অনুবাদ: ফাতেমা আবেদীন
আজ রোববার। সকালে বৃষ্টি থেমেছে। তখন থেকেই ভাবছি, আমার কবরে এক ঝুড়ি গোলাপ রেখে আসব—টাটকা সুবাস ছড়ানো সাদা ও লাল গোলাপ; যাদের জন্মই হয়েছে প্রার্থনা-বেদি অথবা মুকুটে শোভা পাওয়ার জন্য। আজ সকালের এই বিষণ্ন ভুতুড়ে আবহাওয়া আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের ওপরের সেই স্থানের কথা, যেখানে শহুরে লোকেরা মৃত্যুকে রেখে আসে—একেবারে বিরানভূমি, গাছহীন, ঝাঁট দেওয়া পরিচ্ছন্ন একটি জায়গা। সেখানে মাঝেমধ্যে বাতাসের কেরামতিতে রুটির কিছু টুকরো দেখা যায়। আবার বাতাসের সঙ্গেই মিলিয়ে যায় সেগুলো।
এখন বৃষ্টি নেই। মধ্য আকাশে স্থির সূর্যের উচিত পাহাড় থেকে নামার পথটি চলার যোগ্য করে তোলা। প্যাচপেচে কাদা এতক্ষণে শুকিয়ে যাওয়ার কথা। আমি নিশ্চিত, সূর্য এখন আমার কবরের পাথুরে ফলকটির ওপরে আলো দিচ্ছে, ওখানেই শুয়ে আছে আমার ছেলেবেলার দেহ। এই মুহূর্তে আমি আসলে সূর্যের অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নই। সেটি কোনো গাছের শিকড়ে কিংবা শামুকের গায়ের ওপরও থাকতে পারে।
তবে সূর্যের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, গভীর প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে হাঁটু গেড়ে সে এখন বসে আছে প্রার্থনা-বেদির সামনে। এদিকে প্রথমবার বেদিতে রাখা টাটকা গোলাপগুলো নিতে ব্যর্থ হওয়ায় হাঁটাচলা বন্ধ করে স্থাণু হয়ে আছি আমি। ফুল আমাকে নিতেই হবে। আর সম্ভবত আজই আমি নিতে পারব ফুলগুলো।
লণ্ঠনের আলো মিটমিট জ্বলে ওঠার সময় তার ধ্যান ভাঙল। আস্তে করে মাথা তুলে ঘরের কোনায় চেয়ারের দিকে তাকাল সে। মনে হলো, কিছু একটা এগিয়ে যাচ্ছে বেদির দিকে। সে ভাবছে, নিশ্চয় এটা বাতাস। কোনো কিছুর তরঙ্গ উঠল ঘরের ভেতরে—যেন বহু দিনের পুরোনো স্থির স্মৃতির মধ্যে নাড়া দিয়ে গেল কেউ।
আমি বুঝলাম, এ যাত্রায় আর গোলাপ নেওয়া হচ্ছে না আমার। ফলে আরেকটা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। ওদিকে সে একদম সতর্ক—স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেয়ারের দিকে। এমন সজাগ ভঙ্গি, যেন তার মুখের আশপাশে আমার ফিসফিসানিও জানতে পারছে সে। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর উপায় নেই। সে শোবার ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে আমাকে। প্রতিদিন এ সময় দুপুরে ঘুম দেয় সে। তখন তো গোলাপগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি আমি! তবে গত রোববার বারবার চেষ্টা করেও পারিনি। প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা। তারপর সে ধ্যানমগ্ন হওয়ার পর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ—পারিনি।
আজ অন্য রকম লাগছে তাকে—মনে হচ্ছে অস্থির, চিন্তিত। এই নিঃসঙ্গ বাড়িতে একাকিত্বের চেয়েও তার অন্য এক যন্ত্রণা আছে। এর মধ্যে গোলাপের ঝুড়িটি বেদির ওপর রাখার আগে হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যে কয়েকবার চক্কর দিল সে। ফুলগুলো রেখে ধীরে ধীরে করিডরের দিয়ে গেল শোবার ঘরে। ফিরে তাকাল একবার। আমি জানি, সে লণ্ঠনের দিকেই তাকিয়েছে। করিডরের উজ্জ্বলতায় শেষবারের মতো তার গাঢ় রঙের সোয়েটার ও গোলাপি রঙের পাজামা দেখতে পেলাম। আমার দিকে সে এমনভাবে তাকাল, যেন সেই ছোট্ট কিশোরী, ৪০ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম তাকে! ৪০ বছর আগে আমার শোবার ঘরের বিছানায় হেলান দিয়ে সে বলেছিল, ‘এই দেখো, এখন তারা ঠেসে ধরে তোমার চোখের পাতা খুলছে—কী উজ্জ্বল ও কাঠিন্যে ভরা তোমার চোখ!’
একদম আগের মতোই রয়েছে সে। ৪০ বছর আগের সেই আগস্ট মাসের সন্ধ্যা; নারীরা যখন তাকে আমার ঘরে নিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘কাঁদো। ও ছিল তোমার ভাইয়ের মতো।’ দেয়ালে হেলান দিয়ে নির্দেশমতো কেঁদেছিল সে—তার চোখ দিয়ে যেন বৃষ্টি ঝরছিল।
এদিকে গত তিন-চার রোববার গোলাপগুলোর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি আমি। কিন্তু প্রার্থনা-বেদির ওপর সে যেন পাহারা বসিয়েছে—সব সময়ই হাজির। এমন বিস্ময়কর অধ্যবসায় দিয়ে ফুলগুলো আগলে রাখছে সে, গত কুড়ি বছরেও আমি যা দেখিনি। গত রোববার সে লণ্ঠনের জন্য উঠে যেতেই ফুলগুলো নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর পরও ফিরে আসতে হলো ব্যর্থ হয়ে।
আজ যখন আমি চেয়ারটির কাছে চলে এলাম, করিডরে তখনই পায়ের আওয়াজ। দৌড়ে ফুলগুলো আগের জায়গায় রেখে আসতেই টের পেলাম লণ্ঠন নিয়ে ফিরে আসছে সে। দরজার ফাঁক দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে লণ্ঠনের আলো। সেই গাঢ় রঙের সোয়েটার আর গোলাপি পাজামা তার গায়ে; কিন্তু মুখমণ্ডল অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল। এখন তাকে আর কুড়ি বছর ধরে গোলাপ চাষ করে দিন পার করা বুড়ো নারীর মতো লাগছে না! তাকে বরং আবার কিশোরীরূপে দেখতে পেলাম—আমার মৃতদেহের সামনে বসে কাঁদছিল; বুড়ো নারী যেন পোশাক বদলে এই প্রার্থনাঘরে আজ ফিরে এল ৪০ বছর পর।
আমার জুতোতে এখনো লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া শক্ত মাটি। মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে পায়ে লেগে যাওয়া কাদা সূর্যের তাপে আজই মাত্র শুকাল। কিন্তু কুড়ি বছর ধরে এটি যে আগুনবিহীন ফায়ারপ্লেসের তাপেই শুকিয়েছে, কথাটি প্রায়ই ভুলে যাই আমি। এ বাড়িটি তালাবদ্ধ হওয়ার পর একদিন জুতো খুঁজতে ঢুকেছিলাম। সে সময় খুঁজে পেলাম শুকিয়ে যাওয়া রুটি আর এক থোকা অ্যালোভেরা। আসবাবগুলো সরানো হয়েছে নানা জায়গায়। কিন্তু চেয়ারটি আছে আগের স্থানেই। আমি নিশ্চিত জানতাম, ফায়ারপ্লেসের কাছে একদিন যে জুতোটি শুকাতে দিয়েছিলাম, এ বাড়ির লোকেরা সেটা ভুলে রেখে যাবে।
বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাওয়ার অনেক বছর পর সে ফিরল। কত বছর কেটে গেছে! এ ঘরের মৃগনাভির সুবাস ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ধুলো আর কীটপতঙ্গের কটু গন্ধে। একসময় আমি একাই থাকতাম এখানে। শোবার ঘরে বসে বাতাসের শব্দ, ঘুনপোকার কাঠ খাওয়ার বিজবিজ আওয়াজ শুনতে শুনতে সব আসবাব পুরোনো হয়ে যেতে দেখেছি আমি। এমন এক সময়েই সে এল। হাতে স্যুটকেস, মাথায় সবুজ টুপি আর সেই একই রকম সোয়েটার। সম্ভবত সোয়েটারটি কোনো দিন গা থেকে খোলেনি সে। তখনো সে তরুণী। সেই উচ্ছল তরুণীকেই অতঃপর আস্তে আস্তে মুটিয়ে যেতে দেখলাম। এখন তার পাজামার নিচে গোড়ালির ক্রমবর্ধমান স্ফীতিও এড়ায় না আমার চোখ—এতটাই বুড়িয়ে গেছে সে!
সে যখন তালা খুলে এই বাড়িতে ঢুকল, আমার সারা শরীরে ধুলো আর মাকড়সার জাল জড়ানো। কুড়ি বছর ধরে এই ঘরে গেয়ে চলা ঝিঁঝি পোকাটাও হঠাৎ থেমে গিয়েছিল সে সময়। আমার চোখের ওপর ধুলো, মাকড়সার জালের আস্তরণ; ঝিঁঝি পোকার আচমকা স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই মাঝবয়সী নতুন আগন্তুককে চিনতে পারলাম আমি। বহু আগে আগস্টের এক ঝোড়ো সন্ধ্যার সেই কিশোরীকে আমি চিনেছিলাম, পোকামাকড়ের জংলা সাফ করতে আমার সঙ্গে সে ঢুকেছিল ঘোড়ার আস্তাবলে।
দরজার সামনে অনেকক্ষণ স্যুটকেস ও সবুজ টুপি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, সে চিৎকার করে উঠবে এখনই, ঠিক যেমন একদিন আস্তাবলের ভেতর ঘাসে ঢেকে যাওয়া আমার মুখ দেখে চিৎকার দিয়েছিল। আস্তাবলের ভেঙে যাওয়া মইয়ের সিঁড়িগুলো এখনো সে রকম শক্তপোক্ত। পুরোপুরি দরজা খুলে যখন ঘরের ভেতরে ঢুকল সে, তার মাথায় গড়িয়ে পড়ছিল ধূলাবালু; যেন ছাদের ওপর হাতুড়ি দিয়ে পলেস্তারা খসিয়ে দিচ্ছে কেউ। অবাক হয়ে দরজা নেড়ে সে দেখল, সেটি ঠিকঠাক আছে কি না। এরপর ঘরে ঢুকল আস্তে করে। আর ঘরের মধ্যে ঢুকেই ডাকল, ‘এই ছেলে! এই ছেলে!’ যেন ঘুমন্ত আমাকেই সে ডাকছে। এ সময় এক লহমায় আমিও ফিরে গেলাম ছেলেবেলায়—সেই যেদিন পায়ে আঘাত নিয়ে কাঠ হয়ে বসে ছিলাম চেয়ারে, সেদিন তার ডাক শুনে স্থির হয়ে গেলাম সেভাবেই।
প্রথমে ভেবেছিলাম, বাড়িটি সে দেখতে এসেছে। কিন্তু আমায় বিস্মিত করে এখানেই থাকতে শুরু করল সে। ঝেড়ে-মুছে ঠিক আগের মতো করে তোলার চেষ্টা করল বাড়িটি। তার স্যুটকেস খোলার সঙ্গে সঙ্গে আবার মৃগনাভির গন্ধ ফিরে পেলাম আমি। কিছুদিনের মধ্যেই এসে গেল আসবাব, ট্রাংক ও তার অন্য সব জিনিস। একা একাই সে এ বাড়ির গন্ধ উপভোগ করত। কুড়ি বছর পর আবার বাড়িটির আগের চেহারা ফিরিয়ে এনেছে সে। তৈরি হলো প্রার্থনা-বেদি—সব একদম আগের মতো। যদিও এতকিছু ফিরিয়ে আনার খুব একটা দরকার ছিল না, বরং তার উপস্থিতিই ছিল এ বাড়ির জন্য যথেষ্ট। তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা হারিয়েছি, ধ্বংস হয়েছে যেসব জিনিস, তারা ফিরে আসায় একমুহূর্তে যেন সব ফিরে পেলাম আমি।
সেদিন থেকেই প্রার্থনাঘরের পাশে লাগোয়া শোবার ঘরে থাকতে শুরু করল সে। রাতে সেখানেই খাওয়া-ঘুম। আর দিনের বেলা প্রার্থনাঘরে নীরবে ঈশ্বরের উপাসনা। দরজার কাছে রকিং চেয়ারে বসে কাপড় সেলাই করত বিকেলে। আর ওর কাছে গোলাপ কিনতে আসত যারা, তাদের সঙ্গে তার খাতিরও ছিল খুব। কত্ত কাজকর্মে সাহায্য করত তাদের! কাপড় সেলাই করতে করতে কখনো সে দুলত চেয়ারে। কেউ যখন তার কাছে এক ঝুড়ি গোলাপের জন্য আসত, ফুলের দাম বাবদ কয়েনটি হাতে নিয়ে কোমরে শক্ত করে বাঁধা রুমালের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখত। আর বরাবরের মতো বলত, ‘ডান সারির গোলাপ থেকে পছন্দমতো তুলে নিন, বাঁ পাশেরটা প্রভুর জন্য।’
কুড়ি বছর ধরে একই চেয়ারে বসে কাজ করছে সে, দুলে দুলে কাপড় সেলাই, ঘরের কোনায় চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকা—সবকিছুতেই তার অন্য রকম অধ্যবসায়। এখন তার আচরণ দাদিমার মতো; যেন সেই ছেলেটাকে—আমাকে আর আগলে রাখতে পারে না সে। অথচ একসময় আমার সঙ্গেই কাটত তার ছেলেবেলার বিকেলগুলো। আর এখন এই ঘরের ভেতর আটকে থাকা তার প্রতিবন্ধী নাতি যেন আমি; সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই বড় হতে দেখলাম তাকে।
এখন আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য। চেয়ারে দুলতে দুলতে মাথা যখন একটুখানি নিচু করবে সে, বেদির ওপর থেকে একঝটকায় গোলাপগুলো সরিয়ে নেব আমি। আমি এখন গোলাপের খুব কাছে। ফুলগুলো আমার কবরের প্রস্তরখণ্ডের ওপর আজ আমি রাখবই। এরপর আবার ফিরে আসব সেই চেয়ারের কাছে। ইদানীং তাকে আমার অসহ্য লাগছে। তার জন্যই তো গোলাপ রাখতে পারছি না কবরে।
আমি সেদিনের অপেক্ষা করছি, যেদিন এই প্রার্থনাঘরে আর আসবে না সে। পাশের শোবার ঘরের আওয়াজও থেমে যাবে। সেদিন অবশ্য আরেকটা পরিবর্তনও ঘটবে—মৃত্যুর পর যেভাবে ঘর ছাড়তে হয়েছিল আমাকে, একইভাবে আরেকবার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমায়। কাউকে না কাউকে বলতে হবে, প্রায় ভেঙে যাওয়া বাড়িটাতে যে গোলাপওয়ালি একাকী থাকত, তাকে পাহাড়ের ওপরের ওই বিরানভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য চারজন লোক প্রয়োজন।
এরপর কিছু সময়ের জন্য কিংবা মাত্র একবার অথবা শেষবারের মতো আমি একা থাকব সেই ঘরে। অবশ্য খানিক বাদে আমার ছেলেবেলার বান্ধবীও খুশি হবে। তারও পরিবর্তন ঘটবে। আর সেদিনই সে জানতে পারবে, বেদির ওপর রাখা ফুলগুলোকে প্রতি রোববার কোনো বাতাস স্পর্শ করত না—গোলাপগুলো কেউ ছুঁয়েছিল।
লাইট ইজ লাইক ওয়াটার অ্যান্ড আদার টেলস শিরোনামের সংকলন থেকে নেওয়া গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এই গল্পের ইংরেজি নাম ‘সামওয়ান হ্যাজ টাচড দিজ রোজেস’। ২০১০ সালে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এই সংকলনে মোট আটটি গল্প অনূদিত হয়েছে। গল্পগুলো স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিভিয়েভ ভুলো।
আজ রোববার। সকালে বৃষ্টি থেমেছে। তখন থেকেই ভাবছি, আমার কবরে এক ঝুড়ি গোলাপ রেখে আসব—টাটকা সুবাস ছড়ানো সাদা ও লাল গোলাপ; যাদের জন্মই হয়েছে প্রার্থনা-বেদি অথবা মুকুটে শোভা পাওয়ার জন্য। আজ সকালের এই বিষণ্ন ভুতুড়ে আবহাওয়া আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের ওপরের সেই স্থানের কথা, যেখানে শহুরে লোকেরা মৃত্যুকে রেখে আসে—একেবারে বিরানভূমি, গাছহীন, ঝাঁট দেওয়া পরিচ্ছন্ন একটি জায়গা। সেখানে মাঝেমধ্যে বাতাসের কেরামতিতে রুটির কিছু টুকরো দেখা যায়। আবার বাতাসের সঙ্গেই মিলিয়ে যায় সেগুলো।
এখন বৃষ্টি নেই। মধ্য আকাশে স্থির সূর্যের উচিত পাহাড় থেকে নামার পথটি চলার যোগ্য করে তোলা। প্যাচপেচে কাদা এতক্ষণে শুকিয়ে যাওয়ার কথা। আমি নিশ্চিত, সূর্য এখন আমার কবরের পাথুরে ফলকটির ওপরে আলো দিচ্ছে, ওখানেই শুয়ে আছে আমার ছেলেবেলার দেহ। এই মুহূর্তে আমি আসলে সূর্যের অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নই। সেটি কোনো গাছের শিকড়ে কিংবা শামুকের গায়ের ওপরও থাকতে পারে।
তবে সূর্যের অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, গভীর প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে হাঁটু গেড়ে সে এখন বসে আছে প্রার্থনা-বেদির সামনে। এদিকে প্রথমবার বেদিতে রাখা টাটকা গোলাপগুলো নিতে ব্যর্থ হওয়ায় হাঁটাচলা বন্ধ করে স্থাণু হয়ে আছি আমি। ফুল আমাকে নিতেই হবে। আর সম্ভবত আজই আমি নিতে পারব ফুলগুলো।
লণ্ঠনের আলো মিটমিট জ্বলে ওঠার সময় তার ধ্যান ভাঙল। আস্তে করে মাথা তুলে ঘরের কোনায় চেয়ারের দিকে তাকাল সে। মনে হলো, কিছু একটা এগিয়ে যাচ্ছে বেদির দিকে। সে ভাবছে, নিশ্চয় এটা বাতাস। কোনো কিছুর তরঙ্গ উঠল ঘরের ভেতরে—যেন বহু দিনের পুরোনো স্থির স্মৃতির মধ্যে নাড়া দিয়ে গেল কেউ।
আমি বুঝলাম, এ যাত্রায় আর গোলাপ নেওয়া হচ্ছে না আমার। ফলে আরেকটা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। ওদিকে সে একদম সতর্ক—স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেয়ারের দিকে। এমন সজাগ ভঙ্গি, যেন তার মুখের আশপাশে আমার ফিসফিসানিও জানতে পারছে সে। এখন অপেক্ষা ছাড়া আর উপায় নেই। সে শোবার ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে আমাকে। প্রতিদিন এ সময় দুপুরে ঘুম দেয় সে। তখন তো গোলাপগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি আমি! তবে গত রোববার বারবার চেষ্টা করেও পারিনি। প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা। তারপর সে ধ্যানমগ্ন হওয়ার পর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ—পারিনি।
আজ অন্য রকম লাগছে তাকে—মনে হচ্ছে অস্থির, চিন্তিত। এই নিঃসঙ্গ বাড়িতে একাকিত্বের চেয়েও তার অন্য এক যন্ত্রণা আছে। এর মধ্যে গোলাপের ঝুড়িটি বেদির ওপর রাখার আগে হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যে কয়েকবার চক্কর দিল সে। ফুলগুলো রেখে ধীরে ধীরে করিডরের দিয়ে গেল শোবার ঘরে। ফিরে তাকাল একবার। আমি জানি, সে লণ্ঠনের দিকেই তাকিয়েছে। করিডরের উজ্জ্বলতায় শেষবারের মতো তার গাঢ় রঙের সোয়েটার ও গোলাপি রঙের পাজামা দেখতে পেলাম। আমার দিকে সে এমনভাবে তাকাল, যেন সেই ছোট্ট কিশোরী, ৪০ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম তাকে! ৪০ বছর আগে আমার শোবার ঘরের বিছানায় হেলান দিয়ে সে বলেছিল, ‘এই দেখো, এখন তারা ঠেসে ধরে তোমার চোখের পাতা খুলছে—কী উজ্জ্বল ও কাঠিন্যে ভরা তোমার চোখ!’
একদম আগের মতোই রয়েছে সে। ৪০ বছর আগের সেই আগস্ট মাসের সন্ধ্যা; নারীরা যখন তাকে আমার ঘরে নিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘কাঁদো। ও ছিল তোমার ভাইয়ের মতো।’ দেয়ালে হেলান দিয়ে নির্দেশমতো কেঁদেছিল সে—তার চোখ দিয়ে যেন বৃষ্টি ঝরছিল।
এদিকে গত তিন-চার রোববার গোলাপগুলোর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি আমি। কিন্তু প্রার্থনা-বেদির ওপর সে যেন পাহারা বসিয়েছে—সব সময়ই হাজির। এমন বিস্ময়কর অধ্যবসায় দিয়ে ফুলগুলো আগলে রাখছে সে, গত কুড়ি বছরেও আমি যা দেখিনি। গত রোববার সে লণ্ঠনের জন্য উঠে যেতেই ফুলগুলো নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর পরও ফিরে আসতে হলো ব্যর্থ হয়ে।
আজ যখন আমি চেয়ারটির কাছে চলে এলাম, করিডরে তখনই পায়ের আওয়াজ। দৌড়ে ফুলগুলো আগের জায়গায় রেখে আসতেই টের পেলাম লণ্ঠন নিয়ে ফিরে আসছে সে। দরজার ফাঁক দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে লণ্ঠনের আলো। সেই গাঢ় রঙের সোয়েটার আর গোলাপি পাজামা তার গায়ে; কিন্তু মুখমণ্ডল অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল। এখন তাকে আর কুড়ি বছর ধরে গোলাপ চাষ করে দিন পার করা বুড়ো নারীর মতো লাগছে না! তাকে বরং আবার কিশোরীরূপে দেখতে পেলাম—আমার মৃতদেহের সামনে বসে কাঁদছিল; বুড়ো নারী যেন পোশাক বদলে এই প্রার্থনাঘরে আজ ফিরে এল ৪০ বছর পর।
আমার জুতোতে এখনো লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া শক্ত মাটি। মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে পায়ে লেগে যাওয়া কাদা সূর্যের তাপে আজই মাত্র শুকাল। কিন্তু কুড়ি বছর ধরে এটি যে আগুনবিহীন ফায়ারপ্লেসের তাপেই শুকিয়েছে, কথাটি প্রায়ই ভুলে যাই আমি। এ বাড়িটি তালাবদ্ধ হওয়ার পর একদিন জুতো খুঁজতে ঢুকেছিলাম। সে সময় খুঁজে পেলাম শুকিয়ে যাওয়া রুটি আর এক থোকা অ্যালোভেরা। আসবাবগুলো সরানো হয়েছে নানা জায়গায়। কিন্তু চেয়ারটি আছে আগের স্থানেই। আমি নিশ্চিত জানতাম, ফায়ারপ্লেসের কাছে একদিন যে জুতোটি শুকাতে দিয়েছিলাম, এ বাড়ির লোকেরা সেটা ভুলে রেখে যাবে।
বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাওয়ার অনেক বছর পর সে ফিরল। কত বছর কেটে গেছে! এ ঘরের মৃগনাভির সুবাস ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে ধুলো আর কীটপতঙ্গের কটু গন্ধে। একসময় আমি একাই থাকতাম এখানে। শোবার ঘরে বসে বাতাসের শব্দ, ঘুনপোকার কাঠ খাওয়ার বিজবিজ আওয়াজ শুনতে শুনতে সব আসবাব পুরোনো হয়ে যেতে দেখেছি আমি। এমন এক সময়েই সে এল। হাতে স্যুটকেস, মাথায় সবুজ টুপি আর সেই একই রকম সোয়েটার। সম্ভবত সোয়েটারটি কোনো দিন গা থেকে খোলেনি সে। তখনো সে তরুণী। সেই উচ্ছল তরুণীকেই অতঃপর আস্তে আস্তে মুটিয়ে যেতে দেখলাম। এখন তার পাজামার নিচে গোড়ালির ক্রমবর্ধমান স্ফীতিও এড়ায় না আমার চোখ—এতটাই বুড়িয়ে গেছে সে!
সে যখন তালা খুলে এই বাড়িতে ঢুকল, আমার সারা শরীরে ধুলো আর মাকড়সার জাল জড়ানো। কুড়ি বছর ধরে এই ঘরে গেয়ে চলা ঝিঁঝি পোকাটাও হঠাৎ থেমে গিয়েছিল সে সময়। আমার চোখের ওপর ধুলো, মাকড়সার জালের আস্তরণ; ঝিঁঝি পোকার আচমকা স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই মাঝবয়সী নতুন আগন্তুককে চিনতে পারলাম আমি। বহু আগে আগস্টের এক ঝোড়ো সন্ধ্যার সেই কিশোরীকে আমি চিনেছিলাম, পোকামাকড়ের জংলা সাফ করতে আমার সঙ্গে সে ঢুকেছিল ঘোড়ার আস্তাবলে।
দরজার সামনে অনেকক্ষণ স্যুটকেস ও সবুজ টুপি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, সে চিৎকার করে উঠবে এখনই, ঠিক যেমন একদিন আস্তাবলের ভেতর ঘাসে ঢেকে যাওয়া আমার মুখ দেখে চিৎকার দিয়েছিল। আস্তাবলের ভেঙে যাওয়া মইয়ের সিঁড়িগুলো এখনো সে রকম শক্তপোক্ত। পুরোপুরি দরজা খুলে যখন ঘরের ভেতরে ঢুকল সে, তার মাথায় গড়িয়ে পড়ছিল ধূলাবালু; যেন ছাদের ওপর হাতুড়ি দিয়ে পলেস্তারা খসিয়ে দিচ্ছে কেউ। অবাক হয়ে দরজা নেড়ে সে দেখল, সেটি ঠিকঠাক আছে কি না। এরপর ঘরে ঢুকল আস্তে করে। আর ঘরের মধ্যে ঢুকেই ডাকল, ‘এই ছেলে! এই ছেলে!’ যেন ঘুমন্ত আমাকেই সে ডাকছে। এ সময় এক লহমায় আমিও ফিরে গেলাম ছেলেবেলায়—সেই যেদিন পায়ে আঘাত নিয়ে কাঠ হয়ে বসে ছিলাম চেয়ারে, সেদিন তার ডাক শুনে স্থির হয়ে গেলাম সেভাবেই।
প্রথমে ভেবেছিলাম, বাড়িটি সে দেখতে এসেছে। কিন্তু আমায় বিস্মিত করে এখানেই থাকতে শুরু করল সে। ঝেড়ে-মুছে ঠিক আগের মতো করে তোলার চেষ্টা করল বাড়িটি। তার স্যুটকেস খোলার সঙ্গে সঙ্গে আবার মৃগনাভির গন্ধ ফিরে পেলাম আমি। কিছুদিনের মধ্যেই এসে গেল আসবাব, ট্রাংক ও তার অন্য সব জিনিস। একা একাই সে এ বাড়ির গন্ধ উপভোগ করত। কুড়ি বছর পর আবার বাড়িটির আগের চেহারা ফিরিয়ে এনেছে সে। তৈরি হলো প্রার্থনা-বেদি—সব একদম আগের মতো। যদিও এতকিছু ফিরিয়ে আনার খুব একটা দরকার ছিল না, বরং তার উপস্থিতিই ছিল এ বাড়ির জন্য যথেষ্ট। তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা হারিয়েছি, ধ্বংস হয়েছে যেসব জিনিস, তারা ফিরে আসায় একমুহূর্তে যেন সব ফিরে পেলাম আমি।
সেদিন থেকেই প্রার্থনাঘরের পাশে লাগোয়া শোবার ঘরে থাকতে শুরু করল সে। রাতে সেখানেই খাওয়া-ঘুম। আর দিনের বেলা প্রার্থনাঘরে নীরবে ঈশ্বরের উপাসনা। দরজার কাছে রকিং চেয়ারে বসে কাপড় সেলাই করত বিকেলে। আর ওর কাছে গোলাপ কিনতে আসত যারা, তাদের সঙ্গে তার খাতিরও ছিল খুব। কত্ত কাজকর্মে সাহায্য করত তাদের! কাপড় সেলাই করতে করতে কখনো সে দুলত চেয়ারে। কেউ যখন তার কাছে এক ঝুড়ি গোলাপের জন্য আসত, ফুলের দাম বাবদ কয়েনটি হাতে নিয়ে কোমরে শক্ত করে বাঁধা রুমালের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখত। আর বরাবরের মতো বলত, ‘ডান সারির গোলাপ থেকে পছন্দমতো তুলে নিন, বাঁ পাশেরটা প্রভুর জন্য।’
কুড়ি বছর ধরে একই চেয়ারে বসে কাজ করছে সে, দুলে দুলে কাপড় সেলাই, ঘরের কোনায় চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকা—সবকিছুতেই তার অন্য রকম অধ্যবসায়। এখন তার আচরণ দাদিমার মতো; যেন সেই ছেলেটাকে—আমাকে আর আগলে রাখতে পারে না সে। অথচ একসময় আমার সঙ্গেই কাটত তার ছেলেবেলার বিকেলগুলো। আর এখন এই ঘরের ভেতর আটকে থাকা তার প্রতিবন্ধী নাতি যেন আমি; সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই বড় হতে দেখলাম তাকে।
এখন আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য। চেয়ারে দুলতে দুলতে মাথা যখন একটুখানি নিচু করবে সে, বেদির ওপর থেকে একঝটকায় গোলাপগুলো সরিয়ে নেব আমি। আমি এখন গোলাপের খুব কাছে। ফুলগুলো আমার কবরের প্রস্তরখণ্ডের ওপর আজ আমি রাখবই। এরপর আবার ফিরে আসব সেই চেয়ারের কাছে। ইদানীং তাকে আমার অসহ্য লাগছে। তার জন্যই তো গোলাপ রাখতে পারছি না কবরে।
আমি সেদিনের অপেক্ষা করছি, যেদিন এই প্রার্থনাঘরে আর আসবে না সে। পাশের শোবার ঘরের আওয়াজও থেমে যাবে। সেদিন অবশ্য আরেকটা পরিবর্তনও ঘটবে—মৃত্যুর পর যেভাবে ঘর ছাড়তে হয়েছিল আমাকে, একইভাবে আরেকবার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমায়। কাউকে না কাউকে বলতে হবে, প্রায় ভেঙে যাওয়া বাড়িটাতে যে গোলাপওয়ালি একাকী থাকত, তাকে পাহাড়ের ওপরের ওই বিরানভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য চারজন লোক প্রয়োজন।
এরপর কিছু সময়ের জন্য কিংবা মাত্র একবার অথবা শেষবারের মতো আমি একা থাকব সেই ঘরে। অবশ্য খানিক বাদে আমার ছেলেবেলার বান্ধবীও খুশি হবে। তারও পরিবর্তন ঘটবে। আর সেদিনই সে জানতে পারবে, বেদির ওপর রাখা ফুলগুলোকে প্রতি রোববার কোনো বাতাস স্পর্শ করত না—গোলাপগুলো কেউ ছুঁয়েছিল।
লাইট ইজ লাইক ওয়াটার অ্যান্ড আদার টেলস শিরোনামের সংকলন থেকে নেওয়া গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এই গল্পের ইংরেজি নাম ‘সামওয়ান হ্যাজ টাচড দিজ রোজেস’। ২০১০ সালে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এই সংকলনে মোট আটটি গল্প অনূদিত হয়েছে। গল্পগুলো স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিভিয়েভ ভুলো।
0 মন্তব্যসমূহ