের হতে হবে – সব কিছুর ওপরই সামরিক বাহিনী ফতোয়া জারি করে দিল। স্কারলেট কী ধরণের কারবার করবে, কী দামে জিনিস বিক্রী করবে বা অদলবদল করবে – এই সমস্ত ব্যাপারে উইল্কারসন আর হিল্টনের নাক গলানোর আর দাম বেঁধে দেবার অধিকার ছিল।
স্কারলেটের ভাগ্য ভাল যে এই দুজনের সাথে ওর মোকাবেলা কমই হত। বেচাকেনার ব্যাপারটা ওর হাতে ছেড়ে দিতে উইল স্কারলেটকে রাজি করিয়েছিল। স্কারলেট বরং প্ল্যান্টেশনের খেয়াল রাখুক। মাথা ঠাণ্ডা রেখে উইল এই ধরণের নানা সমস্যার একটা না একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান ঠিক খুঁজে বের করত, তবে স্কারলেটকে এসব নিয়ে কিছু বলত না। দরকার পড়লে – উইল কার্পেটব্যাগার আর ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে। কিন্তু এখন যে বিশাল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, সেটা ওর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। বাড়তি খাজনার ব্যাপারটা আর না দিতে পারলে টারা যে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে – এই খবরটা স্কারলেটের জানা দরকার, এবং অনতিবিলম্বে।
স্কারলেট জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকাল।
“নিকুচি করেছে ইয়াঙ্কিরা!” চেঁচিয়ে উঠল। “সমস্ত কিছু লুটে নিয়ে, আমাদের ভিখিরি বানিয়ে, তবুও ওদের শান্তি হচ্ছে না! এখন আবার গুণ্ডা লেলিয়ে দিচ্ছে!”
লড়াই তো কবে থেমে গেছে, শান্তি চুক্তিও হয়েছে, তাও কিনা ইয়াঙ্কিরা ওকে লুঠ করতে পারে, এখনও ওর মুখ থেকে অন্ন কেড়ে নিতে পারে, এমনকি ওকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদও করে দিতে পারে! আর কী বোকার মতই না এই সব ক্লান্তিকর মাসগুলোতে ভেবেছে যে বসন্ত আসা পর্যন্ত টেনে দিতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! উইলের আনা এই মর্মান্তিক খবরটা ওর বছরভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর সব আশার ওপর জল ঢেলে দিল।
“উইল, আমি যে ভেবেছিলাম লড়াই শেষ মানে আমাদের ঝামেলারও শেষ!”
“না, ম্যাম,” উইল ওর লম্বাটে চোয়াল থেকে সামনের দিকে বেরিয়ে আসা থুতনিওয়ালা দেহাতি চেহারাটা তুলে বেশ কিছুক্ষণ স্কারলেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। “এই তো সবে ঝামেলার শুরু।”
“বাড়তি খাজনা কত দিতে হবে?”
“তিনশ ডলার।”
মুহূর্তের জন্য স্কারলেট বোবা হয়ে গেল। তিনশ ডলার! তিরিশ লক্ষ ডলার হলেও কিছু বলার ছিল না!
“কেন,” স্কারলেট হাঁ হয়ে গেল। “কেন – কেন – তাহলে তো যে করেই হোক তিনশ ডলার আমাদের জোগাড় করতে হবে!”
“হ্যাঁ, ম্যাম – আর আকাশ থেকে রামধনুটা আর একটা কী দুটো চাঁদও পেড়ে আনতে হবে।”
“কিন্তু, উইল! টারাকে ওরা বিক্রি করে দিতে পারে না। কেন না – ”
উইলের চোখ থেকে এক রাশ ঘৃণা আর তিক্ততা ঝরে পড়ছে। ওই শান্ত আর ফ্যাকাসে চোখে এরকম দৃষ্টি সম্ভব সেটা স্কারলেটের কল্পনার বাইরে ছিল।
“পারে না বুঝি? পারে আর সেটা ওরা করবেও, আর সেটা করে ওরা মজাও লুটবে! মিস স্কারলেট, দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে – কিছু মনে করবেন না। ওই কার্পেটব্যাগার আর স্ক্যালাওয়াগগুলো ভোট দিতে পারে, আর আমাদের বেশিরভাগ ডেমক্র্যাটরা পারে না। পঁয়ষট্টি সালে যে সব ডেমক্র্যাটরা দু’হাজার ডলারের বেশি খাজনা দিয়েছেন, তারা কেউই ভোট দিতে পারবেন না। আপনার বাপি আর মিস্টার টার্লটন, আর ম্যাকরে আর ফোনটেনরা – এঁরা সবাই এই দলে পড়ছেন। তারপর যাঁরা এই যুদ্ধে কর্নেল হিসেবে লড়াই করেছেন, তাঁরাও কেউ ভোট দিতে পারবেন না। আর মিস স্কারলেট, আমি বাজি লাগিয়ে বলতে পারি, কনফেডারেসির অন্যান্য রাজ্যের তুলনায়, আমাদের রাজ্যে কর্নেলের সংখ্যাটা অনেক বেশি। এরপর যাঁরা কনফেডারেট সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন – অর্থাৎ নোটারি থেকে শুরু করে জজসাহেব পর্যন্ত সকলেই – এঁরাও ভোট দিতে পারবেন না। এই দলেও মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বাস্তব সত্যিটা হল, ইয়াঙ্কিরা ক্ষমাভিক্ষার জন্য শপথের বয়ানটা এমনভাবে তৈরি করেছে যে যুদ্ধের আগে হোমরাচোমরা মানুষ যাঁরাই ছিলেন – তাঁদের কেউই ভোট দিতে পারবেন না। না চালাকচতুর মানুষরা, না বিজ্ঞ মানুষরা, আর না ধনী মানুষরা।
“ধরুন, আমি যদি ওই জঘন্য শপথটা নিয়ে নিই, তাহলে আমি ভোটের অধিকার পেয়ে যাব। পঁয়ষট্টি সালে আমার কোনো টাকাপয়সাও ছিল না, আর যুদ্ধের সময় আমি কর্নেলও ছিলাম না, বা কেউকেটাও ছিলাম না। তবে আমি ওই শপথটা নেবার জন্য মোটেই লালায়িত নই। মরে গেলেও রাজি নই! ইয়াঙ্কিরা যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করত, আমি ওদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েই নিতাম, কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। ইউনিয়নের রাজত্ব হয়ত আমি মানতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু তাঁবেদারি করাতে পারবে না। ওদের ওই শপথটা আমাকে কিছুতেই নেওয়াতে পারবে না, তার জন্য আজীবন যদি ভোট নাও দিতে পারি – তাই সই। শয়তানের ধাড়ি হিল্টন, উইল্কারসনের মত পাজী লোকজন স্ল্যাটারিদের মত হাড়হাভাতের দল আর ম্যাকিন্টশের মত লোকজন যারা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না - তারা ভোট দিতে পারবে! ওরাই এখন সর্দারি করছে! বাড়তি খাজনার জন্য, ওরা যদি চায়, আপনাকে জ্বালাতন করতেই পারে। যেমন একটা নিগার যদি সাদা চামড়ার কাউকে খুনও করে তবুও ওকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে না, বা – ” অস্বস্তিভরে ও চুপ করে গেল। লাভজয়ের কাছে লোকালয় থেকে দূরে একটা খামারে সাদা চামড়ার নিঃসঙ্গ একজন মহিলার সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেটা দুজনেরই মনে পড়ে গেল… “ওই নিগারগুলো আমাদের সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, আর ফ্রীডম্যান’স ব্যুরো আর জওয়ানরা ওদের হাতে বন্দুক তুলে দেবে, আর আমরা না পারব ভোট দিতে, না পারব কিছু করতে!”
“ভোট!”, স্কারলেট আর্তনাদ করে উঠল। “ভোট! এসবের সঙ্গে ভোট দিতে পারা না পারার কী সম্পর্ক? উইল? আমরা তো খাজনা নিয়ে কথা বলছিলাম … উইল, সবাই জানে টারা কত ভাল একটা প্ল্যান্টেশন। দরকার পড়লে এটাকে বন্ধক রেখে খাজনা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তোলা যেতেই পারে।”
“মিস স্কারলেট, আপনি তো বোকা নন, কিন্তু মাঝে মাঝে আপনি বোকার মত কথা বলে ফেলেন। এই জমির ওপর আপনাকে ধার দেবার মত টাকা কার কাছে আছে, বলুন তো? কার্পেটব্যাগাররা ছাড়া – যারা আপনার কাছ থেকে টারাকে কেড়ে নিতে চাইছে? জমিজমা সকলেরই আছে। আমদানি কারোরই তেমন নেই। জমি তো আপনি দিতে পারবেন না।”
“আমার কাছে একজোড়া হীরের কানের দুল আছে। ইয়াঙ্কিটার কাছ থেকে যেটা পেয়েছিলাম। ওটা বিক্রি করে দিতে পারি।”
“মিস স্কারলেট, আশেপাশে কে আছে যে টাকা দিয়ে আপনার ওই দুলজোড়া কিনতে পারবে? পাতে দেবার জন্য সামান্য মাংস কেনার টাকা মানুষের হাতে নেই, তো চটকদার গয়না! আপনার কাছে স্বর্ণমূদ্রায় দশ ডলারও যদি থেকে থাকে, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, অনেকের থেকে বেশিই আছে।”
আবার দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ। স্কারলেটের মনে হল ও যেন পাথরের দেওয়ালে সজোরে মাথা কুটছে। গত একটা বছর ধরে এরকম কত পাথরের দেওয়ালেই যে ওকে মাথা কুটতে হয়েছে।
“আমাদের কী করা উচিত, মিস স্কারলেট?”
“জানি না,” নিষ্পৃহ গলায় স্কারলেট জবাব দিল। কিছুতেই যেন এসে যায় না ওর। এটা যেন ভুঁই ফুড়ে ওঠা আরও একটা পাথরের দেওয়াল। নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হতে লাগল। গায়েগতরে অসহ্য বেদনা। কেনই বা এত পরিশ্রম, কেনই বা এত লড়াই আর তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলা? লড়াইয়ের শেষ কী অপেক্ষা করছে? না পরাজয়ের গ্লানি ওকে বিদ্রূপ করছে!
“জানি না কী করব,” আবার বলল। “তবে বাপিকে জানতে দিও না। শুধু শুধু উতলা হবেন।”
“জানতে দেব না।”
“আর কাউকে জানিয়েছ?”
“না, সোজা আপনার কাছেই এলাম।”
ঠিকই, স্কারলেট ভাবল, খারাপ খবর নিয়ে সকলে সোজা ওর কাছেই আসে। শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
“মিস্টার উইল্কস কোথায়? উনি হয়ত কোনো পরামর্শ দিতে পারবেন।”
উইল ওর শান্ত দৃষ্টি স্কারলেটের মুখের ওপর রাখল। স্কারলেটের মনে হল, যেদিন অ্যাশলে ফিরে এল, সেদিন থেকেই উইল সব কিছু জেনে গেছে।
“ফলের বাগানে, বাখারি চিরছেন। ঘোড়া বাঁধার সময় ওঁর কুঠার চালানোর আওয়াজ পেয়েছি। তবে আমাদের কাছে যেটুকু আছে, ওঁর টাকাকড়ির অবস্থা, তার চাইতে ভাল কিছু নয়।”
“ইচ্ছে হলে টাকাকড়ি নিয়ে কথা আমি ওর সঙ্গে বলতেই পারি, পারি না কি?” স্কারলেট ধমক দিয়ে উঠল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গোড়ালি থেকে কম্বলের টুকরোটা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল।
ধমকটা উইল গায়েই মাখল না। আগুনের আঁচের ওপর যেভাবে ঘসছিল, সেভাবে ঘসতে ঘসতেই বলল, “শালটা গায়ে জড়িয়ে নিলেই ভাল করবেন। বাইরে ভাল ঠাণ্ডা আছে।”
স্কারলেট শাল না জড়িয়েই রওনা দিল, কারণ ও ওপরতলায় রয়েছে, আর অ্যাশলের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথাটা ওকে বলাটা খুব জরুরি, মিছিমিছি ফেলে রাখা যায় না।
ওকে যদি একলা পাওয়া যায়, তাহলে কপালের জোরই বলতে হবে! ফিরে আসার পর থেকে ওর সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগই হয়নি। পরিবারের লোকেরা অষ্টপ্রহর ওকে ঘিরে রেখেছে! ওর পাশ থেকে মেলানিকে নড়ানো যায়নি। মাঝে মাঝেই ওর জামার হাতা ছুঁয়ে যাচাই করে নিচ্ছে যে ও সত্যি সত্যিই ওখানে বিদ্যমান! ওর এই অধিকারবোধের প্রকাশ দেখে স্কারলেট হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছে। অ্যাশলে আর বেঁচেই নেই এরকম একটা নিশ্চয়তাবোধ থেকে স্কারলেটের মধ্যে বিদ্বেষের ভাবটা সুপ্ত হয়ে ছিল। এখন ওকে একলা অ্যাশলের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। ওর সঙ্গে একান্তে কথা বলা নিয়ে কেউ ওকে বাধা দিতে পারবে না।
***
ফলের বাগানের ভেতর দিয়ে, ইতস্তত ঝুলে থাকা ডাল, লতাপাতা সরিয়ে স্কারলেট এগোতে লাগল। স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলায় পায়ের তলাটা ভিজে উঠল। কুঠার চালানোর ঠক ঠক কানে এল। জলাভূমি থেকে নিয়ে আসা কাঠের গুঁড়ি চিরে বাখারি তৈরি করছে অ্যাশলে। উল্লাসে ফেটে পড়ে ইয়াঙ্কিরা বেড়াগুলো এমন জঘন্যভাবে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে যে ওগুলো বদলে ফেলার কাজটা যেমন কঠিন, তেমনই সময়সাপেক্ষ। প্রতিটা কাজই কঠিন আর সময়সাপেক্ষ, স্কারলেট পরিশ্রান্ত মনে ভাবল। আর কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পাগল পাগল লাগে, সব ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মেলানির না হয়ে অ্যাশলে যদি ওর স্বামী হত, ওর কাছে গিয়ে, ওর কাঁধে মাথা রেখে যদি কাঁদতে পারত, তবে কী ভালই না হত। এই গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে অ্যাশলে যথাসাধ্য করত।
হিমেল হাওয়ায় দুলতে থাকা ডালিমের ঝাড়টা হাত দিয়ে দুপাশে সরিয়ে দিল। দেখতে পেল অ্যাশলে ওর কুঠারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতের পেছন দিক দিয়ে কপালটা মুছছে। ছেঁড়াখোঁড়া ঘি রঙের একটা ট্রাউজ়ার আর জেরাল্ডের জীর্ণ একটা শার্ট পরে আছে। কোনো এক সময় এই শার্টটা আদালতে হাজিরা দেবার দিনে বা বারবেকিউ পার্টি ছাড়া জেরাল্ড পরতেনই না। শার্টটা লাট খেয়ে আছে, আর বর্তমান মালিকের জন্য বেশ খাটো। কোটটা গাছের ডালে ঝোলানো, কারণ কাজটা ঘাম ঝরানো। স্কারলেট যখন ওর কাছে এল, তখন অ্যাশলে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।
অ্যাশলেকে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্কারলেটের বুকে ভালবাসার জোয়ার ছিটকে পড়ল। ওর দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে বেদনাও বোধ করল। কার্তিকের মত অনিন্দ্যদর্শন ওর নিজের অ্যাশলেকে এই রকম ভিখিরির বেশে দেখাটা রীতিমত কষ্টের। কঠোর পরিশ্রমের জন্য ওই হাত দুটো তৈরি হয়নি। মহার্ঘ বনাতের তৈরি কেতাদুরস্ত পোশাক ছাড়া আর কোনও পোশাক পরবার জন্য ওর এই শরীর নির্মিত হয়নি। ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বাস করে অভিজাত মানুষদের সঙ্গে বসে ও আলাপ আলোচনা করবে, পিয়ানো বাজাবে, কাব্য রচনা করবে, যা শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ বোধ করবে কিন্তু কোনোরকম অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
নিজের সন্তানকেও যদি বস্তা কেটে বানানো পোশাকে দেখত, স্কারলেট এতটা কষ্ট পেত না, মলিন ডোরাকাটা পোশাক পরা মেয়েদের দেখলেও না। অন্যান্য খেতমজুরদের থেকে উইল যে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, সেটা মেনে নিতেও ওর আপত্তি নেই, কিন্তু অ্যাশলের পরিশ্রমটা সইতে কষ্ট হয়। এই রকম মুটেমজুরদের মত পরিশ্রম করার জন্য অ্যাশলের জন্ম হয়নি। অ্যাশলে ওর বড়ই আপনার। অ্যাশলেকে কাঠ চিরতে দেখে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বরং কাজটা ওর নিজেরই করে নেওয়া ভাল।
“ওরা বলে থাকে, অ্যাবে লিঙ্কন নাকি কাঠ চেরাই দিয়েই জীবন শুরু করেছিলেন,” স্কারলেটকে আসতে দেখে অ্যাশলে বলে উঠল। “একবার ভাব তো, কোন জায়গা পর্যন্ত আমি পৌঁছে যেতে পারি!”
স্কারলেট ভুরু কোঁচ করল। দুঃখকষ্ট সর্বদা হালকা কথা বলে লঘু করে দেবার চেষ্টা ওর। অথচ স্কারলেটের কাছে এগুলো মোটেই হেসে উড়িয়ে দেবার মত ব্যাপার নয়। কখনো কখনো ওর মন্তব্য শুনে স্কারলেটের রাগ ধরে যায়।
উইলের আনা খবরটা স্কারলেট কোনোরকম ভণিতা না করে, বাহুল্য বর্জন করে অ্যাশলেকে বলল। কথাটা বলতে বলতে ওর উদ্বেগ বেশ কমে গেল। অ্যাশলে নিশ্চয়ই ভাল কোনো পরামর্শ দিতে পারবে। অ্যাশলে কোনো কথাই বলল না। কিন্তু স্কারলেটকে কাঁপতে দেখে, নিজের কোটটা নিয়ে স্কারলেটের কাঁধের ওপর ছড়িয়ে দিল।
“তাহলে বল,” কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে স্কারলেট জিগ্যেস করল, “তোমার কি মনে হয় না টাকাটা কোনোভাবে আমাদের জোগাড় করে ফেলা দরকার?”
“তা ঠিক,” অ্যাশলে বলল, “কিন্তু কোথা থেকে?”
“সেটাই তো তোমার কাছে জানতে চাইছি,” স্কারলেট বিরক্ত হয়ে জবাব দিল। উদ্বেগ কমার যে লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, সেটা মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। ধরা যাক ও কোনো সাহায্যই করতে পারবে না, কিন্তু সান্ত্বনা দিয়েও তো কিছু বলল না, অন্তত “খুব খারাপ লাগছে শুনে” ধরণের কিছু।
অ্যাশলে হেসে ফেলল।
“এই যে কয়েক মাস হল আমি বাড়ি ফিরে এসেছি, একমাত্র একজন লোকের নামই শুনছি – রেট বাটলার – যার নাকি অনেক টাকাকড়ি আছে,” ও বলল।
এই গত সপ্তাহেই আন্ট পিটি মেলানিকে লিখেছেন যে রেট নাকি অ্যাটলান্টা ফিরে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন একটা জুড়িগাড়ি আর দুটো তাগড়া ঘোড়া আর পকেট ভর্তি করে ডলার। অবশ্য এটাও জানিয়েছেন যে ওই ডলারগুলো নাকি সদুপায়ে অর্জিত নয়। আন্ট পিটি মনে করেন, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটলান্টার অন্যেরাও মনে করে, যে রেট নাকি কনফেডারেট সরকারের তহবিল থেকে কোটি কোটি ডলার তছরুপ করেছেন।
“ওঁর কথা বাদ দাও,” স্কারলেট রেগে উঠল। “ওঁর মত জঘন্য লোক আর একটাও হয় না। আমাদের কী হবে সেকথা বল।”
কুঠারটা অ্যাশলে হাত থেকে নামিয়ে রেখে চোখ সরিয়ে নিল। দূরবর্তী কোনো দেশে যেন ওর দৃষ্টি পাড়ি লাগাল, কিন্তু সেই দেশটা কোথায় সেটা স্কারলেট বুঝতে পারল না।
“আমি ভাবি,” অ্যাশলে বলল। “টারায় আমাদের কী হবে কেবল সেটা নিয়েই নয়, দক্ষিণের প্রত্যেকটা অধিবাসীর কী হবে, সেটা নিয়েও ভাবি।”
স্কারলেটের ইচ্ছে হল, সেই মুহূর্তেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “নিকুচি করেছে দক্ষিণের অন্যান্য অধিবাসীদের কথা! আমাদের কী হবে!” কিন্তু ক্লান্তির অনুভূতিটা আগের থেকেও অনেক তীব্র হয়ে ফিরে এসেছে, তাই চুপ করেই রইল। অ্যাশলেকে দিয়ে কিছুই হবে না!
“সভ্যতা ভেঙে পড়লে যা হয়ে থাকে, শেষমেশ সেটাই হবে। যারা সাহসী, যাদের বুদ্ধি আছে তারাই কেবল টিকে থাকে বাকিরা সাফ হয়ে যায়। ব্যাপারটা হয়ত খুব সুখকর হবে না, তবে একটা গটেরড্যামেরুঙ১-এর সাক্ষী হওয়ার আগ্রহ তো থেকেই যা।”
“একটা কী?”
“ঈশ্বরের জীবনসন্ধ্যা। দুর্ভাগ্যের কথা হল, আমরা এই দক্ষিণের লোকেরা, সত্যি সত্যিই নিজেদের ঈশ্বর মনে করতাম!”
“ঈশ্বরের দোহাই, অ্যাশলে উইল্কস! ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার ওই পাগলের প্রলাপগুলো আমাকে শুনিও না তো! এদিকে আমরাই যে – সাফ হয়ে যেতে চললাম!”
স্কারলেটের নিরুপায় হতাশার ভাবটা হয়ত অ্যাশলের মাথায় নাড়া দিল। বিক্ষিপ্ত ভাবনাচিন্তায় লাগাম টেনে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। পরম স্নেহভরে স্কারলেটের দুটো হাত তুলে কড়া পড়া তালুর দিকে তাকাল।
“আমার দেখা সব চাইতে সুন্দর দুটো হাত,” বলে দুটো তালুর ওপরেই হালকাভাবে চুম্বন করল। “কী অসীম শক্তির আধার এই দুটো হাত, এদের প্রত্যেকটা কড়া হচ্ছে সেই শক্তির স্বীকৃতির প্রতীক। স্কারলেট, প্রতিটা কড়া তোমার সাহস, তোমার নিঃস্বার্থ সংগ্রামের পুরস্কার। আমাদের সবার জন্য, তোমার বাপির জন্য, তোমার বোনদের জন্য, মেলানির জন্য, বাচ্চার জন্য, নিগ্রোদের জন্য আর আমার জন্য এই কড়াগুলো পড়েছে। আমি জানি প্রিয়, তুমি মনে মনে কী ভাবছ। তুমি ভাবছ, ‘অপদার্থ, বোকা একটা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে মরে যাওয়া ঈশ্বর নিয়ে কী সব আবোলতাবোল বকে চলেছে, জীবিত মানুষরা যখন ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি’, কী ঠিক কিনা?”
স্কারলেট ঘাড় নাড়ল। ইচ্ছে করছে অ্যাশলে সারা জীবন এভাবেই ওর হাত দুটো ধরে থাকুক। কিন্তু অ্যাশলে হাত ছেড়ে দিল।
“তুমি আমার কাছে এলে, ভাবলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। কিন্তু আমি নিরুপায়।”
দু’চোখে হতাশা নিয়ে কুঠার আর কাঠের গাদার দিকে তাকিয়ে রইল।
“বাড়িটা আর নেই, আর টাকাকড়ি যা ছিল – একটা অভ্যেসের মতই হয়ে গেছিল, আলাদা করে তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি – তাও গেছে। আর এই দুনিয়াতে আমি একেবারেই অচল। আমার নিজস্ব দুনিয়া কবে হারিয়ে গেছে। তোমাকে কোনো সাহায্য করার ক্ষমতাই আমার নেই স্কারলেট। চেষ্টাচরিত্র করলে আমি বড় জোর একজন আনাড়ি কিসান হয়ে উঠতে পারি। কিন্তু সেটা দিয়ে তুমি টারাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমার কী মনে হয় – আমাদের অসহায় পরিস্থিতির কথাটা আমি উপলব্ধি করতে পারি না – তোমার দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছি – হ্যাঁ, ঠিকই বলছি স্কারলেট – তোমারই দাক্ষিণ্যে। আমার জন্য, আমাদের জন্য, তুমি যা করেছ, তোমার মহত্ব দিয়ে, সেই ঋণ আমি কোনোদিনই পরিশোধ করতে পারব না। একটা করে দিন যায়, আর এই উপলব্ধিটা আরও তীব্র হতে থাকে। একটা করে দিন যায়, আর আমি বেশি করে বুঝতে পারি যে আমি কত অসহায় – এই বিপর্যয়ের মোকাবেলা করা আমার পক্ষে কত অসম্ভব। বাস্তব পরিস্থিতি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার আমার এই যে অভিশপ্ত প্রবণতা – এটাই আমার বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবেলা করার পথে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী বলছি, বুঝতে পারছ তো?”
স্কারলেট ঘাড় নাড়ল। অবশ্য অ্যাশলে ঠিক কী বলতে চাইছে সেটা নিয়ে ওর স্পষ্ট কোনো ধারণাই হচ্ছে না। ও কেবল রুদ্ধশ্বাসে অ্যাশলের কথাগুলো গিলছে। যে সব চিন্তাভাবনার জন্য স্কারলেটের অ্যাশলেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে হত, আজ প্রথমবার সেই সব কথাগুলোই অ্যাশলে স্কারলেটকে শোনাচ্ছে। ও উত্তেজিত হয়ে পড়ল, যেন অ্যাশলেকে নতুন করে আবিষ্কার করার দিগন্ত ওর সামনে খুলে যাচ্ছে।
“নগ্ন সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাওয়া – এটা একটা অভিশাপ। যুদ্ধের সময় পর্যন্ত জীবনকে পর্দার ওপর পড়া ছায়ার চেয়ে বেশি বাস্তব কখনোই আমার মনে হয়নি। সেটাই আমার ভাল লাগত। জীবনের রূপরেখা খুব স্পষ্ট হয়ে আমার কাছে ধরা পড়ুক – সেটা আমার পছন্দ ছিল না। আমি চাইতাম সেগুলো কিছুটা অস্পষ্টই থাকুক – কিছুটা ঝাপসা থাকুক।”
কথা বলা থামিয়ে ও ম্লান হাসল। শার্টের ওপর ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপট লেগে সামান্য শিউরে উঠল।
"সোজা ভাষায় বলতে গেলে, স্কারলেট, আমি হচ্ছি একজন আস্ত কাপুরুষ।”
ছায়া, জীবনের আবছা রূপরেখা, ওর বলা এই কথাগুলো স্কারলেট ঠিক বুঝতে পারল না। তবে শেষে যে কথাটা বলল, সেই ভাষাটা ও বোঝে। এটাও জানে ওই কথাটা মোটেই সত্য নয়। কাপুরুষতা ওর মধ্যে নেই। ওর ছিপছিপে শরীরের প্রতিটি রেখায় ওর বংশের সাহস আর বীরত্বের পরিচয় বহন করছে। আর যুদ্ধ চলার সময় ওর বীরত্বের যেসব কাহিনী নথিভুক্ত হয়ে আছে সেসব তো ওর মুখস্ত।
“কথাটা তো সত্যি নয়! কাপুরুষ হলে গেটিসবার্গে কামানের ওপর চড়ে মানুষকে জড়ো করতে পারতে? কাপুরুষ হলে জেনারাল কী তোমার সম্বন্ধে নিজে মেলানিকে চিঠি লিখতে যেতেন? আর – ”
“ওগুলোকে সাহস বলে না,” অ্যাশলে খুব ক্লান্ত গলায় বলল। “লড়াই করাটা অনেকটা শ্যাম্পেনের মত। বীর হোক কী কাপুরুষ, মাথায় চড়ে বসতে সময় লাগে না। লড়াইয়ের ময়দানে মূর্খ মানুষও সাহসী হয়ে ওঠে, নাহলে যে মরতে হবে। আমি অন্য কথা বলছিলাম। আমি যে ধরণের কাপুরুষতার কথা বলছি, প্রথমবার কামানের তোপ শুনে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে আসার চাইতেও সেই কাপুরুষতা বহুগুণ বেশি অমর্যাদার।”
কথাগুলো বলছিল থেমে, বেশ অসুবিধে করে, যেন কথাগুলো বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, নিজের মুখ থেকে বের হয়ে আসা কথাগুলো থেকে নিজেকে সামান্য সরিয়ে নিয়ে, বেদনাতুর হৃদয়ে যেন নতুন করে নিজের মূল্যায়ন করে চলেছে। অন্য কেউ হলে, স্কারলেট এই প্রতিবাদকে ছদ্ম বিনয় আর প্রশংসা লাভ করার চেষ্টা মনে করে অবজ্ঞাভরে খারিজ করে দিত। কিন্তু কথাগুলো অ্যাশলে মন থেকেই বলছে। কী আছে ওর দু’চোখে – কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। ভয় নয়, কিংবা কৈফিয়ৎ দিতে চাইছে তেমনও মনে হচ্ছে না, বরং অনিবার্য এবং দুর্বার কোনও ক্লেশের সঙ্গে যুঝতে চাওয়ার ইচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস ওর ভিজে গোড়ালিতে লেগে ওকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু অ্যাশলের কথা শুনে যেরকম আতঙ্কতাড়িত হয়ে পড়ছে, তার তুলনায় এই কাঁপুনি কিছুই নয়।
“তোমার এত কিসের ভয়, অ্যাশলে?”
“অনেক কিছুরই। নাম জানি না। মুখে বলতে গেলে খুবই বোকা বোকা শোনা্য। জীবনটাকে হঠাৎ বড়ই রূঢ় সত্য বলে বোধ হচ্ছে - আমার নিজস্ব দুনিয়াকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে আমাকে স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়েছে। কাদার মধ্যে বসে আমাকে কাঠের গুঁড়ি কাটতে হচ্ছে বলে আমার কোনো দুঃখ নেই, বাস্তবের এই কঠোর স্বরূপটাই কেবল আমায় কষ্ট দিচ্ছে। সাবেক জীবনটার মাধুর্য – যা আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল – সেটা হারিয়ে ফেলার জন্য অবশ্যই কষ্ট পাই। যুদ্ধের আগে, স্কারলেট, জীবনটা কত সুন্দর ছিল। ঠিক গ্রীক ভাস্কর্যের মত – তার একটা চটক ছিল, ঔৎকর্ষ ছিল, পরিপূর্ণতা ছিল, সামঞ্জস্য ছিল। জীবনটা হয়ত সবার জন্য একই রকম ছিল না। আজকাল সেটা বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু আমার কাছে, টুয়েল্ভ ওকসে বসে, বেঁচে থাকার মধ্যে সত্যিকারের মাধুর্য ছিল। আমি ওই জীবনচর্যারই অঙ্গ ছিলাম। অভিন্ন অঙ্গ। কিন্তু সেই সব দিন এখন অতীত। আর এই নতুন জীবনে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে অক্ষম। আমার ভয় করে। এখন আমার মনে হয়ে, পুরনো দিনে জীবন বলতে পর্দার ওপর পড়া ছায়াটাকেই বুঝতাম। যা কিছু অস্পষ্ট, আমি এড়িয়ে চলতাম – জনসাধারণ, পরিস্থিতি – যা আমার কাছে বড় বেশি বাস্তব বলে মনে হত। ওদের ভিড় আমার কাছে অসহ্য লাগত। আমি তোমাকেও এড়িয়ে চলতে চাইতাম, স্কারলেট। তুমি ছিলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর, বড় বেশি বাস্তব, আর আমি এতই কাপুরুষ ছিলাম যে ছায়া আর স্বপ্নময়তাকেই আমি বেশি পছন্দ করতাম।”
“তাহলে – তাহলে – মেলি?”
“মেলানি ছিল আমার নিবিড়তম স্বপ্ন, আমার কল্পনালোকের সহচরী। যুদ্ধটা না লাগলে, টুয়েল্ভ ওকসের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সুখে শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দিতাম, বহমান জীবনটা দেখতে থাকতাম, সেই বহমানতায় নিজে অংশগ্রহণ না করেই। কিন্তু যুদ্ধে বাধায় সব কিছুই উল্টেপাল্টে গেল, রূঢ় বাস্তব জোর করে আমার সত্তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। তারপর যখন প্রথম সরাসরি লড়াইতে নামতে হল – বুল রান-এ, তোমার হয়ত মনে আছে – চোখের সামনে ছেলেবেলার বন্ধুকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখলাম, ঘোড়াদের মৃত্যু আর্তনাদ শুনতে পেলাম, দেখলাম কীভাবে আমার ছোঁড়া গুলি লেগে মানুষ ছটফট করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, রক্ত ঝরছে। কিন্তু যুদ্ধের সেটাই সব চাইতে ভয়াবহ দিক নয়, স্কারলেট। সবচেয়ে ভয়াবহ হল সেই মানুষরা, যাদের সঙ্গে আমাকে থেকে যেতে হল।
“সারাটা জীবন আমি ভিড় এড়িয়ে চলেছি। খুব চিন্তাভাবনা করেই আমি খুব অল্প কয়েকজনকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছি। কিন্তু যুদ্ধ আমাকে শিখিয়েছে যে আমি আসলে কিছু কল্পনাবিলাসী মানুষকে নিয়ে নিজের মত করে একটা দুনিয়া তৈরি করে নিয়েছি। যুদ্ধ আমাকে মানুষকে চিনতে শিখিয়েছে, কিন্তু কীভাবে তাদের সঙ্গে একাত্মবোধ করে ফেলতে হয়, সেই শিক্ষা দেয়নি। কী জানি, সেই শিক্ষা হয়ত কোনোদিনই আমার হবে না। কেবল এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার স্ত্রী, আমার ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে, আমাকে এমন সব মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিখতে হবে, যাদের সঙ্গে আমার ভাবনাচিন্তার কোনও মিল নেই। স্কারলেট, তুমি সাহসের সঙ্গে, স্পর্ধার সঙ্গে, এই জীবনটাকে নিজের ইচ্ছেমত মোকাবেলা করছ। কিন্তু বলতে পার, এই আজব দুনিয়ায় আমার জায়গাটা ঠিক কোথায়? তোমাকে বলি, আমি খুব ভয়ে ভয়েই দিন কাটাচ্ছি।”
মৃদুগম্ভীর কিন্তু হতাশাভরা গলায় অ্যাশলে বলে চলল। কোন অনুভূতি থেকে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে, স্কারলেট সেটা ধরতে পারল না। এখান সেখান থেকে একটা দুটো শব্দকে আঁকড়ে ধরে, সেগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বনের পাখির মত কথাগুলো ওর হাত ফস্কে উড়ে পালাতে থাকল। কী একটা ঘোরে কথাগুলো ও বলে চলেছে, কী একও নিষ্ঠুর শক্তি ওকে তাড়া করে চলেছে, কিন্তু সেটা যে কী হতে পারে, স্কারলেট কিছুতেই আন্দাজ করতে পারল না।
“আমি জানি না, স্কারলেট, ঠিক কবে থেকে এই ভয়াবহ উপলব্ধিটা আমার হল যে আমার ছায়ার জগতটা নিঃশেষে মিলিয়ে গেল। হয়ত বুল রান-এ প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এই উপলব্ধিটা হয়েছিল, যখন গুলি চালিয়ে আমার খুন করা প্রথম মানুষটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যা হবার তা হয়ে গেছে, আমি এখন আর কেবল দর্শক রইলাম না। না, সহসা নিজেকে রঙ্গমঞ্চের পর্দার সামনে আবিষ্কার করলাম, হারা উদ্দেশ্যে হাত পা ছুঁড়ে চলেছি। আমার কল্পলোকের ছোট্ট পৃথিবীটা শূন্যে মিলিয়ে গেল। যাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনার বিন্দুমাত্র মিল নেই, যাদের কার্যকলাপ হটেনটটদের চেয়েও বিচিত্র, তারা আমার দুনিয়ায় হানা দিল। কাদা মাখা পায়ে ঢুকে আমার দুনিয়াকে লণ্ডভণ্ড করে দিল। পালিয়ে বাঁচবার রাস্তাটুকু পর্যন্ত ছাড়ল না। যুদ্ধবন্দী থাকার সময় মনে মনে ভাবতাম যে যুদ্ধ শেষ হলেই আবার আমার পুরনো জীবন আর পুরনো স্বপ্নে ফিরে যেতে পারব আর ছায়াময় জগতটা আবার ফিরে আসবে। কিন্তু স্কারলেট, ফেরার কোনও উপায় নেই। আর আজ সকলে এই সত্যটারই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি, আর সত্যটা যুদ্ধের চেয়ে, যুদ্ধবন্দী হয়ে থাকার চেয়েও বেশি ভয়াবহ – আর আমার কাছে তা মৃত্যুতুল্য ... তাহলেই বোঝো স্কারলেট, আমি আমার ভয় পাওয়ার শাস্তিই পাচ্ছি।”
“কিন্তু অ্যাশলে,” চূড়ান্ত বিভ্রান্তি নিয়ে স্কারলেট বলতে আরম্ভ করল, “কেন – কেন – অ্যাশলে, তুমি না খেতে পেয়ে মরার ভয় করছ – যা হোক করে, দুমুঠো অন্ন আমরা ঠিক জুটিয়ে নিতে পারব! আমি জানি, আমরা পারবই!”
মুহূর্তের জন্য অ্যাশলের চোখ স্কারলেটের দিকে ফিরে এল, শ্রদ্ধালু আয়ত দৃষ্টি। পরের মুহূর্তেই আবার সুদূরে পাড়ি জমাল। কম্পিত হৃদয়ে স্কারলেট উপলব্ধি করল, অ্যাশলে অনাহারে থাকা নিয়ে ভাবছে না। ওরা দুজনে যেন দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা, পারস্পরিক ভাবের আদানপ্রদান দুটো ভিন্ন ভাষায় হয়। স্কারলেট অ্যাশলের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। তাই অ্যাশলের যে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রবণতা – ঠিক এই মুহূর্তে যা করেছে – স্কারলেটের মনে হতে থাকে
পরমুহূর্তেই দৃষ্টি আবার হারা উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাল। স্কারলেট বুঝতে পারল, অনাহারে মরার কথা ভেবে অ্যাশলে বিচলিত হয়নি। ওরা দুজনে যেন দুটো ভিন্ন ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে বার্তালাপ করা দুই ব্যক্তি। কিন্তু ওকে স্কারলেট এমন গভীরভাবে ভালবাসে যে অ্যাশলের যে এই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার অভ্যেস – এখন যেমন করেছে – স্কারলেটের হৃদয়ে সূর্যের উত্তাপ সরে গিয়ে যেন গোধূলির হিমেল শিশিরে ভরে ওঠে। অ্যাশলের কাঁধ ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে নেবার ইচ্ছে করছে। ওকে বুঝিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে যে ও (স্কারলেট) রক্ত মাংসের একজন মানুষ, ওর (অ্যাশলের) স্বপ্নে দেখা বা বইয়ে পড়া কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়। বহুদিন আগে, ইউরোপ থেকে বাড়ি ফিরে অ্যাশলে যখন টারার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে হেসেছিল – তখন ওর সঙ্গে একাত্মবোধ করার যে অনুভূতি হয়েছিল, সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে পাওয়ার জন্য মনে মনে একটা হাহাকার থেকেই গেছে।
“উপোস করে থাকা মোটেই সুখকর নয়,” অ্যাশলে বলল। “আমি জানি, কারণ আমাকে উপোস করে কাটাতে হয়েছে। তবে আমি সেটাতে ভয় পাই না। আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ের হল পুরনো পৃথিবীর গড়িমসি করার আয়েশ হারিয়ে যাওয়া গতিময় এই বর্তমান জীবনটা।”
হতাশ মনে স্কারলেট ভাবতে লাগল একমাত্র মেলানিই পারে ওর এই হেঁয়ালিময় কথার অর্থ বুঝতে। মেলি আর ও দুজনেই এই ধরণের বোকা বোকা কথা বলতে পারে – কবিতা, বই, স্বপ্ন, জ্যোৎস্না আরও সব কল্পনাবিলাসী কথাবার্তা। যে সব ব্যাপার নিয়ে স্কারলেটের মনে ভয় – খালি পেটে থাকা, শীতে কষ্ট পাওয়া, টারা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া – এসব নিয়ে অ্যাশলের মনে কোনো ভয় নেই। ওর ভয় এমন সব ব্যাপার নিয়ে যা স্কারলেট কখনো জানতে পারেনি, বা ওর কল্পনাতেও আসেনি। ভাঙাচোরা এই পৃথিবীতে, অনশন, শীতে কষ্ট পাওয়া বা মাথার ওপরে ছাদ না থাকার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু কি থাকতে পারে, যাকে ভয় পেতে হবে?
আর ও কিনা সমস্যা সমাধানের আশায়, অ্যাশলের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনে যাচ্ছে!
“ওফ!” স্কারলেটের গলায় হতাশার সুর। সুন্দর করে মোড়া উপহার খুলে ফেলার পর, সেটা খালি দেখে শিশু যেমন হতাশ হয়ে পড়ে, ঠিক সেই রকম। সেই সুর শুনে অ্যাশলে হেসে ফেলল, দুঃখের হাসি, মাফ চাওয়ার ভঙ্গীতে।
“এভাবে কথা বলার জন্য আমাকে ক্ষমা কোরো, স্কারলেট। তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না, কারণ ভয় কাকে বলে সেটা তোমার জানা নেই। তোমার হৃদয় সিংহের মত, লেশমাত্র কল্পনাশক্তি নেই, আর তোমার এই দুটো গুণের জন্য তোমাকে আমার ঈর্ষা হয়। বাস্তবের মুখোমুখি হতে তুম দ্বিধা করবে না বা আমার মত কখনো পালিয়ে যেতেও চাইবে না।”
“পালিয়ে যাওয়া?”
এতক্ষণে অ্যাশলে একটা সহজবোধ্য কথা বলেছে, স্কারলেটের মনে হল। ঠিক ওরই মত, অ্যাশলেও লড়াই করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে, তাই ও পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। স্কারলেট জোরে শ্বাস নিল।
“না, অ্যাশলে,” ও কাঁদো কাঁদো গলায় বলল। “ভুল বললে তুমি। আমিও পালিয়ে যেতে চাই। সব মিলিয়ে আমিও বড়ই ক্লান্ত!”
অবিশ্বাস নিয়েই অ্যাশলে স্কারলেটের দিকে তাকাল। দুরন্ত আবেগে স্কারলেট অ্যাশলের বাহু স্পর্শ করল।
“মন দিয়ে আমার কথা শোনো,” স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলতে লাগল। একটা শব্দ অন্য শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে লাগল। “খুব ক্লান্ত আমি। সত্যি বলছি তোমাকে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। আর সহ্য করতে পারছি না। খাবার জোগাড় করার জন্য, টাকা জোগাড় করার জন্য, আমি নিরন্তর আগাছা সাফ করছি, মাটি কুপিয়েছি, তুলো তুলেছি, এমনকি জমিতে লাঙ্গল পর্যন্ত দিয়েছি। আমি আর এক মুহূর্তও এই পরিশ্রম সহ্য করতে পারছি না। তোমাকে বলছি, অ্যাশলে, দক্ষিণ উচ্ছন্নে গেছে! একেবারে উচ্ছন্নে গেছে! ইয়াঙ্কিরা আর আজাদী পাওয়া নিগাররা আর কার্পেটব্যাগারের দল সব কিছু গ্রাস করে নিয়েছে, আমাদের জন্য কিছুই পড়ে নেই। চল অ্যাশলে, আমরা পালিয়ে যাই!”
অ্যাশলে খুব অবাক চোখে ওকে দেখল। দেখল ওর চোখমুখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।
“সত্যি বলছি, চল পালিয়ে যাই আমরা – ওরা সবাই এখানেই পড়ে থাক! সকলের জন্য খাটতে খাটতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। অন্য কেউ ওদের দেখাশোনা করুক। যারা নিজেদের দেখাশোনা করতে পারে না, তাদের দেখাশোনা করার লোকের অভাব হয় না। দোহাই, অ্যাশলে, আমরা পালিয়ে যাই চল, শুধু তুমি আর আমি। মেক্সিকোতে যেতে পারি আমরা – ওদের সেনাবাহিনীতে অফিসার দরকার। আমরা খুব সুখে থাকব ওখানে। আমি তোমার জন্য কাজ করব, অ্যাশলে, তোমার জন্য সব কিছু করব! তুমি যে মেলানিকে ভালবাস না, সে তো তোমার জানা – ”
অ্যাশলে কিছু বলতে উদ্যত হল। বেদনায় ক্লিষ্ট চেহারা। কিন্তু স্কারলেটের কথার তোড়ে ও বাক্যহারা হয়ে গেল।
“তুমিই তো বলেছিলে – সেদিন – ওর থেকে আমায় তুমি বেশি ভালবাস – সেই দিনটা মনে আছে তো তোমার! আর আমি জানি, তুমি বদলে যাওনি! তুমি যে বদলাওনি, সে আমি হলফ করে বলতে পারি! আর এই মাত্র তুমিই তো বললে যে মেলানি তোমার কাছে একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয় – ওহ্ অ্যাশলে, চল আমরা চলেই যাই! আমি তোমাকে খুব সুখী করতে পারব। আর তাছাড়া,” গলায় বিষ ঢেলে বলল, “ মেলানি – ডঃ ফোনটেন বলেছেন – ও আর কখনোই মা হতে পারবে না, আর আমি তোমাকে – ”
অ্যাশলের হাতটা ওর কাঁধের ওপর এমনভাবে চেপে বসেছে যে ওর ব্যথা লাগছে। ওকে থামতে হল।
“টুয়েল্ভ ওকসের সেই দিনটার কথা আমাদের ভুলে যেতে হবে।”
“ভুলে যাওয়াটা কি এতই সোজা? তুমি ভুলতে পেরেছ? বুকে হাত দিয়ে বল তো, তুমি আমাকে ভালবাস না!”
অ্যাশলে একবার জোরে শ্বাস নিল। স্কারলেটের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল –
“না, আমি তোমাকে ভালবাসি না।”
“মিথ্যে কথা!”
“মিথ্যে হলেও,” অ্যাশলে দৃঢ় শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, “এই ব্যাপারে কোনো আলোচনা হতে পারে না!”
“তুমি বলতে চাইছ – ”
“ধর আমি মেলানি আর বাচ্চাটাকে ঘেন্নাই করি, বলতে পার আমি কীভাবে ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারি? মেলানির মনে আঘাত দিয়ে? বন্ধুবান্ধবদের দাক্ষিণ্যের ওপর ওদের ছেড়ে দিয়ে যাব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, স্কারলেট! তোমার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র আনুগত্যবোধও নেই? তুমি তোমার বাপি আর বোনেদের ছেড়ে যেতে পার না। ওঁরা তোমার দায়িত্ব, ঠিক যেমন মেলানি আর বিউ আমার দায়িত্ব। তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছ কী পড়ছ না সেটা বড় কথা নয়, আসল ব্যাপারটা হল ওঁরা আছেন, আর তোমাকে সেটা মেনে নিতেই হবে।”
“আমি ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারি – ওদের নিয়ে আমি বিধ্বস্ত – পুরোপুরি ক্লান্ত – ”
অ্যাশলে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। মুহূর্তের জন্য স্কারলেটের হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। ওর মনে হল অ্যাশলে ওকে নিজের বাহুতে টেনে নেবে। তার বদলে ও অ্যাশলের বাহুতে আস্তে আস্তে টোকা মারতে লাগল আর শিশুদের যে ভাবে ভোলানো হয় সেইভাবে কথা বলতে লাগল।
“আমি জানি তুমি বিধ্বস্ত, তুমি ক্লান্ত। আর তাই তুমি এভাবে কথা বলছ। তিনজন মানুষের বোঝা তোমাকে বইতে হচ্ছে। তবে আমি তোমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করব – সারা জীবন আমি তো আর এরকম আনাড়ি থাকব না – ”
“আমাকে সাহায্য করবার একটাই রাস্তা আছে,” স্কারলেট নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল, “আর তা হল, এখান থেকে আমাকে নিয়ে চল, আর অন্য কোনোখানে আমরা আবার নতুন করে বাঁচি, নতুন করে সুখের সন্ধান করি। কী আছে এখানে যা আমাদের বাধা দিতে পারে?”
“কিছুই নেই,” অ্যাশলে শান্ত স্বরে বলল, “কিছুই নেই – শুধু আমাদের আত্মমর্যাদাবোধটা ছাড়া।”
বিস্মিত আকাঙ্ক্ষা স্কারলেট ওর মুখের দিকে তাকাল। অ্যাশলের চোখের পালকগুলো পাকা গমের মত ঘন সোনালি রঙের। আগে কখনো লক্ষ্য করেনি। অনাবৃত কাঁধে গর্বিত ভঙ্গীতে মাথা ঈষৎ হেলানো। ছিপছিপে ঋজু শরীর থেকে আভিজাত্যের গরিমা ফেটে পড়ছে – পরনের অদ্ভুত পোশাকও সেই গরিমাকে ম্লান করতে পারেনি। দুজনের চোখাচোখে হল। স্কারলেটের চোখে সুস্পষ্ট আবেদন, অ্যাশলের চোখ ধূসর আকাশের নীচে পাহাড়ি ঝিলের মতই দূরবর্তী।
ওর দৃষ্টিতে স্কারলেট নিজের উদ্দাম কামনার পরাজয় উপলব্ধি করতে পারল।
চূড়ান্ত হতাশা আর ক্লান্তিতে শরীর আর মন ভেঙে পড়তে চাইছে। অ্যাশলের হাতে মাথা ফেলে দিয়ে ও কাঁদতে শুরু করল। ওকে কাঁদতে অ্যাশলে কখনো দেখেনি। ও ভাবতেই পারেনি যে ওর মত অসমসাহসী মেয়ের চোখেও জল থাকতে পারে। সহসা ও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। ত্বরিতপদে কাছে এসে স্কারলেটকে বুকে টেনে নিল। ওর কালো কেশে, ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলতে থাকল, “ছিঃ সোনা! তোমার কত সাহস – কেঁদো না! এমন করে কাঁদতে নেই!”
ওর ছোঁয়া পেতেই, বাহুবন্ধনে থাকা শরীরে যে একটা পরিবর্তন এল, সেটা অ্যাশলে অনুভব করল। ছিপছিপে ওই শরীরে এক উন্মাদনা আছে, ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ওই দুটো চোখের সবুজ আভায় এক জাদু আছে। শীতের হিমেল পরশ আর অনুভব করতে পারছে না। অ্যাশলের মনে তখন বসন্তের বাতাসের উষ্ণ ছোঁয়া। বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাস, সবুজ প্রকৃতিকে স্পর্শ করা মর্মর গুঞ্জন। নির্দায়, প্রায় ভুলতে বসা বসন্ত। যৌবনকালের নির্দায়, নিরুদ্বেগ, অলস বসন্ত। দুঃস্বপ্নভরা অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। দেখতে পেল, ওর ঠোঁটের কাছে দুটো রাঙা ঠোঁট অসীম প্রত্যাশা নিয়ে কম্পমান। অ্যাশলে স্কারলেটকে চুম্বন করল।
ঝিনুক দিয়ে কান চাপা দিলে যে রকম সোঁ সোঁ শব্দ পাওয়া যায়, স্কারলেট দুই কানে সেই রকম অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল, আর সেই আওয়াজের ভেতর দিয়ে নিজের বুকের ধক ধক শব্দটাও আবছা করে কানে এসে লাগল। অ্যাশলের আলিঙ্গনে ওর শরীর যেন গলে যাচ্ছে। অনন্তকাল ধরে ওরা একে অপরের সঙ্গে একীভূত হয়ে রইল। অ্যাশলের ঠোঁট ক্ষুধার্তভাবে স্কারলেটের ঠোঁটে চুম্বন করে চলল, যেন সাধ আর মিটতে চাইছেই না।
সহসা অ্যাশলে স্কারলেটকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি দিতেই, স্কারলেটের মনে হল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হাত বাড়িয়ে বেড়াটা ধরে নিজেকে সামলালো। চোখ তুলে তাকাল। প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে জয়লাভ করার আনন্দ।
“তুমি আমাকে ভালবাস! তুমি আমাকে ভালবাস! একবার মুখে বল – শুধু একবার বল!”
অ্যাশলের হাত এখনও স্কারলেটের কাঁধের ওপরে রাখা। অল্প অল্প কাঁপছে। স্কারলেট বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে একটা ভাল লাগার অনুভূতি হচ্ছে। পুলকিত মনে স্কারলেট অ্যাশলের দিকে ঝুঁকে এল। কিন্তু অ্যাশলে কিছুটা ব্যবধান বজায় রেখেই ওকে ধরে থাকল। স্কারলেটের চোখে চোখ রাখল। সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিটা আর নেই। নিজেকে সংযত রাখবার জন্য হতাশ মনে কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
“না!” অ্যাশলে বলল। “না, স্কারলেট! আরো একটু কাছে এলেই, আমি এখানেই, এই মুহূর্তেই তোমাকে নিয়ে নেব।”
স্কারলেট হাসল। প্রশ্রয়ের হাসি। স্থান আর কাল আর বাকি সবকিছু মন থেকে মুছে গেল, কেবল ওর ঠোঁটে অ্যাশলের ঠোঁটের ছোঁয়াটুকুই স্মৃতিতে লেপটে আছে।
সহসা অ্যাশলে স্কারলেটকে ঝাঁকুনি দিতে লাগল। খোঁপা খুলে গিয়ে ঘন কালো কেশ স্কারলেটের কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠে অ্যাশলে স্কারলেটকে ঝাঁকুনি দিতে লাগল – স্কারলেটের ওপর রাগ – নিজের ওপর রাগ।
“এটা আমরা হতে দিতে পারি না!” ও বলে উঠল। “আমি বলছি তোমাকে, এটা আমরা হতে দিতে পারি না!”
স্কারলেটের মনে হচ্ছিল আরও একবার ঝাঁকুনি লাগলেই ওর ঘাড় মটকে যাবে। চোখের ওপর চুল এসে পড়ায় ঠিক মত দেখতে পাচ্ছে না। অ্যাশলের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ওকে রীতিমত হতভম্ব করে ফেলেছে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অ্যাশলের দিকে তাকাল। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। আঙ্গুলগুলো বেঁকে গেছে, যেন খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। অ্যাশলে সোজাসুজি ওর দিকে তাকাল, ধূসর চোখ দুটো ওকে বিদ্ধ করতে লাগল।
“আমারই দোষ – পুরোটাই আমার দোষ – তোমার কোনো দোষ নেই। এরকম আর কখনো হবে না। মেলানি আর বাচ্চাকে নিয়ে আমি চলে যাব।”
“চলে যাবে?” ক্লিষ্টস্বরে স্কারলেট বলে উঠল। “না, না, চলে যেও না!”
“হ্যাঁ, সত্যি বলছি, আমি চলেই যাব! এর পরেও কি আমার এখানে থাকা উচিত? আবার যদি এরকম কিছু ঘটে – ”
“না, অ্যাশলে, তুমি যেতে পার না। কেন যাবে? তুমি ভালবাস আমাকে – ”
“কথাটা মুখ ফুটে বলি, তাই তো তুমি চাও? ঠিক আছে, তবে বলেই দিচ্ছি। আমি তোমাকে ভালবাসি।”
সহসা উন্মাদের মত স্কারলেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ভয় পেয়ে স্কারলেট কুঁকড়ে গিয়ে বেড়ার দিকে সরে গেল।
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার সাহসকে, তোমার একগুঁয়েমিকে, সব বাধা তুচ্ছ করে তোমার এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে, তোমার নির্মম জেদকে – আমি ভালবাসি। কতটা ভালবাসি? এতটাই যে আর একটু হলেই, যে গৃহ আমাকে আর আমার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে, সেই গৃহেরই আতিথেয়তার অমর্যাদা করতে বসেছিলাম। ভুলতে বসেছিলাম আমার প্রিয়তম সঙ্গিনীর কথা, যার মত স্ত্রীলাভ করা যে কোনো পুরুষেরই ভাগ্যের ব্যাপার। এতটাই যে এই পাঁকে ভরা মাটিতেই আমি তোমাকে – ”
স্কারলেটের ভাবনাচিন্তা একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেল। মনে হল ওর হৃদয়ে্র গভীরে কেউ বরফের ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। থেমে থেমে বলল, “এরকমই যদি তোমার মনে হয়ে থাকে – আর আমাকে গ্রহণ করতে তোমার দ্বিধা থাকে – তার মানে তুমি আমাকে ভালবাস না।”
“তোমাকে আমি কখনোই বুঝিয়ে উঠতে পারব না।”
কিছুক্ষণ নীরবে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ স্কারলেট শিউরে উঠল। মনে হল যেন দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ফিরে এসেছে। দুরন্ত শীত, শুকনো খটখটে জমি, আগাছায় ছেয়ে গেছে। ঠাণ্ডায় খুব কাতর হয়ে পড়েছে। অ্যাশলেকেও দেখতে পেল, সেই পুরনো নির্লিপ্ত ভাবটা ফিরে এসেছে, যা ওর ভীষণ চেনা। সেই দৃষ্টিতেও শীতলতার আভাস, যন্ত্রণা আর অনুশোচনায় ভরা।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে স্কারলেটের নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ক্লান্তিতে পা সরল না। এমনকি কথা বলতেও পরিশ্রম বোধ হচ্ছে, মন হতাশায় ভরে উঠছে।
“কিছুই আর থাকল না,” অনেকক্ষণ পরে বলল স্কারলেট। “আমার জন্য আর কিছুই পড়ে রইল না। ভালবাসবার জন্য। লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য। তুমি ছেড়ে চলে যাচ্ছ, টারাও চলে যাচ্ছে।”
অ্যাশলে বহুক্ষণ ধরে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নীচু হয়ে মাটি থেকে এক তাল লাল মাটি হাতে তুলে নিল।
“আছে, আছে, এখনও কিছু থেকে গেছে,” অ্যাশলে বলে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসির একটা ক্ষীণ রেশ, ঠিক যেভাবে অ্যাশলে হাসত, বহুদিন আগে। কিছুটা যেন শ্লেষ মিশে আছে সেই হাসিতে – নিজের প্রতি, স্কারলেটের প্রতি। “এমন কিছু আছে যাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাস, হয়ত তুমি নিজেই জানো না। টারা এখনও তোমারই রয়েছে।”
স্কারলেটের নিস্তেজ হাতটা তুলে নিয়ে ভেজা মাটির তালটা তালুতে রেখে, আঙ্গুলগুলো বন্ধ করে দিল। এখন ওর হাতে কোনো উত্তাপ নেই, স্কারলেটের হাতেও নেই। লাল মাটির তালটার দিকে স্কারলেট কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। কোনো অনুভূতিই হল না। অ্যাশলের দিকে তাকাল। অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করল, অ্যাশলের হৃদয় আবার প্রশান্ত হয়ে উঠেছে। লালসা দিয়ে স্কারলেট সেই প্রশান্তি নষ্ট করতে পারবে না, কেউই পারবে না।
মরে গেলেও মেলানিকে ছেড়ে ও যেতে পারবে না। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ওর অন্তর যদি স্কারলেটের জন্য জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েও যায়, তবুও ও কখনোই ওকে গ্রহণ করবে না। ওকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য নিজের সঙ্গে লড়াই করে যাবে। সেই ব্যুহ ভেদ করে ঢোকা ওর পক্ষে আর কোনদিনই সম্ভব হবে না। আতিথেয়তা, আনুগত্য, মর্যাদা – এই সব কথাগুলো ওর কাছে স্কারলেটের চেয়েও বেশি অমূল্য।
হাতের তালুতে ধরা মাটির তালটা ঠাণ্ডা লাগছে। তালটার দিকে আবার তাকাল।
“ঠিকই বলেছ,” ও বলে উঠল। “আমার কাছে এখনও এটা রয়ে গেছে।”
প্রথমে কথাটা ওর মনে কোনো সাড়া জাগাল না। মাটির তালটাকে কেবল লাল মাটির একটা তাল বলেই মনে হল। তারপর নিজের অজান্তেই ওর কল্পনায় লাল ধুলোর সমুদ্রে ঘেরা টারা ভেসে উঠল। মনে হল কত প্রিয় এই টারা ওর কাছে। কত লড়াই করতে হয়েছে এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আরও কত লড়াই ওকে করতে হবে যাতে টারা ওর হাতছাড়া না হয়ে যায়। অ্যাশলের দিকে তাকাল। কোথায় হারিয়ে গেল মনের সেই উষ্ণ আবেগের ধারাটা? অ্যাশলেকে নিয়ে বা টারাকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে ঠিকই, কিন্তু অনুভব করতে পারছে না। মনের সমস্ত আবেগ যেন কেউ নিংড়ে নিয়ে গেছে।
“তোমার চলে যাবার প্রয়োজন নেই,” দ্বিধাহীন স্বরে বলল। “আমি তোমাদের উপোস করতে দেব না। একবার আমি নিজেকে তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়েছিলাম ঠিকই, তবে সেটার পুনরাবৃত্তি হবে না।”
কথাটা বলেই স্কারলেট পেছন ঘুরে, এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে বাড়ির দিকে চলল। চুলগুলো খোঁপা করে ঘাড়ে বেঁধে নিল। অ্যাশলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কারলেটের চলে যাওয়াটা দেখল। শীর্ণ কাঁধ ঋজু, দৃঢ়বদ্ধ। এতক্ষণ ধরে স্কারলেট অনেক কথাই বলে গেছে, কিন্তু সেই সব কথা ছাপিয়ে ওর চলে যাবার এই দৃঢ় ভঙ্গিমাটাই ওর মনে গেঁথে থাকল।
টীকা
১ গটেরড্যামেরুঙ – ঈশ্বরের পতন/ ইন্দ্রপতন (জার্মান শব্দ, যার অর্থ হল ঈশ্বরের জীবনসন্ধ্যা)
0 মন্তব্যসমূহ