বেন ওকরির গল্প : বার্তা

অনুবাদ : দীপেন ভট্টাচার্য

তুমি পৌঁছালে, তুমি ছিলে মলিন ও ক্ষুধার্ত। তোমার শরীর ময়লায় ঢাকা। তুমি এসেছিলে তুষাররেখার ওপার থেকে। এই ছিল তোমার মহা-অভিযান।

তুমি ভ্রমণ করেছিলে বনের মধ্য দিয়ে, অগণন শহর ও গ্রামের মধ্য দিয়ে, প্রায় না থেমেই, বেশীরভাগ সময়ই পায়ে হেঁটে, গায়ের কাপড়ও বদলাও নি।

তোমার যাত্রা ছিল সেই সব এলাকায় যেখানকার ভাষা ও আচার ছিল তোমার অপরিচিত। তুমি ঘুমিয়েছিলে রাস্তার ধারে, বিচিত্র সরাইখানায়। তুমি একাই চলেছিলে, তোমার সাথে ছিল এমন একটি বার্তা যা কিনা শুধু তুমিই বহন করতে পার।

কত দিন ধরে তুমি ভ্রমণ করছ? তুমি জান না, হয়ত সারা জীবন ধরেই।

তুমি সব সুখ পরিহার করেছ এই পথে চলতে। শুধুমাত্র চলাই ছিল আসলে কঠিন। তুমি চলেছিলে রাতে না ঘুমিয়ে, দিনের বেলা না খেয়ে। যেখানে তুমি যাচ্ছিলে তাই ছিল তোমার বিশ্রামস্থল, তোমার খাদ্য। বার্তাটা পৌঁছাতে হবে, তারপর হবে তুমি মুক্ত।

পার হয়েছ বহু দেশ, লড়াই করেছ নেকড়ের সাথে, জিতেছ শক্তিশালী পুরুষদের বিরুদ্ধে, এড়িয়েছ ধূর্ত মানুষদের, পালাতে পেরেছ ফুসলানো নারীদের হাত থেকে।

যৌবন তোমাকে পরিত্যাগ করেছিল আদিম জঙ্গলে, তবু তুমি চলেছ যৌবনের সাথে, তাকে তুমি হারাও নি কখনো। যৌবন রয়েছে তোমার মধ্যেই, তোমার স্বাধীনতায়, তোমার সত্তার সরলতায়। রাস্তার ময়লার আবরণে সংরক্ষিত হয়েছিল তোমার সজীবতা।

এই যাত্রার শেষ অংশটা ছিল সবচেয়ে খারাপ। গন্তব্যের কাছে আসা মানে দূরে চলে যাওয়াও বটে। প্রাসাদটাকে যেখান থেকে দেখা যায় সেখানে হারিয়ে যাওয়া ছিল সহজ। যখন দেখা যায় দূর্গ-ছাদের পাঁচিল ও মিনার, দেখা যায় পতাকা ও ব্যানার, তখন মনে হয় গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। তারপর নতুন আশা ও উল্লাসে তাড়াহুড়ো করা যায়। কিন্তু পথ তবুও শেষ হয় না। দুরত্ব হল এক বিভ্রান্তিকর জিনিস। আশা সমস্ত কিছুকে কাছের মনে করাতে পারে, তাই সেটা হতে পারে ভয়ঙ্কর।

তুমি তোমার চোখকে রাস্তার ওপরই রেখেছিলে। তুমি গ্রামটিতে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলে। তুমি রাতে সেখানে থাকতে প্রলুব্ধ হয়েছিলে, একজন বৃদ্ধার কাছে তোমার গন্তব্যস্থলকে প্রকাশ করতে গিয়েছিলে, কিন্তু তাহলে পরস্পর-বিরোধী বা নিজ-স্বার্থ-অনুকূল উপদেশ শুনতে। কিন্তু তুমি সেটা নিজের মধ্যে রেখেছ। তুমি কল্পনা করেছ তুমি এখনো তোমার যাত্রার শুরুতে। এই পথ যে ঝুঁকিপূর্ণ আর তোমাকে যে অনেক দূর যেতে হবে সে সম্বন্ধে তুমি সচেতন ছিলে।

তোমার সমস্ত জীবনই ছিল একটা অভিযান। তুমি যদি থেমে এই সম্বন্ধে একটু ভাব, যদি তুমি স্বীকার কর তোমার হতাশা, কে জানে তোমার নিজের তৈরী কোন ফাঁদে তুমি আটকা পড়বে? তাই তোমার সমস্ত জীবন এই অভিযানের ওপর তুমি বাজি রেখেছ। এই যাত্রাই হচ্ছে তোমার জীবন, এই পথেই তোমার জীবন। তুমি হয়তো সে পথে মারাই যেতে, কিন্তু তুমি সজাগ ছিলে। তুমি প্রতিটি মুহূর্তকে সম্পূর্ণ জীবন হিসেবে নিয়েছ, সেটাই তুমি করেছ।

আর তারপর দেখলে তুমি পৌঁছে গেছ। তুমি কোর্টে, তুমি সেই জায়গায়। তোমার ভ্রমণের ময়লা ও ধূলার মাঝ থেকে তোমার বার্তাটা নিয়ে নেওয়া হল। এই কাজটায় তোমার কোনো যন্ত্রণা হল না। এমনকি তুমি বুঝলেও না ব্যাপারটা কী। বার্তাটা তোমার ওপরেই লিখিত ছিল। তোমার ময়লায়, তোমার অধৌত শরীরে, তোমার ক্লান্ত কিন্তু জীবন্ত সত্তায়। সেই বার্তা ছিল তোমার চোখে। এটা ছিল তোমার আগমনে, তোমার স্বপ্নে, তোমার স্মৃতিতে। এটা ছিল তুমি যা কিছু এনেছ তার মধ্যে, এবং যা কিছু আনো নি তার মধ্যেও।

তোমার কাছ থেকে বার্তাটা ছিনিয়ে নেয়া হল। সেটা তোমার থেকে কেটে নেয়া হল, আর তুমি হাল্কা হলে। তোমার বার্তা থেকে তুমি পরিস্কার হলে। তোমাকে মাজা হল, কামানো হল, ধোয়ানো হল, প্রক্ষালন করানো হল সেই বার্তা থেকে। তোমার নোংরা পোষাক খুলে নেয়া হল, আর তোমাকে দেয়া হল নতুন কাপড় যা কিনা ছিল উজ্জ্বল ছিল আলোর মত।

তোমার বীরোচিত অভিযানকে স্বীকার করে একটা রহস্যময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু আসল পুরস্কার ছিল তোমার সত্তা, তোমার ভেতরের মুক্তি। তোমার মধ্যে দেখা দিয়েছিল এক চিরন্তন আলোকবর্তিকা।

সজীব, তরুণ ও স্বাধীন হয়ে তুমি ঘুরে বেড়ালে সেই রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায়। তোমার মনে হচ্ছিল তুমি একটা নতুন পৃথিবীতে, আলোকজ্জ্বল জগতে। এই রাজ্যে এখন তুমি একটা বিমুগ্ধ জীবন যাপন করছ।

তুমি সকাল-সকাল রওনা দিয়েছিলে এবং যখন পৌঁছাবে ভেবেছিলে তার আগেই পৌঁছেছিলে। তোমার সামনে এখন একটা পুরো নতুন জীবন। আর তুমি এখন এখানে, তুমি একজন তরুণ যার সত্তা উজ্জ্বল সোনার মত, যা কিনা সমস্ত পরিমাপের বাইরে, যা কিনা তোমার অস্তিত্বের লঘুতায় ঐশ্বর্যান্বিত। সবকিছুই এখন তোমার সামনে। তোমার মূল অভিষ্ঠ্য ও অভিযান পূর্ণ হয়েছে, কারণ তোমার কাজ তুমি শুরু এবং শেষ করেছ যথাসময়ের পূর্বেই। এখন এসব রয়েছে তোমার বাঁচার জন্য, অতুলনীয় স্বাধীনতায়। কি ভাগ্য তোমার। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, এখন শুধুমাত্র বাঁচবে তুমি সেই জীবনে যা তুমি চেয়েছিলে।

এক বিরাট শহরে এক যুবক সবে এসেছে, হৃদয়ে আশা নিয়ে, তার ভাগ্য গড়তে, তার সবচেয়ে সুখের ও নির্দোষ দিনগুলিতে তার খাঁটি প্রেমকে আবিষ্কার করতে। সেই যুবকের মত তুমি সেই রহস্যময় রাজ্যের রাস্তায় হাল্কা পদক্ষেপে ঘুরছ। পাস্তেল আকাশকে তখন নীল রঙ ছুঁয়েছে, এসেছে ভোরের সূর্যালোক।




অনুবাদক
দীপেন ভট্টাচার্য
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক। জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. এমন গল্প পড়লে ইচ্ছে জাগে অন্যান্য পাঠকের মতামত শুনি । শুধু একক পাঠে ডিসকোর্সের তৃষ্ণা মেটে না ।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটি গল্পহীন। গল্পটিএক দারশনিকের। বেন ওকেরির এই গল্প মানুষের অদম্যতার। অনুবাদ প্রাঞ্জল।

    উত্তরমুছুন