হুলিও কোর্তাসার'এর গল্প : মানুষ শিকার

অনুবাদ: মোস্তাক শরীফ

হোটেলের লম্বা লবির অর্ধেকটা এসে তার মনে হলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে সম্ভবত। পাশের ভবনের তত্ত্বাবধায়ক কোনায় সামান্য একটু জায়গায় মোটরসাইকেলটা রাখতে দিয়েছে, সেটা নেয়ার জন্য দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। মোড়ের গয়নার দোকানের ঘড়িটা ন’টা বাজতে দশ মিনিট দেখাচ্ছে, মানে হাতে সময় আছে এখনও। নগরকেন্দ্রের লম্বা ভবনগুলোর ফাঁকফোঁকর গলে সূর্যের আলো এসে পড়ছে, আর সে, ‘সে’-ই -- যেহেতু নিজের জন্য -- নিজের ভাবনাকে বয়ে বেড়ানোর জন্য -- কোনো নাম নেই তার -- লাফিয়ে মোটরবাইকে উঠল, বাইক চালানোর ভাবনাটা আনন্দ এনে দিচ্ছে মনে।

দু’পায়ের ফাঁকে গরগর করে উঠল বাহনটা, ঠান্ডা বাতাস কামড় বসাল পায়ে। সদর রাস্তার পাশে গোলাপি, সাদা, একটার পর একটা মন্ত্রণালয়ের ভবন আর দোকানপাট সাঁই সাঁই করে পেছনে সরে যেতে লাগল, ঝলমল করছে জানালাগুলো। ভ্রমণের সবচেয়ে আনন্দময় অংশটা শুরু হয়েছে, আসল অংশ -- দু পাশে গাছে ভরা লম্বা একটা রাস্তা, গাড়িঘোড়া বলতে গেলে নেই-ই, আছে বিশাল সব ভিলা, যার বাগানগুলো ফুটপাথের প্রান্তে এসে থেমেছে, নিচু সব লতাগুল্ম বাগানের সীমানা নির্দেশ করছে। কিছুটা অমনোযোগী ছিল হয়তো বা, ডান পাশ দিয়ে আরামে বাইক চালাতে চালাতে তাজা হাওয়ার মৌতাত আর এখনও ঠিকমতো শুরু না হওয়া দিনটির নির্ভার আমেজে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত এই গা ছেড়ে দেয়ার কারণেই হয়তো এড়ানো গেল না দুর্ঘটনাটা। সবুজ বাতি তখনও জ্বলছে, রাস্তার কোনায় দাঁড়ানো মহিলাটি এ অবস্থাতেই ছুটে এল পথচারি পারাপারের জায়গাটায়, ফলে দুর্বিপাকটা ঘটেই গেল। প্রাণপণে ব্রেক চাপল সে, পা আর হাত দুটো দিয়েই, শরীরটাকেও হেলিয়ে দিল বামে। মহিলার চিৎকার কানে এল, তারপর, সংঘর্ষের সময়টাতে অন্ধকার নেমে এল চোখে -- কোনো নোটিস না দিয়ে আচমকা ঘুমিয়ে পড়ার মতো। 

হঠাৎ চেতনা ফিরে পেল সে। চার-পাঁচজন তরুণ মোটর সাইকেলের নিচ থেকে টেনে বের করছে তাকে। লবণ আর রক্তের স্বাদ পেল সে, ব্যথা করছে একটা হাঁটু। ওরা তাকে টেনে তোলার পর আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে -- ডান হাতে তাদের চাপ সহ্য করতে পারছিল না। উৎফুল্ল কয়েকটি কণ্ঠস্বর কানে এল, কেউ মশকরা করছে, কেউবা আশ্বস্ত করছে -- কোনোটিই তাকে ঘিরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর বলে মনে হলো না। একমাত্র সান্ত্বনা হয়ে এল একটি কণ্ঠস্বর, যা তাকে জানাল, সড়কবাতি তার অনুকূলেই ছিল। তীব্র একটা বমিভাব কণ্ঠা বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছিল, সেটিকে ঠেলে নিচে পাঠানোর চেষ্টা করতে করতে মহিলাটির কথা জানতে চাইল সে। চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থাতে চ্যাংদোলা করে কাছের একটা ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়া হল তাকে, সেখানেই সে জানল, যে মহিলার কারণে দুর্ঘটনা তার পা সামান্য ছড়ে যাওয়া খারাপ কিছু ঘটেনি। ‘আসলে তোমার সঙ্গে হালকা একটু ঘষা খেয়েছে সে, তবে ধাক্কাটার কারণে তোমার যন্ত্রটা লাফ দিয়ে একপাশে পড়ে গেছে ...।’ মতামত, পুরনো দুর্ঘটনার স্মৃতিচারণ, ‘কোনো ব্যাপারই না এটা’, ‘আগে ওর ঘাড় মালিশ করো, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওখানটায়’ ... ছোট ফার্মেসিটার ছায়াচ্ছন্ন অভ্যন্তরে ডাস্ট কোট পরা কেউ একজন স্নায়ুকে ঠান্ডা করার মতো কিছু একটা এক চুমুক খাইয়ে দিল তাকে। 

মিনিটপাঁচেকের মধ্যেই চলে এল পুলিশের অ্যাম্বুলেন্স। নরম একটা স্ট্রেচারে তুলে নিল তারা তাকে। সোজা হয়ে শুতে পেরে বড় আরাম লাগল। মাথা এখন পুরোপুরি পরিষ্কার, যদিও বুঝতে পারছে, কঠিন একটা ধাক্কার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কাজ করছে তার ওপর। অ্যাম্বুলেন্সে সাথে থাকা পুলিশটিকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিল। হাতে এখন আর ব্যাথা বলতে গেলে নেই-ই, ভ্রুর ওপর একটা ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে সারা মুখে। এক কি দু’বার চেটে ওটা খেয়ে নিল। সব মিলিয়ে খুব যে খারাপ লাগছিল তা নয়, একটা দুর্ঘটনাই তো, কয়েক হপ্তা বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। মোটর সাইকেলের অবস্থা খুব একটা খারাপ না, পুলিশ প্রহরীটি জানাল। ‘খারাপ কেন হবে, ব্যাটা সরাসরি আমার ওপর পড়েছে,’ বলল সে। দুজনেই হেসে উঠল এ কথায়। হাসপাতালে পৌঁছার পর হাত মিলিয়ে তার সৌভাগ্য কামনা করল প্রহরী। 

বমির ভাবটা ফিরে আসছে ধীরে ধীরে, ওদিকে চাকা লাগানো একটা স্ট্রেচারে করে হাসপাতাল ভবনের পেছন দিকে আরেকটা ভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাকে। গাছে গাছে কিচির-মিচির করছে পাখির দল, তার নিচ দিয়ে যেতে যেতে চোখ বন্ধ করে ভাবল, এ সময় ঘুমিয়ে পড়লে বা ক্লোরোফর্ম দেয়া থাকলে মন্দ হত না। সেটা ঘটল না অবশ্য। হাসপাতালের গন্ধে ভরা একটা কক্ষে বেশ খানিকক্ষণ রেখে দেয়া হলো তাকে, একটা ফরম পূরণ করতে হলো, আগের পোশাক খুলে খসখসে, ধূসর একটা আলখেল্লা পরানো হলো। তার হাতটাকে সাবধানে নাড়ল তারা, তবে ব্যাথাবোধ হলো না কোনো। নার্সগুলো একটার পর একটা চালাক-চালাক মন্তব্য করছে, পেট মোচড়ানোর অনুভূতিটা না থাকলে ভালো, রীতিমতো সুখীই বোধ করত সে। 

এক্সরে মেশিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে; মিনিটবিশেক পর, কালো একটা সমাধিফলকের মতো এক্সরের ভেজা-ভেজা নেগেটিভটা বুকের ওপর রাখা অবস্থাতেই ঠেলে সার্জারিতে নিয়ে গেল তাকে। সাদা পোশাক পরা লম্বা, সিঁড়িঙ্গেমতো একটা লোক এসে এক্সরের ছবিগুলো দেখতে লাগল। একটা মহিলার হাত তার মাথাটাকে ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করছে। টের পেল, এক স্ট্রেচার থেকে আরেকটাতে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। সাদা পোশাক পরা লোকটা আবার এল, মুখে হাসি। লোকটার ডান হাতে ঝিলিক দিয়ে উঠল কিছু একটা। হালকা করে তার গালে চাপড় দিল লোকটা, তারপর পেছনে দাঁড়ানো কাউকে কী যেন ইঙ্গিত করল। 

ব্যাপারটাকে স্বপ্ন বলে মেনে নেয়ার সমস্যা হচ্ছে, প্রচুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এবং স্বপ্নে সে এর আগে কখনো গন্ধ পায়নি। প্রথমে এল কাদাটে একটা গন্ধ, পথের বামদিকে জলাভূমির অস্তিত্ব এরই মধ্যে টের পাচ্ছে, দিনরাত কাঁপতে থাকা এই ডোবা থেকে কেউ কখনও ফিরে আসে না। তবে পচা গন্ধটা চলে যাচ্ছে, তার বদলে এখন অনেক কিছুর মিশেলে গাঢ়, তাজা একটা ঘ্রাণ আসছে -- ঠিক সেই রাতের ঘ্রাণের মতো, আজটেকদের কাছ থেকে পালানোর জন্য যে রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াত সে। স্বাভাবিক, পালাতেই হতো তাকে, মানুষশিকারে বেরিয়েছে আজটেকরা। তার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে জঙ্গলের গভীরতম অংশে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করা, আর কিছুতেই সেই সংকীর্ণ অরণ্যপথটি হারিয়ে না ফেলা যার সন্ধান জানে কেবল তারা, মটেকারা। 

দুর্গন্ধটিই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিল। যেন, স্বপ্নটাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়ার পরও এমন কিছু একটা গোটা ব্যাপারটাকে মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল যেটি তার স্বভাবগত নয়, যা ঠিক সেই মুহূর্তটির আগ পর্যন্ত এ খেলায় অংশও নেয়নি। ‘যুদ্ধের গন্ধ আছে এতে,’ ভাবল সে। অবচেতনভাবেই হাত চলে গেল উলের কোমরবন্ধে গোঁজা পাথরের ছুরিটাতে। অপ্রত্যাশিত একটা শব্দ কানে আসতেই ঝটতি মাথা নুইয়ে উবু হল, শরীরটা স্থির, তবে কাঁপছে। সে যে ভয় পাচ্ছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই, তার স্বপ্ন ভয়ে পরিপূর্ণ। অপেক্ষায় থাকল সে, লতানো গাছের একটা ডাল আর নক্ষত্রহীন রাত ঘিরে আছে তাকে। বহুদূরে, সম্ভবত বিশাল হ্রদটির ওপারে, ছাউনির পাশে আগুন জ্বেলেছে তারা -- আগুনের আভায় লাল হয়ে আছে ওখানকার আকাশ। শব্দটা ঐ একবারই হয়েছে, অনেকটা ডাল ভাঙার শব্দের মতো। হয়তো তারই মতো কোনো পশু যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে পালাচ্ছিল। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, বাতাসে গন্ধ শুঁকছে। চারদিক শুনশান, তবে আতঙ্কটা এখনও পিছু ধাওয়া করছে, ধাওয়া করছে গন্ধটাও -- ফুলের যুদ্ধের (আজটেক ও তাদের প্রতিপক্ষদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দিদের উৎসর্গ করা হতো দেবতার উদ্দেশে) ক্লান্তিকর সেই গন্ধ। জলা জায়গাটাকে এড়িয়ে বনের গভীরে ঢুকতে হলে আরও সামনে এগোতে হবে। অন্ধকারে পথ হাতড়ে আর খানিক পরপর কাদা ছুঁয়ে রাস্তার নিশানা নিয়ে কয়েক পা এগোলোও সে। সবচেয়ে ভালো হতো দৌড়াতে পারলে, কিন্তু ঘড়ঘড় শব্দ করা জলাজঙ্গল দু-পাশ থেকে চেপে ধরতে চাইছে। কালিগোলা অন্ধকারে পথের নিশানা খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করল সে, হঠাৎ ভয় জাগানিয়া উৎকট সেই গন্ধের একটা ঝাপটা এসে নাকে লাগল আর মরিয়া হয়ে আগে বাড়ল সে। 

‘লাফালাফি বন্ধ করো বাছা, পড়ে যাবে বিছানা থেকে,’ পাশের বিছানার রোগীটি বলল। 

চোখ খুলল সে। এখন বিকেল, হাসপাতালের লম্বা ওয়ার্ডের বিরাট জানালা দিয়ে সূর্যটাকে ঝুলতে দেখল দিগন্তের কাছাকাছি। প্রতিবেশি লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করতে করতে খানিক আগে দেখা দুঃস্বপ্নটির শেষ দৃশ্য থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করল প্রাণপণ। প্লাস্টারের একটা খাঁচায় বাধা তার হাত, ভার আর কপিকল লাগানো একটা যন্ত্র থেকে ঝুলছে সেটি। তৃষ্ণা লাগছে, যেন মাইলের পর মাইল দৌড়েছে। তবে ঠোঁট আর গলা ভেজাতে যতটুকু লাগে তার চেয়ে বেশি পানি তাকে দেয়া হয় না এখানে। ধীরে ধীরে বাড়ছে জ্বরটা। চাইলে ঘুমাতে পারে সে, তবে নিজেকে জাগিয়ে রাখা আর আধবোঁজা চোখে অন্য রোগীদের আলাপচারিতা শোনা ও মাঝেমধ্যে দু-একটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার এ আনন্দটা উপভোগ করছে। 

ছোট একটা ঠেলাগাড়ি এসে দাঁড়াল বিছানার পাশে। সোনালীচুলো এক নার্স তার উরুর সামনের অংশ ঘষল অ্যালকোহল দিয়ে, তারপর মোটা একটা সূঁই ফোটাল। সুঁইটা একটা টিউবের সঙ্গে লাগানো, টিউবের শেষ মাথায় ঘোলাটে, বহুবর্ণিল তরলে ভরা একটা বোতল। ধাতু আর চামড়ার তৈরি কয়েকটা যন্ত্র নিয়ে ঢুকল তরুণ এক শিক্ষানবিশ ডাক্তার, যন্ত্রগুলোকে তার ভালো হাতটার ওপর বসিয়ে কিছু একটা পরীক্ষা করল। রাত নেমেছে ততক্ষণে। জ্বরটা ধীরে ধীরে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল তাকে, যখন সব কিছু হয়ে যায় অপেরার কাচের মধ্য দিয়ে তাকানোর মতো অস্বচ্ছ -- বাস্তব আর কোমল বটে, খানিকটা বিস্বাদও। একঘেয়ে একটা চলচ্চিত্র দেখার সময় যেমন মনে হয়, রাস্তায় বেরোনো তো এর চেয়েও বিরক্তিকর হবে, তার চেয়ে এখানেই বসে থাকা যাক -- এটাও অনেকটা তেমনি। 

লিক, সেলারি আর পার্সলের গন্ধে ভরা সোনালি রঙের দারুণ স্বাদের একটা সুরুয়া এল। ছোট এক টুকরো রুটি -- গোটা একটা ভোজের চেয়েও দামি মনে হলো যাকে -- ভেঙে টুকরো টুকরো হলো। হাতে বলতে গেলে কোনো যন্ত্রণাই নেই, কেবল ভ্রু-তে, সেলাই পড়েছে যেখানটাতে, মাঝেমাঝেই ঝিলিক মারছে একটা ব্যাথা। কাছের বড় জানালাগুলো যখন ছোপ ছোপ কালচে নীল রঙে ভরে গেল, তার মনে হলো, ঘুমানোটা খুব একটা কঠিন হবে না। তখনও চিৎ হয়ে শোয়া সে, খুব একটা আরামদায়ক নয় ভঙ্গিটা। শুকনো, গরম ঠোঁটে জিহ্বা বোলাল, সুরুয়াটার আস্বাদ পাচ্ছে এখনও। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে, তারপর নিজেকে হারিয়ে যেতে দিল ঘুমের রাজ্যে। 

প্রথমে এক ধরনের বিভ্রম, যেন কেউ একজন তার ভোঁতা আর গুলিয়ে যাওয়া সব অনুভূতিকে নিজের ভেতর টেনে নিচ্ছে। বুঝতে পারল, দিকচিহ্নহীন অন্ধকারে ভোঁ দৌড়াচ্ছে সে, যদিও মাথার ওপর গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাওয়া আকাশটা বাকি সব কিছুর চেয়ে কম অন্ধকারাচ্ছন্ন। ‘রাস্তা,’ ভাবল সে, ‘এখন আর রাস্তায় নেই আমি।’ ঝরে পড়া পাতা আর কাদায় দেবে যাচ্ছে গোড়ালি; পা বাড়াতেই পাঁজরে আর পায়ে চাবুকপেটা করছে দু-পাশের লতানো গাছের ডাল। দম ফুরিয়ে আসছে। মৃত্যুর মতো এক অন্ধকার আর নীরবতা চারপাশে, তবে বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না, সবদিক থেকেই ঘেরাও হয়ে আছে সে। উবু হয়ে বসে কান খাড়া করল। পথটা হয়ত খুব কাছেই, দিনের আলো ফুটলেই সব দেখা যাবে, কিন্তু এ মুহূর্তে পথ খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই কোনো। ছুরির হাতল আঁকড়ে রাখা হাতটি নিজের অজ্ঞাতেই জলাভূমির কাঁকড়াবিছের মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেল গলায়, যেখানে সুরক্ষাদানকারী মাদুলিটি ঝুলছে। ঠোঁটদুটো নড়ছে কি নড়ছে না বোঝা দুষ্কর, বিড়বিড় করে ‘কর্ন’-এর মন্ত্র আওড়াল সে, যা উপকারী চাঁদকে বের করে আনে। আর প্রার্থনা করল মহা-মহামান্যের কাছে, মটেকান জাতির সব সহায়-সম্পদের মালিক একমাত্র যিনি। গোড়ালি ছাড়িয়ে কাদায় দেবে যেতে শুরু করেছে পা দুটো, জীবন্ত ওক গাছের এই অচেনা জঙ্গলে নিকশ অন্ধকারের মধ্যে আটকে থাকার অনুভূতিটা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। 

নতুন চাঁদ ওঠার পর থেকে গত তিনরাত-তিনদিন ধরে চলছে ফুলের যুদ্ধ। যদি জলাভূমি পার হয়ে আরো কিছু দূরে পথ ছেড়ে ঘন জঙ্গলে লুকাতে পারে তাহলে যোদ্ধারা তার পদচিহ্ন খুঁজে না-ও পেতে পারে। এরই মধ্যে তারা অগুনতি যেসব মানুষকে বন্দী করেছে তাদের কথা ভাবল সে। সংখ্যায় অবশ্য কিছু যায় আসে না, গুরুত্বপূর্ণ হল পবিত্র সময়। পুরোহিতদের ইশারা পাওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ শিকার চলতেই থাকবে। সংখ্যা আর সীমা আছে সবকিছুরই -- পবিত্র সময় এখনও চলছে আর সে-ও আছে শিকারীদের ঠিক উল্টোদিকে। 

হঠাৎ হৈ হল্লার শব্দ কানে এল, ছুরি বাগিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দিগন্তজুড়ে আগুনের আভায় লাল হয়ে আছে আকাশ। খুব কাছেই, গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে মশালের আলোর ছুটোছুটি চোখে পড়ল। যুদ্ধের অসহ্য গন্ধ ধাক্কা মারছে নাকে। শত্রুদের প্রথম জন যখন তার কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে লাফ দিল, লোকটার বুকের মধ্যে ছোরাটা আমূল ঢুকিয়ে দিয়ে একধরনের সুখানুভূতি হল। ততক্ষণে তাকে ঘিরে ফেলেছে আলোর দেয়াল আর রণ-উল্লাস। দু-একবার বাতাসে ছুরি চালানোর সুযোগ পেল সে, তারপরই পেছন থেকে একটা দড়ি এসে আটকে ফেলল তাকে। 

‘জ্বরের কারণে,’ পাশের বিছানার লোকটি বলল। ‘ডুয়োডেনামে (ক্ষুদ্রান্ত্রের উপরের অংশ) অপারেশনের পর একই অবস্থা হয়েছিল আমারও। পানি খাও একটু, দেখবে ঘুম এসে যাবে আবার।’ যে রাত থেকে এইমাত্র ফিরে এসেছে তার বিপরীতে হাসপাতালের ওয়ার্ডের ছায়া-ছায়া, ঈষদুষ্ণ পরিবেশকে রীতিমতো আনন্দময় মনে হলো। দূরের দেয়ালে ঝোলানো বেগুনি রঙের একটা বাতি শুভাকাক্সক্ষীর মতো পাহারা দিচ্ছিল। এখানে ওখানে হালকা কাশি, গভীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আর আর নিচু গলায় আলাপচারিতার শব্দ। সবকিছুই মনোরম আর নিরাপদ ... কেউ পিছু ধাওয়া করছে না ... না, দুঃস্বপ্নটা সম্বন্ধে এমনকি ভাবতেও চায় না সে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার মতো আরো বহু কিছু আছে। হাতের প্লাস্টারের দিকে তাকাল, হাতটাকে এমন আরামদায়কভাবে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছে যে কপিকলটা, তাকাল সেটির দিকেও। পাশের টেবিলে এক বোতল পানি রেখে গেছে তারা। যেন মহামূল্য কোনো পানীয় খাচ্ছে এমনভাবে ঢক ঢক করে পানি ঢালল গলায়। 

ওয়ার্ডের কোথায় কী আছে ঠাহর করতে পারছে সব এখন। গোটা ত্রিশেক বিছানা, কাচের দরজা লাগানো আলমারি, সব। মনে হল জ্বরটা পড়েছে, ঠান্ডা লাগছে মুখটা। ভ্রুর ওপরের ক্ষতটায় হালকা একটু ব্যাথা আছে কেবল, পুরনো স্মৃতির মতো। মনের চোখে নিজেকে ফের হোটেল থেকে বেরোতে দেখল, দেখল মোটরসাইকেল চালাতে। শেষটা এমন হবে, কে জানত! দুর্ঘটনার মুহূর্তটাকে নির্ভুলভাবে ধরার চেষ্টা করল সে, কিন্তু একটা শূন্যস্থান আছে কোথাও, ফাঁকা একটা জায়গা যেটিকে কিছুতেই পূরণ করা যাচ্ছে না। ভাবনাটা ক্ষোভ জাগাল মনে। ধাক্কাটা যখন লাগল তখন এবং ফুটপাথ থেকে তুলে নেয়া, তারপর চেতনা হারানো বা তারও পর যা-যা ঘটেছে -- এ দুয়ের মাঝে কিছুই দেখতে পেল না সে। অথচ এই শূন্যতা, এই কিছুই না থাকার বোধটা ছিল অনন্তকালের সমান। না, প্রশ্নটা সময়ের নয়, বরং ব্যাপারটা যেন এমন, সেই শূন্যতার মধ্যে কিছু একটা অতিক্রম করেছে সে, বা অতীতে, অপরিমেয় কোনো দূরত্বে ফিরে গেছে। সেই ধাক্কা, ফুটপাথের সঙ্গে সজোরে ঘষা। ঘটনা যাই হোক, লোকজন যখন তাকে মাটি থেকে তুলে ধরছিল তখন অন্ধকার গহ্বর থেকে ফিরে আসার অনুভূতিটা বিশাল একটা স্বস্তি হয়ে এসেছিল। ভাঙ্গা হাতের যন্ত্রণা, কেটে যাওয়া ভ্রু থেকে ঝরা রক্ত, ছড়ে যাওয়া হাঁটু, এসব সত্ত্বেও সূর্যের আলো আর দিনের কাছে ফিরে আসা, জীবনকে আবার চলতে দেখা এবং অন্যের যত্ন পাওয়া -- বড় শান্তির ছিল এসব। একটু অদ্ভুত ব্যাপারটা। কোনো একদিন অফিসের ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এ সম্বন্ধে। এদিকে আবার জেঁকে বসতে শুরু করেছে পরাক্রান্ত ঘুম, যেন নিচের দিকে টানছে ক্রমশ। বালিশটা নরম, জ্বরাক্রান্ত কণ্ঠনালীতে পানির স্পর্শটাও বড় ঠান্ডা। বাতির বেগুনি আলোটা কেবলই ম্লান থেকে ম্লানতর হচ্ছে। 

যেহেতু চিৎ হয়েই ঘুমাচ্ছিল সেহেতু সে অবস্থাতেই নিজেকে আবিষ্কার করে মোটেই অবাক হল না, তবে পাথরের সোঁদা গন্ধ যেন কণ্ঠনালী আটকে বিশেষ কিছু একটা উপলব্ধি করতে বাধ্য করছে তাকে। চোখ খোলো আর তাকাও এদিক-ওদিক -- যদিও চেষ্টাটা পুরোপুরি নিষ্ফল। গভীর, দিকচিহ্নহীন এক অন্ধকার ঘিরে আছে তাকে। উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, দড়ির শক্ত বাঁধন এঁটে বসে আছে হাত আর পায়ে। স্যাঁতসেতে আর বরফশীতল পাথুরে মেঝের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। অনাবৃত পিঠ আর পায়ে কামড় বসাচ্ছে ঠান্ডা। থুতনি দিয়ে মাদুলিটা স্পর্শ করার চেষ্টা করে দেখল, খুলে নেয়া হয়েছে ওটা। তার মানে আর আশা নেই কোনো, কোনো প্রার্থনাই চূড়ান্ত পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারবে না তাকে। যেন ভূগর্ভস্থ কক্ষটির পাথুরে দেয়াল ফুঁড়ে ভেসে এল দূরাগত ঢাকের আওয়াজ। উৎসবের ঢাক! মন্দিরে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে, টেওকালির ভূগর্ভস্থ গারদে আছে এখন, অপেক্ষা করছে কখন তারা পালা আসবে। 

একটা চিৎকার শুনতে পেল, পাথুরে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা ফ্যাঁসফ্যাসে একটা চিৎকার। ঐ তো, আবারও, তারপর কেবল গোঙানি। আসলে এ চিৎকার তারই, কারণ এখনও বেঁচে আছে সে, তীব্র আর্তনাদ করে অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটিকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে সমস্ত শরীর। মাটির নিচের অন্য কক্ষগুলোতে আটকে থাকা বন্ধুদের কথা ভাবল সে, উৎসর্গ করার জন্য সিঁড়ি ভেঙে যাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভাবল তাদের কথাও। আরেকটি রুদ্ধশ্বাস চিৎকার বেরিয়ে এল গলা চিরে, মুখটা কোনোমতে কেবল ‘হা’ করতে পারছে। চোয়ালদুটো এমনভাবে পেছনে বেঁকে আছে, যেন রশি আর লাঠি দিয়ে টেনে রাখা হয়েছে ওগুলোকে। মাঝে মাঝে, যেন বা প্রবল চেষ্টায়, সামান্য একটু ফাঁক হচ্ছে চোয়াল, দেখে মনে হবে রাবার দিয়ে তৈরি ওটা। দরজার কাঠের খিল সরানোর ক্যাঁচকোচ শব্দ চাবুকের মতো আঘাত করল। চামড়া কেটে বসে যাওয়া রশির বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রয়াস চালাল শরীর মুচড়ে। জোর বেশি যাতে, সেই ডান হাতটিকে টানটান করে চেষ্টা করল বাঁধন ছেড়ার, কিন্তু যন্ত্রণাটা এমন অসহ্য হয়ে উঠল যে বাধ্য হল ক্ষান্ত দিতে। বিশাল দরজাটাকে খুলে যেতে দেখল সে, আলোর দেখা পাবার আগেই মশালের গন্ধ এসে পৌঁছুল নাকে। কোমরবন্ধ দিয়ে আটকানো কৌপীন পরা পুরোহিতদের সহচরেরা -- দৃষ্টিতে রাজ্যের ঘৃণা -- এগিয়ে এল তার দিকে। তাদের ঘামে ভেজা শরীর আর পালক গোঁজা কালো চুলে আলো ঠিকরে পড়ে চিকচিক করছে। দড়ির বাঁধন আলগা হল, তার জায়গা নিল লোহার মতো শক্ত আর উষ্ণ হাত। চিৎ করে ধরা অবস্থাতেই উপরে ওঠানো হচ্ছে তাকে, অনুভব করল। লম্বা বারান্দা ধরে হনহন করে তাকে নিয়ে চলল চারজন, তাদের সামনেই মশালবাহকেরা, মশালের আলোয় দুপাশের ভেজাটে দেয়াল আলোকিত হয়ে আছে। মাথার উপরের ছাদটা এতই নিচু যে তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া লোকগুলোকে মাথা নিচু করে রাখতে হচ্ছে। এবার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, বাইরে -- মানে পথের শেষ এখানেই। চিৎ হয়ে শুয়ে সে, যতদূর চোখ যায় মাথার ওপর জীবন্ত পাথর -- মুহূর্তের জন্য ঝিকমিকিয়ে উঠল সেগুলো মশালের আলো পড়ে। তারপর একসময় পাথুরে ছাদের বদলে তারার আলো দেখা গেল মাথার ওপর, আর সামনে সিঁড়ির চওড়া সব ধাপ। চারদিকে চিৎকার আর রণনৃত্য, তাহলে পথের শেষ এখানেই! মনে হচ্ছিল লম্বা বারান্দাটা কখনোই শেষ হবে না, কিন্তু শেষ হতে শুরু করেছে এবার, কিছুক্ষণের মধ্যেই অনন্ত নক্ষত্ররাজি ভরা আকাশ দেখবে মাথার ওপর, তবে এখনই নয়। লালচে ছায়ার মধ্য দিয়ে অন্তহীন এক ভ্রমণে যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, এ ভ্রমণে মোটেই সায় নেই তার, কিন্তু কীভাবে আটকাবে তাদের, তার মাদুলিটা যে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে -- তার সত্যিকারের হৃৎপিণ্ড জীবনাভূতির কেন্দ্র, মাদুলিটা! 

এক লাফে হাসপাতালের রাতে ফিরে এল সে। ফিরে এল উঁচু, সৌম্য, নগ্ন ছাদ আর তাকে জড়িয়ে ধরা নরম ছায়ার কাছে। মুখ দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এসেছিল কী? প্রতিবেশিরা অবশ্য পরম শান্তিতে নাক ডাকছে। পাশের টেবিলে রাখা বোতলের পানি কিছুটা বুদ্বুদময়, জানালার ঘন নীল ছায়ার বিপরীতে আধা-স্বচ্ছ দেখাচ্ছে বোতলটাকে। হাঁফাচ্ছে সে, ফুসফুসটাকে আরাম দেয়ার ফুরসৎ খুঁজছে, সেই ছবিগুলোকে ভুলে যাওয়ার তাড়না চোখের পাতার সাথে আটকে আছে এখনও। প্রতিবার চোখ বন্ধ করলেই জীবন্ত হয়ে উঠছে সেগুলো, ধড়মড় করে উঠে বসছে সে, জীবনীশক্তি পুরোপুরি নিঃশেষিত। তবে সে যে জেগে আছে, বেল বাজালেই রাতের নার্স এসে হাজির হবে, খানিক পরই দিনের আলো ফুটবে, এ সময়টাতেই সবচেয়ে গভীর ঘুমটা হয় তার, কোনো ছবি নেই সে ঘুমে, কিছুই নেই -- এ ভাবনাটাও উপভোগ্য। 

চোখ দুটো খুলে রাখা কঠিন হচ্ছে -- তার নিজের চেয়েও শক্তিশালী এই তন্দ্রাচ্ছন্নতা। শেষবারের মতো চেষ্টা করল সে। পানিভর্তি বোতলের দিকে ছুঁড়ে দিল ভালো হাতটা, তবে পৌঁছানো গেল না সে অব্দি। কালো এক শূন্যতার মধ্যে খাবি খেল ব্যর্থ আঙ্গুলগুলো, ওদিকে মন্দিরের বারান্দা ধরে অন্তহীন যাত্রার যেন শেষ নেই। পাথর, তারপর আরো পাথর, মাঝেমাঝে ঝলক দিচ্ছে লালচে আভা। শেষ হয়ে আসছে মাথার ওপরের ছাদ, দেখে চাপা একটা গোঙানি বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। উপরে উঠছে ছাদটা, ‘হা’ করছে ছায়ান্ধকার এক মুখগহ্বরের মতো। কুঁজো শরীরটাকে এবার সোজা করছে তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলো। অনেক উপর থেকে, চাঁদের ম্লান আলো এসে পড়ছে একটা মুখের ওপর যার চোখগুলো দেখতে চাইছে না চাঁদকে -- বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ও দুটো -- আবারও ওপারে, হাসপাতালের ওয়ার্ডের নগ্ন ছাদের নিচে আশ্রয় নিতে চাইছে। চোখ খুললেই দৃষ্টিসীমায় রাত আর চাঁদ, চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠেই চলেছে তারা, মাথাটা এখন পেছনে হেলানো, ঝুলছে। সিঁড়ির মাথায় আগুন জ্বলছে, সুগন্ধী রক্তাভ ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে উপরে। হঠাৎই লাল পাথরটা চোখে পড়ল। চুঁইয়ে পড়া রক্ত আর এর আগে যে হতভাগ্যকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে উত্তরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তার পায়ের আঁকিবুকি জ্বলজ্বল করছে পাথরের গায়ে। মনের সমস্ত আশা একত্র করে প্রাণপণে চোখদুটো বন্ধ করল সে, গোঙাচ্ছে জেগে ওঠার আশায়। এক লহমার জন্য মনে হল ফিরে যেতে পেরেছে সে -- নিশ্চল হয়ে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখল বিছানায় -- কিন্তু মাথাটা ঝুলছে বিছানা থেকে, আর নড়ছে এদিক-ওদিক। মৃত্যুর গন্ধ এসে লাগছে নাকে, চোখ খুলে উদ্যত পাথুরে-ছুরি হাতে এগিয়ে আসা আততায়ী-পুরোহিতের রক্ত-জবজবে শরীরটা চোখে পড়ল। কোনোমতে চোখদুটো বন্ধ করল, যদিও জানে, আর জেগে উঠবে না সে -- জেগেই আছে। অন্য যে জাগরণ সেটি আসলে মোহময় এক স্বপ্ন, অদ্ভুতুড়ে -- স্বপ্নেরা যেমন হয়; যে স্বপ্নে বিস্ময়কর এক শহরের অদ্ভুত রাস্তা ধরে যাচ্ছিল সে, দু’পায়ের ফাঁকে গরগর করতে থাকা বিশাল এক ধাতব পোকায় আগুন বা ধোঁয়া ছাড়াই জ্বলছিল লাল-নীল বাতি। স্বপ্নের সেই অন্তহীন মিথ্যায় মাটি থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল তাকে, এমনকি ছুরি হাতেও এগিয়ে এসেছিল কেউ একজন, তার দিকে -- যে এখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে -- চিৎ হয়ে -- তার দু’পাশে পাথুরে সিঁড়ির ধাপে আগুনের উৎসব।





অনুবাদক
মোস্তাক শরীফ
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ