অনুবাদক : রওশন জামিল

আন্দ্রেই প্লাতোনভ'র গল্প : তৃতীয় পুত্র
ভূমিকা :
আন্দ্রেই প্লাতোনভ একজন অসাধারণ লেখক, বোধকরি বিশ শতকের সবচেয়ে প্রতিভাবান রুশ লেখক। এক অর্থে তাঁর কোনো সাহিত্যিক পূর্বসুরি নেই, এবং তিনি এখনও পশ্চিমী পাঠকের কাছে স্বল্প পরিচিত, অংশত তাঁর গদ্য অনুবাদ ভীষণ কঠিন হওয়ার কারণে, এবং অংশত তিনি ‘প্রচলিত’ লেখক নন, তিনি ‘আলাদা।’ প্লাতোনোভ কখনই বয়ানের আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলো—প্লট, চরিত্র, গ্রন্থিমোচন, উপসংহার—প্রথাবদ্ধভাবে ব্যবহার করেন না। তিনি বিচিত্রভাবে পাঠকের প্রত্যাশায় বাদ সাধেন। প্লাতোনোভের গল্প পড়তে গিয়ে পাঠক একরাশ সংবেদনার মুখোমুখি হয়, অথচ তার উপলব্ধি করার জন্য তার কোনও ইন্দ্রিয় নেই। এই ইন্দ্রিয় পড়তে গিয়ে তৈরি হতে বা নাও হতে পারে।
জোসেফ ব্রডস্কির কথা মানলে প্লাতোনোভকে অনুধাবন করার সমস্যা তৈরি হয় এই সত্য থেকে যে তিনি প্রচলিত রুশ ভাষা ব্যবহার করেই তাঁর অননুকরণীয় অনন্য ভাষা তৈরি করেছিলেন একটিও নতুন শব্দ প্রয়োগ না করে।

আন্দ্রেই প্লাতোনভ'র গল্প : তৃতীয় পুত্র
এক বৃদ্ধা মারা গেলেন এক প্রাদেশিক শহরে। তাঁর স্বামী, বয়স সত্তর, শ্রমিক, পেনশনের টাকায় সংসার চলে, টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ছয়টি তার পাঠালেন। প্রত্যেকটাতে একই কথা লেখা: ‘তোদের মা মারা গেছেন চলে আয় বাবা।’
অনেক সময় নিয়ে টাকা গুনল টেলিগ্রাফ অফিসের কেরানি, ভুল করল হিশেবে, তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে রশিদ লিখে সিল মারল। কাঠের জানালার ভেতর দিয়ে লালবর্ণ ধারণ করা চোখে শান্ত দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকালেন বৃদ্ধ, অন্যমনস্কভাবে ভাবলেন কিছু, হৃদয়কে তার দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস পেলেন। তাঁর মনে হল বয়স্ক কেরানির হৃদয়টাও ভাঙা, আত্মা পাকাপোক্তভাবে বিভ্রান্ত——হয়ত সেও একজন বিধবা, নয়ত অসদুদ্দেশ্যে পরিত্যক্তা।
তারপর এইখানে সে, কাজ করছে ঢিমেতালে, ভুল করছে ভাঙানি দিতে, তার স্মৃতি ও মনোযোগ ছেঁড়াখোঁড়া; আসলে তুচ্ছ, সহজ-সরল কাজ করতেও সুখ থাকতে হয় মানুষের মনে।
তার পাঠিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন বৃদ্ধ পিতা, বসলেন মৃত স্ত্রীর ঠাণ্ডা পায়ের কাছে, লম্বা টেবিলের পাশে রাখা বেঞ্চে, ধূমপান করতে করতে হতাশাভরা কিছু কথা বললেন আপনমনে, দেখলেন পিঞ্জরের ছোট্ট দাঁড়ে নিঃসঙ্গ ধূসর পাখিটা লাফঝাঁপ করছে। কখনও সামান্য কাঁদলেন তিনি, নিঃশব্দে, তারপর শান্ত হলেন কিছুটা, দম দিলেন পকেট ঘড়িতে, জানালার বাইরে তাকালেন যেখানে আবহাওয়া বদলাচ্ছে অবিরাম——প্রথমে ভেজা, ক্লান্ত তুষারের খণ্ডসহ ঝরে পড়ে পাতা, তারপর আসে বৃষ্টি, তারপর জ্বলজ্বল করে নক্ষত্রের মতো নিস্তেজ বিলম্বিত সূর্য——আর বৃদ্ধ তাঁর সন্তানদের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন।
পরদিন প্লেনে করে পৌঁছাল বড় পুত্র। পরের দুদিনের মাথায় বাকি পাঁচ ছেলেও এসে পড়ল।
ওদের একজন, বয়সের দিক থেকে সেজো, সঙ্গে মেয়েকে নিয়ে এল। ওর বয়স ছয়, আগে কখনও দাদিমাকে দেখেনি।
চতুর্থ দিন, ওদের মা তখনও পড়ে আছেন টেবিলে, কিন্তু মৃত্যুর গন্ধ নেই তাঁর দেহে, অসুখে আর বিশুষ্ক অবসাদে এত নিখুঁত আর পরিপাটি; পুত্রদের প্রাণপ্রাচুর্যভরা সুস্থ জীবনদান করে, বৃদ্ধা নিজের জন্য কেবল রেখেছিলেন তাঁর ক্ষুদ্র কৃশ শরীরটা, দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন তাকে, তা সে যতই জীর্ণ হোক না কেন, যাতে আমৃত্যু তাঁর সন্তানদের ভালোবাসতে পারেন এবং তাঁদের জন্য গর্ববোধ করতে পারেন।
দীর্ঘদেহী লোকগুলো——কুড়ি থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স——নীরবে ঘিরে দাঁড়াল টেবিলে রাখা কফিনটা। ওরা ছয় জন, আর সপ্তম জন হচ্ছেন ওদের বাবা, কনিষ্ঠতম পুত্রের চেয়েও বেঁটে, এবং দুর্বলও। নাতনির হাতটা ধরে আছেন তিনি; আতঙ্কে চোখের পাতা নড়ে যাচ্ছে মেয়েটির এই অদ্ভুত মৃত বৃদ্ধ মহিলাকে দেখে, যিনি পাপড়ি বোজা ফ্যাকাশে চোখে তাকে আদৌ দেখছিলেন না।
মাঝে-মধ্যে নিঃশব্দে সংযত কাঁদল পুত্ররা, নীরবে দুঃখ সইতে গিয়ে বেঁকেচুরে গেল তাদের মুখের মানচিত্র। পিতা আর কাঁদছেন না এখন। অন্যরা আসার আগে ডুকরে কেঁদেছেন তিনি; এখন অব্যক্ত আবেগ আর অসঙ্গত আনন্দে তাঁর আধা ডজন শক্তিশালী পুত্রকে লক্ষ করছেন। ওদের দুজন নাবিক——জাহাজের ক্যাপ্টেন——একজন মস্কোতে অভিনয় করে, আরেকজন——যে মেয়েকে সঙ্গে এনেছে——পদার্থবিদ ও কম্যুনিস্ট, সবচেয়ে ছোটটি কৃষিবদি হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছে, আর সবার বড়জন একটি বিমান তৈরি কারখানার কোনও এক বিভাগের ফোরম্যান, তার বুকে শোভা পাচ্ছে একটি রিবন, শ্রমিক হিশেবে তার সাফল্যের নিদর্শন। ওরা ছজন, এবং ওদের পিতা, তাদের মায়ের মরদেহ ঘিরে নীরবে দাঁড়াল, শব্দহীনভাবে শোকপ্রকাশ করল, প্রত্যেকেই অন্যদের কাছ থেকে তার হতাশা, শৈশবের স্মৃতি, সেই সুদূর ভালোবাসার মুছে যাওয়া সুখ যা তাদের মায়ের হৃদয়ে নিরবছিন্ন ও অবিরল উথলে উঠত, এবং যা এমনকি হাজারও মাইল দূরেও তাদের উপর বর্ষিত হতো তা, গোপন করছে। তারা সবসময় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুভব করেছে, এবং এই বোধ জীবনে সাফল্য অর্জনের পথে তাদের শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। এখন তাদের মা মরদেহে পরিণত হয়েছেন, তিনি কাউকেই আর ভালোবাসতে পারবেন না, এবং ওই টেবিলের ওপর অন্য যে কোনও অনাগ্রহী, অপরিচিত বৃদ্ধ নারীর মতো পড়ে আছেন।
তাঁর প্রতিটা সন্তানই এখন নিঃসঙ্গ, ভীত বোধ করছে, যেন অন্ধকার প্রান্তরের ভেতর এক প্রাচীন বাড়ির কোনও এক জানালার চৌকাঠে প্রদীপ জ্বলছে একটা, আর তা রাতের আঁধার, উড়ন্ত গুবরে পোকা আর নীল ঘাস, অগুনতি ডাঁশ পোকাকে আলোকিত করে তুলেছে——ওই প্রাচীন বাড়ির সমগ্র শৈশবের জগৎ পরিত্যক্ত হয়েছে ওখানে জন্মগ্রহণকারীদের দ্বারা; কখনও তালো দেওয়া হয়নি ওই বাড়ির দরজায়, যাতে এখান থেকে যে চলে গিয়েছে সে ফিরে আসতে পারে, কিন্তু কেউই ফিরে আসেনি। আর এখন রাতের ওই জানালা থেকে মুছে গেছে আলো, আর বাস্তবতা পরিণত হয়েছে স্মৃতিকাতরতায়।
বৃদ্ধা মারা যাওয়ার আগে স্বামীকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহ ঘরে থাকতেই পাদ্রি ডেকে দোয়া পড়াতে কিন্তু কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় যেন পাদ্রি না থাকে যাতে তাঁর সন্তানেরা বিরক্ত না হয় এবং তাঁর কফিনের পেছন হাঁটতে পারে। বৃদ্ধা এতটা বিশ্বাস করতেন না ঈশ্বরে, যতটা চেয়েছেন তাঁর স্বামী, সারাজীবন ভালবেসেছেন যাঁকে, আরও গভীরভাবে শোক করুন তাঁর জন্য, এবং প্রার্থনাসঙ্গীতের মূর্চ্ছনার সঙ্গে তাঁর প্রাণহীন দেহের ওপরে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতির আলোয় বিলাপ করুন; তিনি আনন্দময় সময় ও তাঁর কিছু স্মৃতিময়তা পেছনে না রেখে জীবন থেকে বিদায় নিতে চাননি। তাঁদের সন্তানদের আগমনের পর, এদিক-ওদিক একজন পাদ্রির খোঁজ করলেন বৃদ্ধ এবং শেষমেশ সন্ধের দিকে একজন লোককে নিয়ে এলেন। ইনিও বয়স্ক, অ-পাদ্রিসুলভ সাধারণ পোশাক পরনে, শাকসবজি আর তেলচর্বিহীন খাবার খাওয়ায় মুখাবয়ব লালচে-গোলাপি, চোখ দুটো উজ্জ্বল, কোনও সংকীর্ণ চিন্তা বা বিশেষ উদ্দেশ্যে চকচক করছে। পাদ্রির ঊরুর কাছে একটা আর্মি অফিসার্স ম্যাপ কেস বাঁধা; ওটায় তাঁর উপাসনার জিনিসপত্র থাকে : ধূপ, সরু মোমবাতি, একটা গ্রন্থ, আলখাল্লা, এবং চেইনে ঝোলানো একটা ধুনুচি। কফিনের চারপাশে মোমবাতিগুলো দ্রুত সাজালেন তিনি, ধরালেন ওগুলো, ধুনুচিতে পুড়তে থাকা ধূপে ফুঁ দিলেন, এবং— কাউকে আগাম সতর্কবার্তা না দিয়েই— কফিনের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে পবিত্র কিতাব থেকে পাঠ শুরু করলেন। উঠে দাঁড়াল ঘরে উপস্থিত ছেলেরা, খানিকটা বিব্রত ও লজ্জিত বোধ করছে। কফিনের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা, দৃষ্টি মাটিতে। ওদের সামনে যন্ত্রচালিতের মতো তবে তাড়াহুড়ো না করে পাদ্রি বিলাপসঙ্গীত গাইল ও শ্লোক আউড়ে গেলেন, মৃত বৃদ্ধার ছেলেদের ক্ষুদ্র অথচ সেয়ানা চোখের কোণে লক্ষ করতে করতে। ওদের একই সঙ্গে ভয় পাচ্ছিলেন ও শ্রদ্ধা করছিলেন তিনি। এটাও বোঝা যাচ্ছিল ওদের সঙ্গে কথা শুরু করা, এমনকি সমাজতন্ত্র কায়েমের ব্যাপারে নিজের আগ্রহ ব্যক্ত করার জন্য একরকম মুখিয়ে আছেন তিনি। কিন্তু ছেলেগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল এবং একজনও—মায় বৃদ্ধ স্বামীও—ক্রুশ আঁকল না; আসলে এটা ছিল কফিন ঘিরে সম্মান প্রদর্শনের ব্যপার—কোনও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নয়।
যখন শেষ হলো পাদ্রির পাঠ, দ্রুত নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন তিনি, কফিনের চারপাশের প্রজ্জ্বলিত মোমগুলো নেভালেন ফুঁ দিয়ে, এবং নিজের সব সম্পত্তি ভরে ফেললেন অফিসার্স ম্যাপ কেইসে। পিতা কিছু টাকা গুঁজে দিলেন তাঁর হাতে, এবং পাদ্রি, আর একটুও দেরি না করে, দীর্ঘদেহী ছয় পুরুষের মধ্যদিয়ে পথ করে, তাদের দিকে না তাকিয়ে, দরজার বাইরে অদৃশ্য হলেন। আসলে শবাধার যাত্রী হওয়ার জন্য সানন্দে এই বাড়িতে থেকে যেতেন তিনি, যুদ্ধ ও বিপ্লবের পটভূমি সম্পর্কে কথা বলতেন, এবং নয়া দুনিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এই সাক্ষাতের কথা দীর্ঘকাল তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণে রাখতেন। এ দুনিয়াকে মনে মনে তারিফ করেন তিনি কিন্তু এখানে কখনই প্রবেশ করতে পারবেন না। যখন একা থাকেন, মাঝে-মধ্যে বীরোচিত কোনও সাফল্যের স্বপ্ন দেখেন যা তাঁকে এই নতুন প্রজন্মের সঙ্গে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের শরিক করতে পারে। এ জন্য স্থানীয় বিমানঘাঁটিতে তিনি একটা আবেদনও জমা দিয়েছেন : তাঁকে যেন অনেক উঁচু থেকে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই প্যারাশুট ড্রপ করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনও জবাব দেয়নি তাঁরা।
সন্ধ্যায় বাড়ির দ্বিতীয় কামরায় ছয়টা বিছানা পাতলেন পিতা, আর নাতনিকে শোয়ালেন নিজের বিছানায়, যেখানে মৃত বৃদ্ধা চল্লিশ বছর ঘুমিয়েছিলেন। কফিনটাও ওই ঘরেই। ছেলেরা অন্য ঘরে চলে গেল। ওরা জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে না পড়া অবধি পিতা দাঁড়িয়ে থাকলেন দরজায়, তারপর দরজা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন নাতনির পাশে। নাতনি আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিরাট বিছানায় একা, কম্বলে মাথা মুড়ে।
ল্যাম্পের মৃদু আলোয় ওর শিয়রের কাছে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ : বাইরে তুষারপাতে আকাশের ক্ষীণ উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে, আর তাতে জানালার ভেতর দিয়ে ঘরের অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠেছে। খোলা কফিনের কাছে হেঁটে গেলেন বৃদ্ধ, স্ত্রীর হাতে, কপালে আর ঠোঁটে চুম্বন করে বললেন : ‘এখন তুমি তুমি বিশ্রাম নাও।’ সন্তর্পণে নাতনির পাশে শুয়ে পড়লেন তিনি এবং চোখ বুজলেন যাতে তাঁর হৃদয় ভুলে যায় সবকিছু। তন্দ্রাভিভূত হলেন তিনি, এবং হঠাৎ জেগে উঠলেন। তাঁর ছেলেরা যে কামরায় ঘুমাচ্ছে তার দরজার নিচে আলো দেখা যাচ্ছে। বৈদ্যুতিক বাতি আবার জ্বেলে দিয়েছে ওরা, হাসি আর কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
বাচ্চা মেয়েটা ওই শব্দে এপাশ ওপাশ করতে লাগল; হয়ত সে ঘুমোচ্ছিল না, কিন্তু ভয়ে কম্বলের নিচে থেকে মাথা বের করছিল না, নিশুতি রাত আর মৃত মহিলাকে ভয় পাচ্ছিল।
বড় ছেলে ফাঁপা ধাতব চালকযন্ত্রের কথা বলছিল বিপুল উৎসাহ আর গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে; তার কণ্ঠে সন্তুষ্টি আর শক্তির ছাপ। ওর সুগঠিত দাঁত, যা যথাসময়ে যত্ন নেওয়া হয়েছিল, রক্তিম কণ্ঠ কল্পনা করা কঠিন হয় না। নাবিকরা নানা বন্দরের গল্প করছিল আর হাসছিল কারণ বাবা পুরনো কম্বল দিয়েছেন তাদের যেগুলো তারা শৈশবে আর কৈশোর ব্যবহার করত। মোটা শাদা কাপড়ে কম্বলের ওপরে আর নিচের দিকে পাড় সেলাই করে তাতে লেখা: মাথার দিক, পায়ের দিক, যাতে কম্বল বিছানোর সময়ে ঠিকভাবে পাতা যায়। ভুল করে পায়ের অংশ মুখের দিকে গিয়ে মুখে ময়লা না লাগে। এরপর নাবিকদের একজন অভিনেতার সঙ্গে কুস্তি শুরু করে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল যা তারা ছেলেবেলায় সবাই একসঙ্গে থাকার সময় করত। কনিষ্ঠ পুত্র উস্কানি দিচ্ছে ওদের, বড়াই করে বলল, সবাইকে সে একহাতেই মোকাবেলা করতে পারে। পরিষ্কার বোঝা যায়, ভাইয়েরা পরস্পরকে ভালোবাসে এবং এই সাক্ষাতে খুশি হয়েছে। বহু বছর হলো তারা একসঙ্গে নেই, এবং কেউই জানে না আগামীতে আবার কবে দেখা হবে। হয়ত তাদের বাবার অন্ত্যেষ্টিতে? কুস্তি করার সময় দুই ভাই একটা চেয়ারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল, একটুক্ষণের জন্য স্থির থাকল ওরা, কিন্তু তারপর, বাহ্যত মনে পড়ায় যে তাদের মা মারা গেছেন এবং কিছুই শুনতে না পাওয়ায়, যা করছিল আবার শুরু করল। অচিরেই সবচেয়ে বড়ছেলে অভিনেতাকে বলল নিচু গলায় একটা গান ধরতে। সে নিশ্চয় মস্কোর নতুন গান জানে। কিন্তু অভিনেতা জানালো এভাবে সঙ্গত ছাড়া গান গাওয়া তার পক্ষে কঠিন। ‘আমাকে কিছু বাজিয়ে সাহায্য করো,’ বলল অভিনেতা। তারা কিছু দিয়ে মাথা মুড়ে দিল ওর, এবং সে আচ্ছাদনের নিচে থেকে গাইতে শুরু করল যাতে বিব্রত বোধ না করে। সে যখন গান করছিল, কনিষ্ঠ পুত্র কিছু একটা করল ফলে এক ভাই মেঝেতে থাকা সেজো ভাইয়ের ওপর গড়িয়ে পড়ল। সবাই হেসে উঠল ওরা এবং কনিষ্ঠকে বলল বাম হাতে ভাইকে মেঝে থেকে টেনে তুলতে। কনিষ্ঠ সন্তান নিচুস্বরে ভাইদের কথার জবাব দিল এবং দুজন হাসিতে ফেটে পড়ল—এত জোরে যে বাচ্চা মেয়েটা অন্ধকার কামরায় কম্বলের নিচে থেকে মাথা বের করে চেঁচিয়ে উঠল।
‘দাদা! ও দাদা! তুমি কি ঘুমাচ্ছ!’
‘না, ঘুমাইনি, আমি ঠিক আছি,’ বললেন বৃদ্ধ, এবং খুক্ খুক্ কাশলেন।
ছোট মেয়েটা হাল ছেড়ে দিল, ফুঁপিয়ে উঠল ভয়ে। বৃদ্ধ ওর মুখে হাত বোলালেন। ভেজা।
‘তুই কাঁদছিস কেন?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।
‘দাদির জন্য খারাপ লাগছে,’ জবাব দিল ছোট মেয়েটা। ‘আমরা বাকি সবাই বেঁচে আছি, হাসছি, আর একমাত্র তিনিই মারা গেছেন।’
বৃদ্ধ বললেন না কিছু। নাকের সর্দি টানলেন একটু, খুক করে কাশলেন। ছোট মেয়েটা ভীত হয়ে উঠল, দাদাকে ভালো করে দেখার জন্য মাথা উঁচু করল। দেখবে, কী জন্য তিনি ঘুমোচ্ছেন না। তাঁর মুখের দিকে তাকাল ও, জিজ্ঞেস করল:
‘তুমিও কাঁদছ? আমি বন্ধ করেছি।’
দাদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর ফিসফিস করে জবাব দিলেন:
‘কিছু না…আমি কাঁদছি না, এটা ঘাম।’
ছোট মেয়েটা বিছানার শিয়রের ধারে বসল।
‘তুমি কি বুড়ির অভাব বোধ করছ?’ বলল সে। ‘কেঁদো না। তুমিও বুড়ো হয়েছ, শিগগিরই মারা যাবে। তখন তুমি এমনিতেই কাঁদবে না।’
‘আর কাঁদব না,’ বৃদ্ধ জবাব দিলেন শান্ত গলায়।
কোলাহলপূর্ণ পাশের ঘরটায় হঠাৎ করে স্তব্ধতা নামল। কোনও এক ছেলে এর আগেই কিছু একটা বলেছিল। তারপর সবাই চুপ করল ওরা। আরেক ছেলে আবার নিচু স্বরে বলল কিছু। কণ্ঠস্বর থেকে বৃদ্ধ তাঁর সেজো ছেলেকে চিনতে পারলেন, পদার্থবিজ্ঞানী, এই ছোট্ট মেয়েটার বাবা। এর আগে ওর কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি, সে কিছুই বলেনি, হাসেওনি। কোনওভাবে অন্য ভাইদের চুপ করাল সে। তারপর এমনকি পরস্পরের মধ্যে কথাও বন্ধ হয়ে গেল।
শিগগিরই খুলে গেল দরজা, তৃতীয় পুত্র দেখা দিল, দিনের পোশাক পরা। মায়ের কফিনের কাছে হেঁটে গেল সে এবং তার ম্লান মুখের উপর ঝুঁকল। ওই মুখে এখন আর কারও জন্যেই কোনও অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।
গভীর রাতে সবকিছু নীরব নিথর। বাইরের রাস্তায় কেউ হাঁটছে না বা গাড়ি চালাচ্ছে না। অপর কামরায় পাঁচ ভাই হুটোপাটা করছে না। বৃদ্ধ ও নাতনি তাঁর পুত্র ও বাবাকে লক্ষ করছে, এত মনোযোগ দিয়ে যে তারা নিশ্বাস নিচ্ছে না।
হঠাৎ সোজা হল সেজো ছেলে, অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে কফিনের প্রান্ত স্পর্শ করল, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না ওটা, কেবল টেবিলের একপাশে সামান্য নড়াতে পারল, পা হড়কে নিজে মেঝেতে পড়ে গেল। তার মাথা ঠুকে গেল গেল মেঝের কাঠে, কিন্তু ছেলে টুঁ শব্দ করল—তবে তার মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
অন্য পাঁচ ভাই দৌড়ে এল তাদের অন্তর্বাস পরেই এবং তাকে পাঁজাকোলা করে নিজেদের কামরায় নিয়ে গেল, তাকে ধাতস্থ করার জন্য। খানিক পর, সেজো ছেলের যখন জ্ঞান ফিরল, অন্যদের স্যুট নয়ত ইউনিফর্ম পরা হয়ে গেছে, যদিও তখন মাত্র রাত দুটো। একে একে ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল ওরা, রাতের অন্ধকারে বাড়ির চারপাশে যেখানে তারা তাদের শৈশব কাটিয়েছে, কাঁদল সেখানে, বিড়বিড় করে বিলাপ করছে, যেন ওদর মা ওদের প্রত্যকের সামনে দাঁড়িয়ে, যেন তার কথা শুনছেন, আফসোস করছেন যে তিনি মারা গেছেন এবং তাঁর জন্য তার সন্তানদের শোক করতে বাধ্য করছেন; যদি তিনি পারতেন তাহলে সারা জীবন বেঁচে থাকতেন, যাতে তাঁর জন্য কাউকে কষ্ট করতে না হয় কিংবা সময় অপচয় হয় কেননা তাঁর নিজের হৃদয় ও দেহ দিয়ে তিনি ওদের জন্ম দিয়েছেন…কিন্তু মা খব বেশিদিন বেঁচে থাকলেন না।
সকালে ছয় পুত্র কফিনটা তুলল তাদে কাঁধে এবং সমাহিত করার জন্য বাইরে নিয়ে গেল, আর বৃদ্ধ নাতনির হাত ধরে ওদের অনুসরণ করলেন; এখন তিনি বৃদ্ধার জন্য শোকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন এবং তিনি সন্তুষ্ট, এবং গর্বিতও এই ভেবে যে তাঁকেও এই ছয় বলিষ্ঠ পুরুষ এরচেয় খারাপ ভাবে সমাহিত করবে না।
0 মন্তব্যসমূহ