ভাষান্তর : তানবীরা তালুকদার
জর্জি ইভানোভিচ সামান্য পেছনে হেলে বসে হেসে বললেন, “কমরেডগন এ বছর তোমাদের জেলাগুলো মোটের ওপর বেশ ভাল কাজ করেছে। তোমাদেরকে এ কথা বলতে আমাকে বলা হয়েছে।“
লম্বা টেবলে যারা বসেছিলো প্রতি উত্তরে তারাও হাসলো আর দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগলো।
“কমরেডস, যখন সব ঠিকাছে বলা হবে তখন সব ঠিকই আছে, আর যখন তারা ঠিক নেই, তখন পরিস্থিতি খারাপ, এর বাইরে আমরা শুধু শুধু কেন অপরাধবোধে ভুগবো? গত বছর তোমরা রোপন করতে দেরী করলে, আর তোমাদের চত্বরে পরিকল্পনাটা ব্যর্থ হলো। এ ছাড়া অন্য ঝামেলাও ছিলো, খেলাধূলার সব সুযোগ নিয়ে, মনে আছে তোমাদের, হ্যাঁ? আছে মনে তোমাদের?
বাম দিকে বসা, স্টেপানোভ, মাথা নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ, জর্জি ইভানোভিচ, আমরা স্বীকার করি, আমরা শুধু আমাদেরকেই দোষ দিতে পারি।“
“হ্যাঁ, তোমরা নিজেরাই দায়ী। তোমরা এখানে নেতৃত্বস্থানীয়, এবং তোমরা কি ভাবো তোমাদের সাহায্য ছাড়া নির্মাতারা এখানে কোন কাজ করতে পারবে কিংবা তাদের পরিকল্পনা সফল করতে পারবে? তারা শুধু হুকুমের চাকর, তারা নিজ থেকে কেন তাড়াহুড়ো করবে? কিন্তু এই চত্বর তোমাদের, পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে এটি বিখ্যাত, আর প্রমাণিত যে, প্লাস্টিকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, কিন্তু গত বছর মাত্র শতকরা আটাত্তর ভাগ ---- এটা কি? এটা কি ব্যবসার কথা? প্যান্টেলেভ আমার সাথে দেখা করতে এলো, শতকরা আটাত্তর ভাগ-- বলো, বলো কি বলতে চাও? তুমি কি বলতে পারবে – ধন্যবাদ, কমরেড প্যান্টেলেভ, এই জেলার শিল্পের জন্যে তুমি খুব ভাল ব্যবস্থা নিয়েছো, হ্যাঁ?
ওখানে যারা ছিলো সবাই হাসতে শুরু করলো, জর্জি ইভানোভিচ তার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন, চা ততক্ষণে গ্লাসে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো যা তার ঠোঁটে লেগে রইলো।
“কিন্তু এটির সাথে, একটি সত্যি সুখবর আছে। তোমাদের নতুন সচিব, এটা খুবই দুঃখের যে সে এখন এখানে নেই – বসন্তের সময় এখানে এসেছিলেন। প্যান্টেলেভ এসেছিলো হেমন্তের সময়, কিন্তু গরোকোভ এসেছিলো বসন্তের সময়। আর ব্যবসা নিয়ে সে এমন প্রতিবেদন তৈরী করেছে, শুনলে খুশি হবে, , সমস্তকিছু, সত্যিকারের একজন ব্যবসায়ীর মত করে সে সব কারণের যোগাযোগকে এক সাথে করে ব্যাখ্যা করেছে। নির্মাতাদের জন্যে সিমেন্ট অন্য শহর থেকে আনা হয়েছিলো। আর সেটা, আসলেই খুব বেশি বেশি ছিলো। ছয় বছর ধরে প্যান্টেলেভ কিরোভ জেলায় ঢুকতে পারে নি। ড্রাইওয়ালের কারখানা মাত্র একশো ষাট কিলোমিটার দূর, এর পরেই সিমেন্টের কারখানা, যাই বলো, সব খুব বেশি বেশি।“
“জর্জি ইভানোভিচ, আমরা কিন্তু সেখানে গিয়েছিলাম, এমনিই বলছি,” বলে ভোরোবিয়ভ সামনে এগুলো, “কিন্তু ওরা আমাদের সাথে সাথে নিষেধ করে দিয়েছিলো, নির্মাণ কাজে, ওদের সাথে বুরকোভস্কি কারখানার যোগাযোগ ছিলো, এখন ওরা এসব থেকে মুক্ত হয়েছে এবং স্বাধীন, আর এ জন্যই এটি এখানে মিলে গেছে।“
“ওপর থেকে যদি কোন চাপ না থাকতো, ওরা আমাদের এখনও কিছু দিতো না,” ডেভিয়াটোভ কথার মাঝেই বলে উঠলো, “সিমেন্ট সবার দরকার।“
“জর্জি ইভানোভিচ, এটা অবশ্যই প্যান্টেলেভের দোষ। তার তখনই ওদেরকে চাপ দেয়া দরকার ছিলো – হয়ত ওদের কাছে কিছু মজুদ ছিলো।“
“অবশ্যই ছিলো, এটা হতেই পারে না যে তাদের পুরো মজুদ শেষ হয়ে গেছিলো। ছিলো, নিশ্চয়ই ছিলো।“ জর্জি ইভানোভিচ তার চা শেষ করলো। “মোটের ওপর, কমরেডগন, আর অনুমান নয়, কিন্তু এখন থেকে তোমাদেরকে আরও বেশি পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। নিজেরা যদি সমাধান বের করতে না পারো, সহকারীদের ডাকো, নির্বাহিক ব্যবস্থাপকের সাথে কথা বলো, সহকর্মীদের সাথে কথা বলো। আর এখন থেকে চলো সবাই আমরা আমাদের এ বছরের সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করি। একবার শুরু করেছি, চলো ধরে রাখি ---- সবাই রাজি?”
“রাজি।“
“অবশ্যই, রাজি।“
“রাজি, জর্জি ইভানোভিচ।“
“আমরা চেষ্টা করবো।“
“আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।“
“ঠিকাছে, সেটাই ভাল,” জর্জি ইভানোভিচ উঠে দাঁড়ালো। “ আর আমরা তোমাদের সচিবের সাথে দেখা করতে যাবো। তাকে অখুশী হওয়ার সুযোগ দিও না যে আমরা তাকে আগে থেকে কিছুই জানাই নি – আমি শুধুই চেষ্টা করার মধ্যে আছি, তোমরা জানো। তাকে সুস্থ হতে দাও। আর অগাস্ট থেকে তার গলার সমস্যা খুব বেড়ে গেছে, সেটাও কোন ভাল জিনিস নয়।“
সভাতে যারা এসেছিলো তার সবাই আস্তে আস্তে উঠতে শুরু করলো।
“উনি শক্তিশালী মানুষ, জর্জি ইভানোভিচ, সুস্থ হয়ে যাবেন। এটা একটা কাকতাল মাত্র, উনি খুব কমই অসুস্থ হন। এটা অবশ্যই খুব দুঃখের ব্যাপার যে আপনি এসেছেন আর তখনই এটি হলো।“
জর্জি ইভানোভিচ তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন।
“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিকাছে ঠিকাছে, এখন থেকে আমি তোমাদেরকে তখন দেখতে আসবো যখন তোমরা আমার আসার কথা ভাবছো না। নইলে, কি হবে, যখন প্যান্টেলেভ আমার অফিসে আসবে, সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। সে তার অনুতাপ প্রকাশ করতে এসেছিলো।“
উপস্থিত সবাই হাসিতে ফেটে পরলো। জর্জি ইভানোভিচ বলতেই থাকলেন, “ কিন্তু আমি শুধু যাওয়া আসার ফাঁকে এখানে দেখে গেলাম – সবকিছু ঠিকাছে। যেহেতু, সচিব নতুন। ঠিকাছে, ভালো, কমরেডগন”। সে তার ঘড়ির দিকে তাকালো। “দুটোর ওপর বাজে, আমরা অনেকক্ষণ ছিলাম --- সুতরাং এখন শোনো – সবাই দয়া করে এখন সবদিকে যাও, আর আমি আরও আধ ঘন্টা চারদিক ঘুরবো আর দেখবো তোমাদের চত্বরে সবকিছু কেমন চলছে।“
“জর্জি ইভানোভিচ, আমরা কিন্তু এক সাথেই যেতে পারি এবং রাতের খাবার খেতে পারি?” ইয়াকুশেভ আমন্ত্রণ জানালো তাকে। “কাছেই, আমরা সব আয়োজন করে রেখেছি -----।“
“ না, না, আমি চাই না, ধন্যবাদ। আমি চাই না, কিন্তু তোমরা যাও, রাতের খাবার খাও, কাজ করো, এক কথায়, নিজেদের কাজ করো। আর দয়া করে সব জায়গায় আমাকে অনুসরণ করো না। আমি আমার নিজের মত এদিক ওদিক ঘুরে দেখবো। সোজা কোথায়, তোমাদের কাজের জায়গা ঘুরে দেখবো, কমরেডগন।“
হাসিমুখে তিনি অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বারান্দার দিকে হেঁটে গেলেন। “রাইকম” এর সদস্য কর্মীরাও তার পেছনে পেছনে বের হয়ে গেলো, চারদিকে দেখে, তারা চলে যেতে শুরু করলো। ইয়াকুশেভ তার পেছন পেছন যেতে শুরু করেছিল কিন্তু জর্জি ইভানোভিচ তার দিকে আঙ্গুল তাক করলেন, হাসলেন আর পেছনেই দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর জর্জি ইভানোভিচ বারান্দা থেকে নীচে নেমে গেলেন। বারান্দায় তার যাওয়ার প্রতিধ্বনি হলো তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেলো। হালকা পাথরের টুকরোর সমন্বয়ে মেঝেটা তৈরী ছিলো আর দেয়াল গুলো ছিলো বিবর্ণ ও স্থির হালকা নীল রঙের । ছাদে লাগানো বড় গোলাকার দৃঢ় আলোগুলো জ্বলছিলো। জর্জি ইভানোভিচ শেষ পর্যন্ত হেঁটে তারপর প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় গেলেন। যে দুজন কর্মীকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন তারা তাকে খুব জোরে আর অমায়িকভাবে সম্ভাষণ জানালো। তিনিও তাদেরকে প্রতি সম্ভাষণ জানালেন।
তিন তলার দেয়ালগুলো ছিলো বিবর্ণ সবুজ রঙের। জর্জি ইভানোভিচ তথ্যকেন্দ্রের কিছুটা সামনে দাঁড়ালেন। তিনি পেরেক আটকানো একটি টুকরো তুললেন। সেটি পড়ে গিয়ে একটি কাগজের কোনায় লেগেছিল। একজন ভদ্রমহিলা দরজার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো।
“জর্জি ইভানোভিচ, কেমন আছেন।“
“শুভ দিন।“
ভদ্রমহিলা নীচে বারান্দায় চলে গেলো। জর্জি ইভানোভিচ দরজার পাশে তাকালেন। সেখানে একটি হালকা বাদামী রঙের ধাতব ফলকে লেখাঃ “ফমিন, ভি।আই। প্রচারণা অধিদপ্তরের পরিচালক।“
জর্জি ইভানোভিচ মুচড়ে দরজাটা খুললেন।
“আসতে পারি?”
নিজের টেবলে বসে কাজ করছিলো, ফমিন, মাথা তুলে দেখেই লাফিয়ে উঠলো। আসুন, আসুন, জর্জি ইভানোভিচ, দয়া করে ভেতরে আসুন।“
জর্জি ইভানোভিচ ভেতরে ঢুকলেন এবং চারপাশে চোখ বুলালেন। টেবলের ওপরে লেনিনের একটা ছবি ঝুলছে আর কোনায় দুটো পেল্লায় সিন্দুক রাখা আছে।
হাসিমুখে ফমিন তার দিকে এগুলো আর বললো, “জর্জি ইভানোভিচ, আমি এখানে বসি। এই গরমে কেমন করে যেনো অনেক কাজ জমে গেলো।“
জর্জি ইভানোভিচ হাসি মুখে বললেন, “শীতের সময় তো তেমন কাজ থাকে না, তোমার অফিস ঘরটা বেশ মনোরম, আরামদায়ক।“
“আপনার ভাল লেগেছে?”
“হ্যাঁ, ছোট কিন্তু আরামদায়ক। তোমার নাম কি?”
“ভ্লাদিমির ইভানোভিচ।“
“হা হা, যাক তাহলে, দুজন ইভানোভিচ।“
ফমিন হাসিতে ফেটে পড়ে বললো, হ্যাঁ, তারপর নিজের জ্যাকেট টেনে ধরে বললো, “এবং দুজনেই দুটি অধিদপ্তরের প্রধান”।
জোরে হেসে উঠে জর্জি ইভানোভিচ টেবলের দিকে এগুলেন।
“ আচ্ছা তাহলে, সত্যিই অনেক কাজ তবে, ভ্লাদিমির ইভানোভিচ?”
ভ্লাদিমির এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললো, “হ্যাঁ, যথেষ্ঠ, খুব শীগগীরি একটি সংবাদ সম্মেলেন হবে। আর সংবাদ সমিতিটি ততো সক্রিয় নয়, আর কারখানার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ছবিগুলো নিয়েও সমস্যা আছে। ওগুলোর সমাধান সহসা হবে বলে মনে হয় না ---- নানারকম ঝামেলা --- আর দলের সহকারীও অসুস্থ।“
“তাই নাকি, কী সমস্যা? কী ধরনের ছবি সেগুলো?”
“প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমাদের কারখানা এ বছর পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করলো।“
“অনেক বড় ঘটনা। আমি তো জানিই না।“
“আসলে, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমরা একটা ছবির সংগ্রহ বের করতে চাই। সত্যি বলতে কি, সেটা বানানো হয়ে গেছে। আমি তোমাকে এটি এখুনি দেখাচ্ছি।“ টেবলের ড্রয়ার খুলে ফমিন একটি এলবামের নমুণা বের করে তার হাতে দিলো।
“এখানে দেখো নমুণা, কেমন হবে। কালুগার দুজন সহকর্মী এটি আমাদের জন্যে তৈরী করে দিয়েছে। ভালো শিল্পী। সামনের দিকে দিয়েছে আমাদের চত্বরের ছবি, আমাদের লেক আর ঝাউ বনের ছবি আছে পেছনের দিকে।“
জর্জি ইভানোভিচ নমুনাটির পাতা উল্টালেন। “আহা – ভালো --- খুব সুন্দর জিনিস। কিন্তু সমস্যাটি কী?”
“প্রথম সহকারীর এটি পছন্দ হয় নি। তিনি বললেন, “বিরক্তিকর।“
“এই সৌন্দর্যের মধ্যে সে বিরক্তিকর কী খুঁজে পেলো? এটি একটি চমৎকার দৃশ্য।”
“আমিও তাই বলেছিলাম, কিন্তু তিনি কিছুতেই এটিকে মনোনীত করলেন না।“
“কে স্টেপানোভ?”
“হ্যাঁ। সম্পাদক অসুস্থ। দুই সপ্তাহ ধরে তার মনোয়নও পাইনি। শিল্পী এবং মুদ্রক দুই পক্ষকেই আমরা ঘোরাচ্ছি।“
“ঠিকাছে, আমাকে দাও। আমি তোমাকে অনুমোদন দিচ্ছি।“
“জর্জি ইভানোভিচ, আমি তোমার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। আমার কাঁধ থেকে একটি ভারী বোঝা নেমে যাচ্ছে।“
জর্জি ইভানোভিচ একটি কলম নিলেন হাতে এবং এলবামের পেছনদিকে লিখলেনঃ “আমি লেকের দৃশ্যটি অনুমোদন করলাম” এবং তারপর খুব আড়ম্বরে তাতে নিজের স্বাক্ষর দিলেন।
ফমিন তার হাত থেকে এলবামটা নিয়ে দেখলো তারপর টেবলের ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললো, “ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। সমস্ত এলবাম দিয়ে আমি ওদের এখন মেরে ফেলবো। বলবো, সোভিয়েট প্রধান এই লেকের ছবি অনুমোদন করেছে। তাদের পায়ে ধরে টানা হ্যাঁচড়া বন্ধ করো এবার।“
“ঠিক এভাবেই বলো কিন্তু।“ জর্জি ইভানোভিচ হাসলেন আর তির্যক দৃষ্টিতে ব্লটারের পাশে রাখা কাগজগুলোর তিকে তাকালেন। “আর গুছিয়ে রাখা এই জিনিসগুলো কী?”
“এগুলো অবকমের থেকে পাওয়া জুনের নির্দেশনা”।
“ওহ, ফসল নিয়ে যাওয়ার জন্যে?”
“হ্যাঁ, সম্ভবত আপনি আমাদের চেয়ে ভালো জানেন।“
হাসলেন জর্জি ইভানোভিচ।
“হ্যাঁ, আমাকে কিছুটা সময় আর পরিশ্রম করতে হয় বৈ কি এর পেছনে। তোমাদের সম্পাদক দুইবার আসে এবং আমরা এক সাথে বসে আমাদের মগজ ধোলাই করি।
খুব গম্ভীরভাবে ফমিন মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, “নিশ্চয়”।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জর্জি ইভানোভিচ বললেন “হ্যাঁ”, ভ্লাদিমির ইভানোভিচ, “আমরা শুধু শান্তির স্বপ্নই দেখে যাই। যখন আমাদের পা পযর্ন্ত ডুবে যাবে তখনই হয়ত আমরা শান্তি পাবো।“
ফমিন করুণায় তার মাথা নাড়তে নাড়তে হাসলো। জর্জি ইভানোভিচ নির্দেশনাটা হাতে নিলো, পরিচ্ছন মুদ্রণ দেখলো, পাতাগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো এবং একটু ঝাঁকালো, তাতে এগুলো একটু বিশৃঙ্খল হলো।
“ভ্লাদিমির ইভানোভিচ, তুমি এগুলোকে কী মনে করো?”
“নির্দেশনাগুলো?”
“হুম।“
“খুবই ব্যবসায়ী-দৃষ্টির, আমার চোখে মনে হয়। সবকিছু খুব পরিস্কার, যথার্থ। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।“
“তাহলে, যে সময় আর পরিশ্রম এটার পেছনে গেছে তা তবে সার্থক।“
“এগুলো আমাদের প্রয়োজনীয় নথি, এ নিয়ে কোন প্রশ্নই নেই। এগুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্যে তৈরী হয়নি, এগুলোতে সততার সাথে দলের জন্যে দরকারী তথ্য দেয়া আছে।“
“তোমার ভালোলেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। নির্দেশিকাগুলো সাধারণত সিন্দুকে ধূলোর মধ্যে রেখে দেয়া হয়। ভ্লাদিমির ইভানোভিচ, এটা ধরো ----- নির্দেশিকাটা নিয়ে সিন্দুকে রাখো।“
“ওপরে?”
“হ্যাঁ।“
ফমিন খুব যত্নের সাথে কাগজের তোড়াটা তার হাত থেকে নিয়ে সিন্দুকে ওপরে রেখে দিলো। ইতিমধ্যে জর্জি ইভানোভিচ হেঁটে টেবলের পাশে যেয়ে, ড্রয়ার খুলে, ছবির এলবামের নমুণাটা তার হাতে নিলেন।
তিনি এলবামের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, “আমার চোখে, এটি খুবই মনোমুগ্ধকর। ভ্লাদিমির ইভানোভিচ, তুমি জানো আমরা সবাই কী করবো ---- এটাই শেষ – হয়ত এখানেই ওটা। সুতরাং আর কোনো কথা – না, এখানেই শেষ।"
খোলা এলবামটা সে টেবলের ওপর রাখলো, দ্রুত তার জ্যাকেটটা খুলে চেয়ারের ওপর ছুড়ে মারলো। তারপর আস্তে আস্তে টেবলের ওপর উঠলো, উঠে দাঁড়ালো এবং নিজেকে সোজা করলো। ফমিন তার দিকে তাকিয়ে, অবাক হয়ে হাসতে লাগলো। জর্জি ইভানোভিচ প্যান্ট থেকে বেল্ট খুলে ফেললো, নীচে ফেলে দিলো, প্যান্ট ফেলে দিলো, জাঙ্গিয়া ফেলে দিলো, তারপর নমুণাটার দিকে ফিরে তাকিয়ে, উবু হয়ে বসলো। তারপর তার শুকনো এবং অস্থিসার হাতগুলো সামনে ধরলো। হা করে ফমিন তার দিকে তাকিয়ে সব দেখছে। জর্জি ইভানোভিচ আবার তাকালেন, পা মুড়ে রেখেই, অদ্ভূদভাবে এক পা বাড়ালেন। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, তারপর গভীর চোখে ফমিনকে দেখতে দেখতে, কাঁদতে শুরু করলেন। ফ্যাকাশে ফমিন টলমল পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই, জর্জি ইভানোভিচ অপ্রতিভ গলায় বললেন, “তুমি – তুমি নিজে --- “ বিহ্ববল ফমিন সতর্কতার সাথে টেবলের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো।
“জর্জি ইভানোভিচ, কী করছেন – কেন – আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।“
জর্জি ইভানোভিচ জোরে কাঁদলেন, তার ফ্যাকাশে ঠোঁট প্রসারিত হয়ে আটকে গেলো, তার চোখগুলো ঈষৎ খোলা। তার পাগুলোকে এড়িয়ে, ফমিন হেঁটে টেবলের পাশে গেলো। জর্জি ইভানোভিচের পেছনে ছবির এলবামটা সোজা করে টানানো আছে। ফমিন পরিস্কার ঐ বইটার কাছে যেতেই রাগে জর্জি ইভানোভিচ চেঁচিয়ে উঠলেন,”ধরো না, ধরো না, নিজেকে বেশি চালাক ভাবো।“
ফমিন দেয়ালের দিকে পিছিয়ে গেলো। জর্জি ইভানোভিচ বায়ু ত্যাগ করলেন। তার চুলহীন পেছনটা দুলে উঠলো। তার পেছনের মাঝে বাদামী কিছু দ্রুত বড় আর লম্বা হতে দেখা গেলো। হঠাৎ মাংসপেশীর সংকোচন আর প্রসারণে ফমিন অবাক হয়ে গেলো, দেয়াল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, বাদামী সসেজের টুকরোকে থেকে রক্ষা করার জন্যে হাত দিয়ে ছবির এলবামকে ধরে ফেললো। সামান্য এক টুকরো সসেজ ভেঙে তার হাতে পড়লো। এর ঠিক এক মুহূর্ত পরেই এলো আর একটা সরু, হালকা। ফমিন ঠিক একই কায়দায় সেটিও ধরে ফেললো। জর্জি ইভানোভিচের সাদা, ছোট ঝুলন্ত অঙ্গ থেকে, চাপা হলুদ রঙের স্রোত ছুটে এসে টেবলের ওপর দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলোয় গিয়ে মিলিত হলো। জর্জি ইভানোভিচ আবারও কিছু বায়ু ত্যাগ করলেন। নিজেকে চেপে তিনি তৃতীয় বারের মত বের করলেন। ফমিন ধরে ফেললো। প্রস্রাব টেবল থেকে মেঝেতে পড়তে শুরু করলো। জর্জি ইভানোভিচ টেবলের ওপর রাখা ছোট বাক্স থেকে কিছু মসৃণ কাগজের টুকরো তুলে নিলেন। সেগুলো দিয়ে নিজের পেছন মুছে নিলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তার নিজের ছেড়ে রাখা প্যান্টটা তুলতে শুরু করলেন। ফমিন গরম মল হাতে নিয়ে, তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। জর্জি ইভানোভিচ প্যান্ট পরে নিয়ে উদাস চোখে তার দিকে তাকালেন।
ফমিন দেয়ালের দিকে পিছিয়ে গেলো। জর্জি ইভানোভিচ বায়ু ত্যাগ করলেন। তার চুলহীন পেছনটা দুলে উঠলো। তার পেছনের মাঝে বাদামী কিছু দ্রুত বড় আর লম্বা হতে দেখা গেলো। হঠাৎ মাংসপেশীর সংকোচন আর প্রসারণে ফমিন অবাক হয়ে গেলো, দেয়াল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, বাদামী সসেজের টুকরোকে থেকে রক্ষা করার জন্যে হাত দিয়ে ছবির এলবামকে ধরে ফেললো। সামান্য এক টুকরো সসেজ ভেঙে তার হাতে পড়লো। এর ঠিক এক মুহূর্ত পরেই এলো আর একটা সরু, হালকা। ফমিন ঠিক একই কায়দায় সেটিও ধরে ফেললো। জর্জি ইভানোভিচের সাদা, ছোট ঝুলন্ত অঙ্গ থেকে, চাপা হলুদ রঙের স্রোত ছুটে এসে টেবলের ওপর দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলোয় গিয়ে মিলিত হলো। জর্জি ইভানোভিচ আবারও কিছু বায়ু ত্যাগ করলেন। নিজেকে চেপে তিনি তৃতীয় বারের মত বের করলেন। ফমিন ধরে ফেললো। প্রস্রাব টেবল থেকে মেঝেতে পড়তে শুরু করলো। জর্জি ইভানোভিচ টেবলের ওপর রাখা ছোট বাক্স থেকে কিছু মসৃণ কাগজের টুকরো তুলে নিলেন। সেগুলো দিয়ে নিজের পেছন মুছে নিলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তার নিজের ছেড়ে রাখা প্যান্টটা তুলতে শুরু করলেন। ফমিন গরম মল হাতে নিয়ে, তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। জর্জি ইভানোভিচ প্যান্ট পরে নিয়ে উদাস চোখে তার দিকে তাকালেন।
“বেশ, তা --- কিন্তু তুমি এখনো কেনো ----“
তিনি শার্ট ভেতরে গুঁজলেন, যা-তা ভাবে লাফিয়ে টেবলে উঠলেন, নিজের জ্যাকেট নিলেন, হাতের নীচে রেখে দিলেন, তার পেশাবের ছিটে দিয়ে সামান্য ভেজা ফোনের রিসিভারটা তুললেন।
“শোনো, তোমার ঐ লোকটাকে কিভাবে ডাকবো – আরে, কি যেনো ওর ...”
ফমিন কোন রকমে তার ঠোঁট ফাঁক করে গুনগুন করলো, “ইয়াকুশেভ?”
“হ্যাঁ”
“তিনশো সাতাশ।“
জর্জি ইভানোভিচ ফোন ঘোরালেন।
“আমি বলছি। বেশ, কমরেড ইয়াকুশেভ, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। সম্ভবত। হ্যাঁ, হ্যাঁ। না, না আমি এখন আর একজন কমরেডের সাথে আছি। ভ্লাদিমির ইভানোভিচের সাথে। হ্যাঁ, তার সাথে। হ্যাঁ, দুজনের জন্যে হলে ভালো হয়, হ্যাঁ, জলদি করো, এক্ষুণি। আমি বের হয়ে যাচ্ছি। ভালো, হ্যাঁ। হ্যাঁ।“
ফোনের রিসিভার রেখে তিনি জ্যাকেট পরে নিলেন, ফমিনের দিকে আর একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন, তার পেছনে দরজা বন্ধ করে দিলেন। টেবলের কোনা থেকে স্থির একটি ফোঁটা নীচে পড়লো, নোংরা প্রস্রাবগুলো মসৃণ কাঠের ওপর গতিহীনভাবে মিটমিট করছে। নোটবই, সিগারেটদানী, গ্লাসগুলো, এলবামের কোনা সব কিছুর মধ্যে প্রস্রাব লেগেছে। দরজাটা সামান্য খুলে কনকোভার তার মাথা ঢুকিয়ে দিলো।
“ভ্লদ, সে কি এতক্ষণ তোমার সাথে ছিলো? মজার মানুষ তো তুমি, আমাকে কেন ডাকো নি?”
ফমিন দ্রুত তার পেছনটা ওর দিকে দিয়ে, মলসুদ্ধ হাতগুলো লুকানোর চেষ্টা করলো।
“ব্যস্ত আমি, এখন পারছি না, পারছি না ----“
“দাঁড়াও তো। আমাকে বলো কী নিয়ে তোমরা কথা বলছিলে। তোমার ঘরটা গুমোট হয়ে রয়েছে ---- কিসের যেনো গন্ধ ---“
“ভেতরে এসো না, না! এখন না, আমি ব্যস্ত।“ ফমিন চিৎকার করে উঠলো, লাল হয়ে গেলো, কাঁধটা বাঁকালো এবং মাথা টেনে নিলো।
“ঠিকাছে, ঠিকাছে, আমি চলে যাচ্ছি, চেঁচিও না।“
কনকোভা চলে গেলো। বন্ধ দরজার দিকে এক ঝলক তাকালো ফমিন, তারপর দ্রুত নীচু হয়ে, হাতের মলগুলো যেই না টেবলের নীচে ফেলতে যাবে, একটা গাড়ির লম্বা হর্ণের আওয়াজ শুনতে পেলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফমিন আবার জানালার দিকে ছুটলো। “রাইকম কমিটি”র প্রবেশমুখে একটি কালো “চাইকা” আর দুটি কালো “ভোলগাস” থামানো হয়েছে। রাইকমের কর্মীরা জর্জি ইভানোভিচকে ঘিরে আছে, তিনি দৃঢ় পায়ে নীচে তাদের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। খুব খুশীতে হাত নেড়ে, ইয়াকুশেভ কিছু বলছে। জর্জি ইভানোভিচ হাসছেন, মাথা নাড়ছেন। “চাইকা” ঘুরিয়ে সিঁড়ি ঘরের বিপরীত দিকে নিয়ে আসা হলো। ঠান্ডা গ্লাসের উলটো দিকে কপাল ঠেকিয়ে ফমিন সব দেখতে থাকলো। তার হাতে ধরে রাখা মলগুলো আলাদা হতে শুরু করেছে, এক টুকরো বাদামী সসেজ তার জুতোর ওপরে পরে লাফিয়ে উঠলো।
প্রথম প্রকাশ ১৯৯২

লেখক পরিচিতি
ভ্লাদিমির সোরোকিন
জন্ম ১৯৫৫ সালে মস্কোতে। তিনি এ সময়ে একজন উত্তরাধুনিক কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। ১৯৭২ সালে তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি রুশ বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। তার বইয়ের নাম ঃ Day of the Oprichnik, describes a dystopian Russia in 2027।


অনুবাদক পরিচিতি
তানবীরা তালুকদার


তানবীরা তালুকদার
হল্যান্ডে থাকেন।
কবি। গল্পকার। অনুবাদক।
কবি। গল্পকার। অনুবাদক।
0 মন্তব্যসমূহ