অনুবাদঃ শামীম মনোয়ার
(১)
দুর্ভাগ্য সেই পুরুষের, যিনি একজন নারীকে ভালবেসে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, শরীরের ঘাম ও রক্ত পদতলে ঢেলে দেওয়ার মত পরিশ্রমের উপার্জন তার হাতে তুলে দিয়েছেন; কিন্তু যখন তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠে আস্তে আস্তে দেখার মত জানতে পারেন, যে হৃদয়টি তিনি কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা লুকানো এক গোপনীয় গভীর ভালবাসা উপভোগ করার জন্য অন্য ব্যক্তিকে নির্দ্বিধায় বিনামূল্যে এবং আন্তরিকতার সাথে তুলে দেওয়া হয়েছে।
দুর্ভাগ্য সেই নারীর যিনি যৌবনের অযত্ন অস্থিরতায় বেড়ে উঠেছেন এবং হঠাৎ এমন এক পুরুষের আবাসে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন যে তাকে ঝলমলে স্বর্ণ ও মহামূল্যবান উপহারের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করাচ্ছেন এবং তাকে সমস্ত সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেছেন কিন্তু তাঁর আত্মাকে সন্তুষ্ট করতে অক্ষম, স্বর্গীয় মদিরায়, যা ঈশ্বর ঢেলে দেন কোন একজন পুরুষের চোখ থেকে একজন নারীর হৃদয়ে ।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই রশিদ বে নামানকে চিনতাম; তিনি ছিলেন লেবানীজ, জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বৈরুতে। একটি পুরোনো সমৃদ্ধশালী পরিবারের সদস্য । তিনি তার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ও গৌরব রক্ষা করে চলতেন। রশিদ কথাবার্তায় তাঁর পিতৃপুরুষদের আভিজাত্যের সাথে সম্পর্কিত ঘটনাগুলিকে উদ্ধৃত করতে পছন্দ করতেন। তাঁর রুটিন মাফিক জীবনে তিনি তাদের বিশ্বাস ও রীতিনীতি অনুসরণ করতেন যা সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ছিল।
রশিদ বে নামান ছিলেন উদার এবং আন্তরিক মনের মানুষ।তবে তিনি অনেক সিরিয়ানদের মতোই বাস্তবতার পরিবর্তে কোন কিছুর বাইরের দিকটার দিকেই বেশি নজর দিতেন। তিনি কখনই তাঁর হৃদয়াবেগ দ্বারা চালিত হতেন না, তার আশেপাশের পরিবেশের কণ্ঠস্বরের চাহিদাগুলি মানতেই যেনো ব্যস্ত থাকতেন। তিনি বর্ণিল বিষয়গুলিতে আনন্দ উপভোগ করতেন যা তার চোখ ও হৃদয়কে জীবনের গোপনীয় বিষয়গুলির প্রতি নজর দিতে অন্ধ করে দিয়েছিল; তাঁর আত্মাকে প্রকৃতির নিয়মগুলি বোঝার থেকে দুরে রেখে একটি অস্থায়ী আত্মতৃপ্তির আবাসে পরিণত করেছিল। তিনি সেইসব লোকদের মধ্যে একজন ছিলেন যারা লোকদের প্রতি তাদের ভালবাসা বা ঘৃণা প্রকাশ করতে তড়িঘড়ি করে ফেলে, কিন্তু যখন তাদের তা পূণরায় স্মরণে আসে তখন তারা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়। তারপরে ক্ষমা বা অনুমোদনের পরিবর্তে লজ্জা এবং উপহাস এসে তাদেরকে ঘিরে ফেলে।
চরিত্রের এমন বৈশিষ্ট্যই যা রশিদ বে নামানকে প্ররোচিত করেছিল রোজ হ্যানিকে বিয়ে করতে, প্রকৃত ভালবাসার ছায়ায় আত্মাকে জড়িয়ে ধরার অনেক আগেই, যা মিলনকে এক স্বর্গ বানিয়ে তোলে।
কয়েক বছরের অনুপস্থিতির পর, আমি বৈরুত শহরে ফিরে আসি। আমি যখন রশিদ বে নামানকে দেখতে গেলাম, আমি তাকে ফ্যাকাশে এবং কৃশ দেখলাম। তাঁর মুখের দিকে তাকালে যে কেউ দেখতে পাবে সেখানে রয়েছে তিক্ত হতাশার অপচ্ছায়া; তার দু:খভারাক্রান্ত চোখ দুটো যেন তার চূর্ণ হৃদয় এবং ম্লান আত্মার কথা বলছে। আমি তার করুণ দুর্দশার কারণ খুঁজতে আগ্রহী হলাম; আমি তার ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা বোধ করলাম না, বললাম, "রশিদ তোমার কী হয়েছে? আশৈশব থেকে তোমার যে উজ্জ্বল হাসি এবং আনন্দদীপ্ত মুখ দেখেছি তা কোথায়? তোমার কাছ থেকে এসব কে কেড়ে নিয়েছে প্রিয় বন্ধু? কোন কালোরাত্রি কি তোমার শাদা দিনগুলির সঞ্চিত সোনা চুরি করে নিয়ে গেছে? বন্ধুত্বের নামে, আমাকে বলো, এই দুঃখ এবং শরীরের এ হালের কারণ কী? "
সে আমার দিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকাল, যেন আমি তাঁর কাছে সুন্দর দিনের কিছু নির্জন চিত্র পুনঃউপস্থাপিত করছি। পীড়িত ও কম্পমান কণ্ঠে সে প্রতিক্রিয়া জানাল, "যখন কোনও ব্যক্তি কোনও বন্ধু হারায়, সে তখন তার অন্যান্য অনেক বন্ধুর সাথে কথা বলে সান্ত্বনা খুঁজে পায় এবং যদি তার সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যায় তবে সে হয়তো কিছু সময়ের জন্য নিবিড় ভাবনায় তার মন থেকে সেই দুর্ভাগ্য সরিয়ে দেয়, বিশেষত যখন সে নিজেকে তখনও সুস্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভরপুর বলে মনে করে। কিন্তু যখন একজন মানুষ তার হৃদয়ের স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে ফেলে, তবে সে কোথায় সান্ত্বনা পেতে পারে এবং কী দিয়ে সে এটি প্রতিস্থাপন করতে পারে? তার মন এটাকে কিভাবে আয়ত্তে আনতে পারে? কখনও মৃত্যু নিকটবর্তী হলে কেউ হয়তো ভুগতে থাকে। কিন্তু সেইসব অশনী সংকেতের দিন এবং রাত পার হয়ে গেলে সে যখন জীবনের নরম আঙুলের মসৃণ স্পর্শ অনুভব করে; তখন সে হাসে এবং আনন্দ করে।
“নিয়তি হঠাৎ উদ্বেগ নিয়ে আসে; সে তোমার দিকে ভয়ঙ্কর চোখে তাকায় এবং তার তীক্ষ্ণ আঙুল দিয়ে গলা চেপে ধরে এবং তোমাকে মাটিতে ফেলে দেয় এবং লোহার মত পায়ের পাতা দিয়ে তোমাকে পদদলিত করে; তারপর সে হাসে এবং চলে যায় । তবে পরে সে তার ক্রিয়াকলাপের জন্য অনুশোচনা করে এবং তোমার কাছ থেকে ক্ষমা পাবার আশায় তোমার সৌভাগ্য কামনা করে। সে তার রেশমী হাত প্রসারিত করে তোমাকে উঁচুতে তোলে এবং তোমাকে আশার বাণীর গান শোনায় এবং জীবনের প্রতি তোমার যত্ন হারিয়ে ফেলার কারণ হয়ে দাড়ায়। সে আত্মবিশ্বাস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য তোমার মধ্যে নতুন একটি উদ্দীপনা তৈরি করে। যদি তোমার ভালবাসা খুব সুন্দর একটি পাখি হযে থাকে যা তুমি খুব পছন্দ কর, তবে তুমি আনন্দের সাথে তাকে তোমার অন্তরের বীজগুলি খাওয়াবে এবং তোমার হৃদয়কে তার খাঁচা এবং তোমার আত্মায় তার বাসা বানাবে। তুমি তাকে স্নেহের সাথে প্রশংসা করো এবং প্রেমের চোখে তাঁর দিকে তাকাও, তারপরও সে যদি তোমার হাত থেকে পালিয়ে খুব উঁচুতে উড়ে চলে যায়; তারপরে সে নেমে এসে অন্য কোন খাঁচায় প্রবেশ করে এবং কখনও তোমার কাছে যদি ফিরে না আসে তবে তুমি কি করতে পারো? তুমি কোথায় শোক প্রকাশ করতে পারো কোথায় সান্তনা পেতে পারো? তুমি কীভাবে তোমার আশা এবং স্বপ্নকে পুনরুদ্ধার করতে পারো? কোন শক্তি তোমার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে পারে? "
শব্দগুলি রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে কষ্টের সাথে উচ্চারিত হল, রশিদ বে নামান যেন এলোমেলো ঝড় হাওয়ার মধ্যে একটা খড়কুটোর মতো কাঁপছিল। সে যেনো হাত বাড়িয়ে আছে কোন কিছু আঁকড়ে ধরে বাঁচার আশায় কিন্তু তা দুরে সরে যাচ্ছে। তাঁর কুঁচকে যাওয়া মুখটি বিবর্ণ, কয়েক মুহুর্ত পলকহীন তাকিয়ে তাঁর চোখ যেনো বড় হতে লাগল, এবং মনে হচ্ছিল যেন তার ভিতরে কোনও অসুরকে দেখতে পাচ্ছি যা তার অস্তিত্ব থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে; অতঃপর সে আমার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ তার চেহারা বদলে গেল;
তাঁর ক্রোধ প্রবল দুর্দশা ও সঙ্কটে রূপান্তরিত হল, এবং সে চিৎকার করে বলতে লাগল, “এই সেই স্ত্রীলোক যাকে আমি দারিদ্র্যের ভয়াল কবল থেকে উদ্ধার করেছিলাম; আমি আমার সম্পদের ভান্ডার তাকে খুলে দিয়েছিলাম এবং তাকে সুন্দর পোশাক এবং মূল্যবান রত্ন এবং তাকে বহনকারী গাড়ীর জন্য দুর্দান্ত ঘোড়া দিয়েছিলাম যা দেখে সমস্ত নারীরা ঈর্ষা করত; যে নারীকে আমার হৃদয় দিয়ে ভালবাসতাম এবং যার পায়ে আমার স্নেহের আতিশয্য ঢেলে দিয়েছিলাম; সেই নারী, যার কাছে আমি একজন সত্যিকারের বন্ধু, আন্তরিক সহচর এবং বিশ্বস্ত স্বামী হতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সে মহিলা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং অন্য একজনের সাথে তার ভাগ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য এবং তার অশুভ রুটি খাওয়ার জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমার মাথা লজ্জায় অবনত করে দিয়েছে এবং অপমানের সাথে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমি যে মহিলাকে ভালবাসি; আমি যে সুন্দর পাখিটিকে আমি খাওয়াতাম এবং যার জন্য আমি আমার হৃদয়কে একটি খাঁচা এবং আমার আত্মাকে বাসা বানিয়েছিলাম, সে আমার হাত থেকে পালিয়ে অন্য খাঁচায় প্রবেশ করেছে; সেই শুদ্ধ স্বর্গ অপ্সরা, যে আমার স্নেহ এবং প্রেমের স্বর্গে বাস করেছিল, সে এখন আমার কাছে এক ভয়াবহ শয়তানী হিসাবে উপস্থিত হয়েছে, সে তার পাপের জন্য অন্ধকারে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তার অপরাধের জন্য আমাকে পৃথিবীতে কষ্ট দিচ্ছে। ”
সে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করল যেন নিজেকে নিজের থেকেই থেকে রক্ষা করতে চায় এবং এক মুহুর্তের জন্য নিরব হয়ে গেল। তখন সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তোমাকে কেবল এটিই বলতে পারি; দয়া করে আরও কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। আমার বিপর্যয়ের কান্নার কণ্ঠস্বর আর শুনতে চাইবে না, বরং এটি নিঃশব্দ দুর্ভাগ্য ; সম্ভবত এটি নিঃশব্দে বেড়ে উঠবে এবং আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে যাতে আমি শেষ পর্যন্ত শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারি ”।
আমার চোখে অশ্রু এবং হৃদয়ে করুণা নিয়ে আমি উঠে দাড়ালাম, এবং নিঃশব্দে তাকে বিদায় জানালাম; আমার কথায় তাঁর আহত হৃদয়কে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো শক্তি ছিল না, এবং আমার জ্ঞানের ভান্ডারে তার বিষণ্ণ আত্মাকে আলোকিত করার কোনও মশাল ছিল না।
(২)
এর কিছু দিন পরে আমি প্রথমবারের মতো ম্যাডাম রোজ হ্যানির সাথে দেখা করি, ফুল এবং গাছ দ্বারা ঘেরা একটি দরিদ্র কুটির।তিনি আমার সম্পর্কে রশিদ বে নামানের কাছে শুনেছিলেন, সেই লোকটি যার হৃদয় তিনি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন এবং জীবনের ভয়ঙ্কর খড়ের নীচে রেখেছিলেন। আমি যখন তার সুন্দর উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালাম এবং তার আন্তরিক কণ্ঠটি শুনতে পেলাম, তখন আমি নিজেকে বললাম, "এই কি সেই নারী হতে পারে? এই স্বচ্ছ মুখ কি কুরুচিপূর্ণ আত্মা এবং অপরাধী হৃদয়কে আড়াল করতে পারে? এই কি অবিশ্বস্ত স্ত্রী? এ কি সেই স্ত্রীলোক যার সম্পর্কে আমি মনে মনে খারাপ কথা বলেছি এবং একটি সুন্দর পাখির আকারে ছদ্মবেশে সর্প হিসাবে কল্পনা করেছি?” তারপরে আমি আবার ফিসফিস করে বললাম, “এই সুন্দর মুখই কি রশিদ বে নামানের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী? আমরা কি শুনিনি যে সুস্পষ্ট সৌন্দর্য হ'ল বহু লুকানো দুর্দশা এবং গভীর দুর্ভোগের কারণ? কি সুন্দর চাঁদ, যা কেবল কবিদের অনুপ্রেরণা জোগায় না, একই চাঁদ যা সমুদ্রের নীরবতাকে ভয়ঙ্কর গর্জনে পরিণত করে?
আমরা যখন বসেছিলাম, ম্যাডাম রোজ হ্যানিকে মনে হচিছল আমার চিন্তাভাবনা শুনছেন এবং পড়ছেন, তাই আমার সন্দেহগুলি দীর্ঘায়িত করতে চান না। তিনি হাতের উপর সুন্দর মাথাটি ঝুঁকালেন এবং তিনি লিরি বাঁশির শব্দের চেয়ে মিষ্টি স্বরে বললেন, “আপনার সাথে আমার কখনও সাক্ষাৎ হয় নি, তবে আমি মানুষের মুখ থেকে আপনার চিন্তাভাবনা এবং স্বপ্নের প্রতিধ্বনি শুনেছি এবং তারা আমাকে বলেছে যে আপনি করুণাময় এবং নিপীড়িত নারীদের কথা বুঝতে পারেন – সেই সব নারীদের হৃদয়ের গোপন বিষয়গুলি আপনি আবিষ্কার করেন এবং যাদের স্নেহের কথা আপনি জানেন। আমার হৃদয়ের পুরো বিষয়বস্তু আপনাকে আমার কাছে প্রকাশ করার অনুমতি দিন যাতে আপনি জানতে পারেন রোজ হ্যানি কখনই বিশ্বাসঘাতক মহিলা ছিলেন না।
“আমার বয়স তখন প্রায় আঠারো, তখন ভাগ্য আমাকে রশিদ বে নামানের দিকে নিয়ে যায়, যিনি তখন চল্লিশ বছর বয়সী। লোকেরা যা বলে, সে অনুসারে বলতে হয় তিনি আমার প্রেমে পড়েছিলেন এবং আমাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করেছিলেন এবং তিনি আমাকে সুন্দর পোশাক এবং মূল্যবান রত্ন দিয়ে আমাকে তাঁর আলীশান বাড়িতে রেখেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের কাছে বিরল কোন কিছু হিসাবে উপস্থাপন করতেন; যখন তাঁর সমসাময়িকেরা আমার দিকে অবাক হয়ে ও প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাত তখন তার মুখে ফুটে উঠতো বিজয়ের হাসি; যখন তিনি দেখতেন মহিলারাও আমার বিষয়ে বিষ্ময় সূচক প্রশংসা নিয়ে কথা বলছে তখন তিনি গর্বের সাথে তার চিবুক উঁচুতে তুলে কথা বলতেন। কিন্তু তিনি কখনই লোকজনের এরকম ফিসফিস শুনতে পান নি, 'এ কি রশিদ বে নামানের স্ত্রী, নাকি তাঁর পালিতা কন্যা?' এবং তাদের মন্তব্য, 'যদি সে সঠিক বয়সে বিয়ে করত, তবে তার মেয়ে রোজ হ্যানির চেয়ে বড় হত।'
“ইতিপূর্বে আমার জীবনের যা ঘটেছে তার সবই যৌবনের গভীর বিস্মরণ থেকে জাগ্রত হওয়ার আগে। ঈশ্বর আমার হৃদয়কে তৈরি করার পূর্বে হয়তো ভালবাসার মশাল দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। ভালবাসার বৃক্ষটি বড় হওয়ার পূর্বে বীজের মধ্যে স্নেহের সঞ্চার করেছিলেন। হ্যাঁ, এই সমস্ত ঘটেছিল সেই সময়কালে যখন আমি বিশ্বাস করতাম যে সত্যিকারের সুখ সুন্দর পোশাক এবং বিশাল অট্টালিকার মধ্যেই নিহিত।
আমি যখন কৈশোরের ঘুম থেকে জেগে উঠি, তখন আমি অনুভব করি যে আমার হৃদয়ে পবিত্র আগুনের শিখা জ্বলছে এবং আমার আত্মায় আধ্যাত্মিক ক্ষুধার উদগীরন হচ্ছে, তা আমাকে ভোগাচ্ছে। আমি যখন চোখ খুললাম, আমি দেখলাম আমার ডাইনে ও বায়ে দুলছে, ডানা প্রসারিত হওয়ার চেষ্টা করছে ভালবাসার দিগন্তে আরোহণের। কিন্তু আমার শরীর আইনের শিকলে একজন ব্যক্তির কাছে আবদ্ধ হওয়ায় তা কাঁপছে, যে আইন আমি ভালো করে বোঝায় আগেই তাতে বাধা পড়ে গেছি। আমি এই সমস্ত কিছু অনুভব করলাম এবং বুঝলাম যে একজন নারীর সুখ একজন পুরুষের গৌরব, সম্মান বা তার উদারতা এবং স্নেহের মাধ্যমে আসে না, তবে এমন ভালবাসার মধ্য দিয়ে আসে যা তাদের হৃদয় এবং স্নেহ উভয়কে এক করে দেয়, তাদেরকে জীবনদেহের এক অঙ্গ করে তোলে এবং যা ঈশ্বরের ঠোঁটের একটি শব্দ। সত্য যখন আমার কাছে নিজেকে প্রকাশ করল, তখন আমি নিজেকে রশিদ বে নামানের প্রাসাদে আইনের দ্বারা বন্দী অবস্থায় দেখতে পেলাম, যেমন একজন চোর রুটি চুরি করে রাতের অন্ধকার এবং সুবিধাজনক কোন কোণে লুকিয়ে আছে। আমি জানতাম যে তাঁর সাথে প্রতি ঘন্টা কাটানো ছিল আমার কপালে স্বর্গ এবং পৃথিবীর সামনে আগুনের চিঠিযুক্ত একটি ভয়ঙ্কর মিথ্যা। আমি তাঁর উদারতা এবং আন্তরিকতার জন্য তাকে আমার ভালবাসা এবং স্নেহ দিতে পারিনি। আমি তাকে ভালবাসার জন্য নিরর্থক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভালবাসা এমন একটি শক্তি যা আমাদের অন্তরকে তৈরি করে, কিন্তু আমাদের অন্তর সেই শক্তিকে তৈরি করতে পারে না। আমি ঈশ্বরের সামনে রাতের নীরবতায় প্রার্থনা পর প্রার্থনা করেছি যেন আমার অন্তরের গভীরতায় এমন একটি আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গ তৈরি হয় যা আমাকে সেই মানুষটির আরও কাছে নিয়ে যায়, যাকে আমার সমস্ত জীবনের সঙ্গী হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
“আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়নি, কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছায় প্রেম আমাদের আত্মার উপর নেমে আসে, ব্যক্তির চাহিদা বা আর্জি দ্বারা নয়। এইভাবে আমি সেই ব্যক্তির বাড়িতে দু'বছর রয়ে গেলাম, মাঠের দিকে তাকিয়ে পাখিদের স্বাধীনতা দেখে ঈর্ষা করছিলাম এবং যখন আমার বন্ধুরা আমাকে আমার বেদনাদায়ক সোনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ দেখে ঈর্ষা করছিল। আমি এমন এক মহিলার মতো ছিলাম যে তার একমাত্র সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে; বিলাপহীন হৃদয়ের মতো যা অস্তিত্ব ছাড়াই বিদ্যমান; মানব আইনের তীব্রতার নিরীহ শিকার হয়ে। আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা ও ক্ষুধা থেকে আমি মৃত্যুর কাছাকাছি ছিলাম।
“এক অন্ধকার দিনে, আমি ভারী আকাশের পিছন থেকে তাকিয়ে দেখার মত দেখলাম, এমন এক ব্যক্তির চোখ থেকে মৃদু আলো পড়ছে, যে জীবনের পথে স্বাচ্ছন্দ্য চলছে; আমি সেই আলোর দিকে চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, 'ওরে আমার প্রাণ, কবরের অন্ধকার তোমার অনেক, আলোর জন্য লোভী হও না।' তখন আমি স্বর্গ থেকে একটি সুন্দর সুর শুনলাম যা আমার আহত হৃদয়কে যেনো পুনরুত্থিত করল তার বিশুদ্ধতায়, তবে আমি কান বন্ধ করে বললাম, 'ওহে আমার প্রাণ, অতল গহ্বরের কান্না তোমার অনেক, স্বর্গীয় গানের জন্য লোভী হইও না।' আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম ফলে আমি দেখতে পেলাম না, এবং কান বন্ধ করলাম তাই আমি শুনতে পেলাম না, তবে আমার বদ্ধ চোখ তখনও সেই মৃদু আলো দেখছিল এবং আমার কান তখনও সেই স্বর্গীয় শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।আমি প্রথমবারের জন্য ভীত হলাম এবং নিজেকে একজন ভিক্ষুকের মতো অনুভূত হল যে আমিরের প্রাসাদের কাছে একটি মূল্যবান রত্ন খুঁজে পেয়েছে এবং ভয়ের কারণে তা তুলে নিতে পারছে না, অথবা দারিদ্র্যের কারণে তা ছেড়েও যেতে পারছে না। আমার হৃদয় চিৎকার করছিল- যেনো তৃষ্ণার্ত এক আত্মার কান্না, যে বন্য জন্তু দ্বারা ঘেরা একটি ঝর্ণা দেখছে এবং সেখান থেকে পান করার জন্য মাটিতে পড়ে ভয়ের সাথে অপেক্ষা করছে”।
তারপর তিনি আমার দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, যেন সে সেই অতীতের কথা স্মরণ করছেন যা তাকে আমার মুখোমুখি হতে লজ্জিত করছে, তবে তিনি অবিরত বলেছিলেন, "সেসমস্ত লোকেরা জীবনের সত্যিকারের মধুর স্বাদ জানার আগেই অনন্তকালে ফিরে যায়, যারা একজন নারীর কষ্টের অর্থ বুঝতে অক্ষম, বিশেষত যখন সেই নারী ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাকে যে পছন্দ করে এমন একজনের প্রতি তার আত্মাকে উৎসর্গ করে, কিন্তু তার দেহ অন্য এমন একজনের প্রতি উৎসর্গ করে যার সাথে সে পার্থিব আইনের দ্বারা আবদ্ধ। এটা সেই নারীর অশ্রু ও রক্ত দিয়ে লেখা একটি ট্রাজেডি যা পুরুষেরা বিদ্রুপ নিয়ে পড়ে কারণ তারা বুঝতে পারে না; কিন্তু, যদি তারা তা বুঝতো, তবে তারা দেখতো তাদের এই উপহাস নিন্দনীয়, বিদ্রুপ অর্ধমের মত, যা তাদের হৃদয়ে আগুনের মতো কাজ করত। এটি একটি নারীর হৃদয়মঞ্চে কালো রাত্রে প্রণীত একটি নাটক, যার দেহটি পুরুষের সাথে আবদ্ধ থাকে যিনি স্বামী হিসাবে পরিচিত যার মাধ্যমে সে বিবাহের অর্থ উপলব্ধি করে খাঁটি এবং সত্যিকারের ভালবাসা এবং সৌন্দর্যের সমস্ত উপাদান দ্বারা তাকে শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করে। কিন্তু এটি একটি ভয়ানক যন্ত্রণা যার শুরু হয় একজন নারীর দুর্বল অস্তিত্ব এবং একজন পুরুষের শক্তি দিয়ে। দুর্বলের উপর দাসত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সময়ের অবসান না হলে এটি শেষ হবে না। এটি মানবতার দূষিত আইন এবং হৃদয়ের পবিত্র প্রেম এবং পবিত্র উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। এমন যুদ্ধক্ষেত্রে আমি গতকালও শুয়ে ছিলাম, কিন্তু আমি আমার শক্তির অবশিষ্টাংশগুলি সংগ্রহ করেছি, এবং আমার হীনমন্যতার শৃংখলকে ভেঙেছি এবং আমি আমার ডানাগুলিকে দুর্বলতার কব্জি থেকে মুক্ত করেছি এবং ভালবাসা এবং স্বাধীনতার প্রশস্ত আকাশে উড্ডয়ন করেছি।
“আজ আমি যাকে ভালোবাসি তার সাথেই রয়েছি এমন একজন; তিনি এবং আমি পৃথিবীর সূচনা হওয়ার আগেই ঈশ্বরের হাত থেকে একটি মশাল হিসাবে বেরিয়ে এসেছি। সূর্যের নীচে এমন শক্তি নেই যা আমার কাছ থেকে আমার সুখ কেড়ে নিতে পারে, কারণ এটি দুটি সংযুক্ত আত্মা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা বোঝা পড়ার মাধ্যমে নিমগ্ন, প্রেম দ্বারা বিকরিত এবং স্বর্গ দ্বারা সুরক্ষিত।"
তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি চাইছেন তার চোখ দিয়ে আমার হৃদয়ের ভিতরটা দেখতে তার কথায় আমার উপর কেমন ছাপ পড়েছে এবং শুনতে চাচ্ছেন আমার ভিতর থেকে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি; কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম এবং তিনি কথা বলেই চলছিলেন। তার কণ্ঠে স্মৃতির তিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতার অকপটতার মিষ্টিতায় পূর্ণ ছিল যখন তিনি বলছিলেন, "জনগণ আপনাকে বলবে যে রোজ হ্যানি একজন পাষন্ডা ও অবিশ্বস্ত মহিলা, যে তার নিজেকে খুশী করতে, নিজের বাসনাকে পরিতৃপ্ত করতে সেই মানুষটিকে ফেলে রেখে চলে গেছে যিনি তার আনন্দের জন্য সব কিছু করেছেন যে তাকে বসবাসের লালিত্য দান করেছিলেন। তারা আপনাকে বলবে যে, সে একজন ব্যভিচারীনি এবং পতিতা যে তার অশ্লীল হাত দিয়ে পবিত্র বিবাহের পুষ্পস্তবককে ধ্বংস করেছে এবং এটিকে দোজখের কাঁটায় বোনা কলঙ্কিত আসন দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছে। সে পুণ্যের পোশাক খুলে পাপ ও লাঞ্ছনার পোশাক পরেছে। তারা আপনাকে এর চেয়ে আরও বেশি কিছু বলবে, কারণ তাদের পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা এখনও তাদের দেহে বাস করে। তারা হল পাহাড়ের নির্জন গুহাগুলির মতো, সেখান থেকে যা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার শব্দগুলি বোঝা যায় না। তারা না ঈশ্বরের আইন বুঝতে পারে, না সত্যবাদী ধর্মের প্রকৃত অভিপ্রায় অনুধাবন করতে পারে, না পাপী ও নির্দোষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তারা কেবল কোন কিছুর বাইরেরটাই দেখে ভিতরের গোপনীয় রহস্য না জেনেই।
তারা অজ্ঞতার সাথে তাদের রায় দেয় এবং অন্ধ হয়ে বিচার করে, অপরাধী ও নির্দোষকে ভাল ও মন্দকে সমান করে তোলে। দুর্ভাগ্য সেই সব মানুষদের যাদের বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ আনে এবং বিচার করে…।
“ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আমি অবিশ্বস্ত ও ব্যভিচারী ছিলাম কেবল তখনই যখন আমি রশিদ বে নামানের বাড়িতে ছিলাম, কারণ তিনি আমাকে ঐশ্বরিক প্রেম এবং ভালবাসার রীতিনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার আগেই পার্থিব আচার ও রীতিনীতির ফাঁদে ফেলে তাড়াহুড়োর জোরে আমাকে তাঁর স্ত্রী বানিয়েছিলেন। আমি যখন তাঁর অন্ন খেয়েছি এবং তার বদন্যতার জন্য তাকে আমার দেহটি উৎসর্গ করেছি তখন আমি ঈশ্বরের এবং নিজের চোখে পাপী ছিলাম। এখন আমি খাঁটি ও পরিষ্কার, কারণ প্রেমের বিধি আমাকে মুক্তি দিয়েছে এবং আমাকে সম্মানিত ও বিশ্বস্ত করেছে। আমি আমার দেহকে খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য এবং আমার দিনগুলিকে পোশাকের জন্য বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছি। হ্যাঁ, লোকেরা যখন আমাকে সবচেয়ে সম্মানিত ও বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসাবে দেখত তখন আমি একজন ব্যভিচারীনী এবং অপরাধী ছিলাম; আজ আমি আত্মায় খাঁটি ও মহিমান্বিত, কিন্তু তাদের মতে আমি দূষিত, কারণ তারা দেহের পরিণতি দ্বারা আত্মার বিচার করে এবং পদার্থের মানদণ্ড দিয়ে আত্মাকে পরিমাপ করে।”
তারপরে তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে তার ডান হাতটি শহরের দিকে ইঙ্গিত করলেন যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন সেখানকার দুর্দান্ত ভবনগুলির মধ্যে দুর্নীতির ভূত এবং লজ্জার ছায়া। তিনি করুণার সাথে বললেন, “দেখুন সব মহাসড়ক এবং মহৎ প্রাসাদগুলি দেখুন যেখানে ভণ্ডামি বাস করে; সমস্ত জায়গাগুলিতে এবং সেখানকার সুন্দর সুন্দর সজ্জিত দেয়ালের মধ্যে পচাগলা দুর্গন্ধের মত বিশ্বাসঘাতকতা বাস করে; গলানো সোনার কারুকার্যে আঁকা ছাদের নীচে মিথ্যা আর ভন্ডামি পাশাপাশি থাকে। ওই চমৎকার বাড়িগুলি লক্ষ্য করুন যা সুখ, গৌরব এবং আধিপত্যকে প্রতিনিধিত্ব করে; এগুলি কেবল দুর্দশা আর সঙ্কটের গুহা। সেগুলি প্লাস্টারে বাধাই করা কবর যেখানে দুর্বল মহিলারা তাদের সুযোগ সন্ধানী চোখ আর অরুণিত ঠোঁটের আড়ালে বিশ্বাসঘাতকতা লুকিয়ে রাখে; তাদের মনের কোণে স্বার্থপরতা বিদ্যমান যেখানে পুরুষের পশুত্ব তাদের স্বর্ণ আর রৌপ্যের মাপকাঠিতে চলমান থাকে।
“যদি সেই উঁচু এবং দুর্ভেদ্য ভবনগুলির দেয়াল ঘৃণা, প্রতারণা এবং দুর্নীতিগুলিকে প্রতিফলিত করত তবে সেগুলি ফেটে পড়ত এবং ভূপাতিত হত। দরিদ্র গ্রামবাসী অশ্রুসিক্ত চোখে সেই আবাসগুলির দিকে নজর রাখে। তারা দেখতে পায় যে সেখানকার দখলদারদের অন্তরগুলি শুদ্ধ ভালবাসাহীন কিন্তু তাদের স্ত্রীদের হৃদয়ে তা রয়েছে পরিপূর্ণভাবে, তখন তারা হাসে ফিরে যায় তাদের জায়গায় এইটুকু সন্তুষ্টি নিয়ে।”
এবং তারপরে তিনি আমার হাতটি ধরলেন এবং আমাকে জানালার পাশে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, "আসুন, আমি আপনাকে সেই লোকদের গোপন রহস্য দেখাব, যাদের পথ অনুসরণ করতে আমি অস্বীকার করেছি। বিশাল খিলান বিশিষ্ট ওই প্রাসাদটি দেখুন। সেখানে একজন ধনী ব্যক্তি বাস করেন যিনি তার পিতার কাছ থেকে প্রচুর স্বর্ণ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছেন। নোংরামি ও হতাশার জীবনযাপন করার পরে, তিনি এমন এক নারীকে বিবাহ করেছিলেন যার সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না কেবল তার পিতা সুলতানের একজন বিশিষ্ট লোক ছিল এটুকু জেনেই। বিবাহের অনতিকাল পরেই তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং রৌপ্যের টুকরোর বিনিময়ে যারা তাদের দেহ বিক্রি করে এমন মহিলাদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করেন। আর তার স্ত্রী একজন মাতালের পরিত্যক্ত খালি বোতলের মতো তাঁর প্রাসাদে একাকি রয়ে যায়। নতুন জীবনের শুরুতেই সে কাঁদতে থাকে এবং কষ্ট ভোগ করতে থাকে; সে তখন বুঝতে পারল যে তার অশ্রু তার অধঃপতিত স্বামীর চেয়ে মূল্যবান। এখন সে একজন যুবকের ভালবাসায় এবং যত্নে নিষ্ঠার সাথে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে, যার উপরে সে তার আনন্দময় সময়গুলি বর্ষণ করছে এবং যার অন্তরে সে তার আন্তরিক ভালবাসা এবং স্নেহ ঢেলে দিচ্ছে।
“আমাকে এখন আপনাকে সুন্দর উদ্যান ঘেরা সেই চমৎকার বাড়িটিতে নিয়ে যেতে দিন। এটি এমন এক ব্যক্তির বাড়ি, যিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসেছেন এবং যারা বহু প্রজন্ম ধরে এদেশে রাজত্ব করেছিলেন, কিন্তু অমিতব্যয়, অলসতা এবং প্রবৃত্তির কারণে যার মান, সম্পদ এবং প্রতিপত্তি হ্রাস পেয়েছে। কয়েক বছর আগে এই ব্যক্তি একটি কুশ্রী কিন্তু ধনী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি তাকে অর্জনের পর তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে শুরু করেছিলেন এবং একজন আকর্ষণীয়া যুবতী মহিলার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করা শুরু করেছিলেন। তার স্ত্রী এখন তার চুল কোকড়ানো, তার ঠোঁট পেইন্টিং এবং শরীর সুগন্ধী করার জন্য সময় ব্যয় করছেন। স্ত্রীটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল জামাকাপড় পরেন এবং আশা করেন যে কোনও যুবক তার দিকে তাকিয়ে হাসবেন এবং তাঁর সাথে দেখা করতে আসবেন, তবে এটি সব বৃথা, শুধু আয়নাতেই তার নিজের কুরুচিপূর্ণ হাসি দেখেই যেতে হবে সফল হতে পারবেন না।
মার্বেল পাথরের মূর্তি স্থাপিত ওই বড় ভবনটি দেখুন; এটি এমন এক সুন্দরী মহিলার বাড়ি যিনি অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। যখন তার প্রথম স্বামী মারা গেলেন, তিনি তার সমস্ত অর্থ এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গেলেন; অতঃপর তিনি দুর্বল মন আর ক্ষীণ দেহের একজন লোককে বেছে নিয়েছেন নিজেকে মন্দ কথা থেকে রক্ষা করতে, লোকটিকে রক্ষা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে তাঁর স্ত্রী হয়েছেন। তিনি এখন তার স্তাবককদের মধ্যে মজাদার ও সর্বাধিক সুস্বাদু ফুলের মধু পানকানী মক্ষিকারানী হিসাবে রয়েছেন।
পাশের ওই সুন্দর বাড়িটি প্রদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি দ্বারা নির্মিত হয়েছে; ওইটি একজন লোভী এবং ক্ষমতাবান লোকের বাড়ী, যিনি শুধু স্বর্ণ আহরণ আর দরিদ্রদের শোষনে সময় ব্যয় করেন। তার শারীরিক ও মানসিকভাবে অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যের অধিকারিনী একজন স্ত্রী রয়েছেন, বাকিদের মতোই যিনিও অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহের শিকার। বোঝার বয়স হওয়ার আগেই তাকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে তার পিতা একটি অপরাধ সংঘটিত করেছেন। তিনি এখন কৃশ এবং ফ্যাকাশে। কারাবন্দীদের মত ফলাফলহীন জীবনের মত তিনি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছেন এবং মৃত্যুর জন্য আকুল তার দাসত্বের কবল থেকে মুক্তি পেতে। তিনি এমন এক ব্যক্তির হাত থেকে তিনি উদ্ধার পেতে চান যিনি তার জীবন কেবল স্বর্ণ আর অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যয় করেন এবং তার নাম বয়ে নিয়ে যেতে এবং তার অর্থ প্রতিপত্তির উত্তরাধিকারী হবার মত একজন সন্তান চান। কিন্তু তা দান করতে অক্ষম ওই মহিলাকে বিয়ে করেছেন বলে সারাক্ষন অভিশাপ বর্ষন করতে থাকেন।
সেই বাড়ির পিছনের বাগানে একজন আদর্শ কবি থাকেন; তিনি একজন অজ্ঞ মহিলাকে বিয়ে করেছেন যে তাঁর লেখাগুলিকে উপহাস করে কারণ সে সেগুলি বুঝতে পারে না এবং কবির আচরণ দেখে সে বিদ্রুপে হাসাহাসি করে কারণ সে নিজেকে তার মহিমান্বিত জীবনযাপনের সাথে সামঞ্জস্য করতে পারে না। সেই কবি একজন বিবাহিত মহিলার প্রতি ভালবাসায় তার হতাশার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন যিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতেন এবং তাঁর হৃদয়ে প্রেমের মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এবং অপূর্ব মোহনীয় ও সৌন্দর্যময়তা দিয়ে সবচেয়ে সুন্দর ও চিরন্তন বাক্যে তার বিষয়ে তার বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন।”
কয়েক মুহুর্ত নিশ্ছিদ্র নিরাবতায় কাটল। ম্যাডাম হ্যানি জানালার পাশে সোফায় বসেছিলেন যেন তার আত্মা সেই আবাসগুলিতে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপরে ধীরে ধীরে তিনি কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন, "ওই সেই জায়গাগুলি যেখানে আমি থাকতে অস্বীকার করেছি; সেখানে সেই কবরগুলি যেখানে আমিও মানসিকভাবে সমাধিস্থ হয়েছিলাম। ওইসব লোকেরা যাদের কাছ থেকে আমি নিজেকে মুক্তি দিয়েছি। তারা দেহের প্রতি আকৃষ্ট কিন্তু যারা হৃদয় দ্বারা প্রতিহত। তারা প্রেম এবং সৌন্দর্যের বিষয়ে কিছুই জানে না। তাদের প্রতি ঈশ্বরের আইন সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার জন্য ঈশ্বরের করুণা। আমি বিচার করতে পারি না, কারণ আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম, তবে আমি আমার সমস্ত হৃদয়ের কাছে সহানুভূতিশীল। আমি তাদের ঘৃণা করি না, তবে দুর্বলতা এবং মিথ্যার কাছে তাদের আত্মসমর্পণকে ঘৃণা করি। আমি যাদের কাছ থেকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পালিয়ে এসেছি তাদের বাস্তবতা আপনাকে দেখানোর জন্য আমি এই সমস্ত কথা বলেছি। আমি আপনাকে সেই ব্যক্তির জীবন বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যারা আমার বিরুদ্ধে সমস্ত মন্দ কথা বলে কারণ আমি তাদের বন্ধুত্ব হারিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত আমার নিজের হয়েছি। আমি তাদের অন্ধকার থেকে উঠে এসে আমার চোখকে সেই আলোর দিকে পরিচালিত করেছি যেখানে আন্তরিকতা, সত্য এবং ন্যায়বিচার বিরাজ করে। তারা এখন আমাকে তাদের সমাজ থেকে নির্বাসিত করেছে এবং আমি সন্তুষ্ট, কারণ মানবতা নির্বাসিত হয় না যদি কারো মহৎ আত্মা স্বৈরাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কেউ যদি দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়াকে প্রাধান্য না দেয়, সে স্বাধীনতা, সত্য ও কর্তব্যের কোন মাপকাঠিতে মুক্ত মানুষ নয়।
“গতকাল আমি এমন ধরণের একটা ট্রে এর মতো ছিলাম যেখানে সুস্বাধু সব খাবারের প্রসার ছিল, আর রশিদ বে নামান যতক্ষন না সেই খাবারের প্রয়োজন অনুভব করত ততক্ষন সে কখনও আমার কাছে আসত না; আমাদের দুজনের হৃদয় বিনয়ী দাসের মতো আমাদের থেকে দূরে সরে রয়ে যেত। লোকে যাকে দুর্ভাগ্য বলে আমি তার সাথে নিজেকে বার বার আপোষ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমার মন অন্ধকার যুগের হাটু গেড়ে থাকা মূর্তির মত আমার জীবনের পাশে থাকতে অস্বীকার করেছিল। আমি আমার শৃঙ্খলা রেখেছি যতক্ষণ না আমি শুনেছি ভালবাসা আমাকে ডাকছে এবং আমার হৃদয়কে প্রেরণের জন্য প্রস্তুত হতে দেখেছি। তারপরে আমি তাকে পাখির লোহার খাঁচা থেকে মুক্ত করে আমার সমস্ত রত্ন, পোশাক এবং ভৃত্য রেখে চলে এসেছি রশিদ বে নামানের বাড়ি থেকে। আমি আমার প্রিয়জনের সাথে থাকতে এসেছি, কারণ আমি জানতাম যে আমি যা করছিলাম তা সৎ। স্বর্গ চায় না যে আমি কাঁদি এবং কষ্ট পাই। অনেকবার রাতে আমি ভোর হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতাম এবং ভোর এলে দিনটি শেষ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতাম। ঈশ্বর চান না যে আমি একটি দুর্বল জীবনযাপন করি, কারণ তিনি আমার অন্তরের গভীরতায় সুখের আকাঙ্ক্ষা রেখেছেন; তাঁর গৌরব আমার হৃদয়ের সুখে স্থির থাকে।
“এটিই আমার গল্প এবং এটি আকাশ ও পৃথিবীর সামনে আমার প্রতিবাদ; এটিই আমার গান যা আমি পূনরাবৃত্তি করছি যখন আমার কথা শোনার ভয়ে লোকেরা তাদের কান বন্ধ করে, কারণ যদি তাদের মন বিদ্রোহের দিকে চালিত হয়, তাদের নড়বড় সমাজের ভিত্তি নষ্ট করে দেয়।
“আমার সুখের পর্বতমালার সর্বচ্চো শিখরে পৌঁছানোর এটি আমার খোদাই করা মোটামুটি পথ। এখন যদি মৃত্যু আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, তবে আমি নির্ভয়ে বা লজ্জা ছাড়াই স্বর্গের সিংহাসনের সামনে নিজেকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক হব। আমি বিচারের দিনের জন্য প্রস্তুত, আমার হৃদয় বরফের মতো সাদা। আমি ঈশ্বরের ইচ্ছারই প্রতিপালন করেছি আমি যা কিছু করেছি এবং আমি আমার হৃদয়ের ডাকে অনুসরণ করেছি স্বর্গের দেবদূতের কণ্ঠ শুনে। এটি আমার এমন একটি নাটক যা বৈরুতের জনগনের কাছে 'জীবনের ওষ্ঠে একটি অভিশাপ,' এবং 'সমাজের দেহে একটি অসুস্থতা' বলে অভিহিত। তবে একদিন ভালোবাসা তাদের হৃদয়কে সূর্যের রশ্মির মতো জাগিয়ে তুলবে এবং দুষিত পৃথিবীর ফুলগুলিকেও ফুটিয়ে তুলবে। একদিন পথযাত্রীরা আমার সমাধির কাছে এসে থামবে এবং পৃথিবীর মাটিকে শুভেচ্ছা জানাবে যা আমার দেহকে ঘিরে রেখেছে এবং বলবে, ‘এখানে রোজ হ্যানি শুয়ে রয়েছে যে নিজেকে ক্ষয়িষ্ণু মানব আইনের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল, ঈশ্বরের শুদ্ধ ভালবাসার আইন মেনে চলার জন্য। সে তার মুখ সূর্যের আলোর দিকে ঘুরিয়েছিল যাতে সে কন্টকতার মাঝে তার শরীরের ছায়া দেখতে না পায়।’
দরজা খুলে একটা লোক ঢুকল। তাঁর চোখ যেন ম্যাজিক রশ্মির মত জ্বলজ্বল করছিল এবং তার ঠোঁটে একটি পরিপূর্ণ হাসি উপস্থিত হয়েছিল। ম্যাডাম হ্যানি উঠলেন, যুবকের হাত ধরে তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি অতিশয়াক্তিতে আমার প্রশংসা করে আমার নাম উচ্চারণ করলেন। আমি জানতাম যে এই সেই ব্যক্তি যার জন্য তিনি সমগ্র বিশ্বকে অস্বীকার করেছেন এবং সমস্ত পার্থিব আইন ও রীতিনীতি লঙ্ঘন করেছেন।
আমাদের মাঝে নীরবতা নেমে এল। আমাদের প্রত্যেকেই গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। এক মিনিট উপযুক্ত নীরবতা ও শ্রদ্ধায় পার হয়ে গেল যখন আমি পাশাপাশি বসে থাকা দম্পতির দিকে তাকালাম। আমার মনে হল আমি এমন কিছু দেখছি যা আমি আগে কখনও দেখিনি এবং তাৎক্ষণিকভাবে ম্যাডাম হ্যানির গল্পটির অর্থ বুঝতে পারলাম। আমি সমাজের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের গোপন অর্থটি বুঝতে পারলাম, যা সমাজের আইন ও রীতিনীতির সীমাবদ্ধতার অত্যচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ। আমি আমার সামনে একটি স্বর্গীয় আত্মা দেখলাম, যা সুন্দর দুইটি সংযুক্ত হৃদয়ের সমন্বয়ে গঠিত, যার মাঝখানে প্রেমের অবতার সমাজের মন্দ জিভ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য তার ডানাগুলিকে প্রসারিত করে রেখেছে। আমি দুটি হাসি মুখ থেকে উদ্ভূত বর্ণচ্ছটা থেকে সবকিছু বুঝতে পারলাম যা আন্তরিকতা দ্বারা আলোকিত এবং পুণ্য দ্বারা বেষ্টিত। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি খুঁজে পেলাম একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একজন সুখের দূত, যারা ধর্ম দ্বারা অভিশপ্ত এবং আইন দ্বারা বিরোধিত। আমি উঠে তাদের বিদায় জানালাম এবং ছেড়ে এলাম একটি দরিদ্র গৃহকোন যেখানে স্নেহ মমতা, ভালবাসার বেদী নির্মান করেছ। যে ভবনগুলি ম্যাডাম হ্যানি আমাকে দেখিয়েছিল সেগুলি পেরিয়ে এলাম।মহল্লার শেষ প্রান্তে পৌঁছে আমার রশিদ বে নামানের কথা মনে পড়ল এবং তাঁর শোচনীয় দুর্দশার কথা চিন্তা করে নিজেকে বললাম, “তিনিও নিপীড়িত; তবে তিনি যদি ম্যাডাম হ্যানির বিষয়ে অভিযোগ করে, স্বর্গ কি কখনও তাঁর কথা শুনবে? মহিলাটি যখন তাকে ছেড়ে চলে যায় তার অন্তরের স্বাধীনতা অনুসরণ করে তিনি কি তখন অন্যায় করেছিলেন? হৃদয়কে প্রেমে আবদ্ধ করে তিনি কি কোন অপরাধ করেছেন? দু'জনের মধ্যে কে নিপীড়িত আর কে অত্যাচারী? কে অপরাধী আর কে নির্দোষ?”
কয়েক মুহুর্ত গভীর চিন্তাভাবনার পরে আমি আবার নিজের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। “অনেক সময় প্রবঞ্চনা নারীকে তার স্বামীকে ছেড়ে ধন-সম্পদের প্রতি অনুসরণ করতে প্রলুব্ধ করে, কারণ ধন সম্পদ এবং সুন্দর পোশাকের প্রতি তার ভালবাসা তাকে অন্ধ করে দেয়। কিন্তু একজন ধনী স্বামীর প্রাসাদ ছেড়ে একজন দরিদ্র মানুষের কুঁড়েঘরে চলে আসা ম্যাডাম হ্যানির আচরণ কি প্রতারণামূলক? অনেক সময় অজ্ঞতা কোনও মহিলার সম্মানকে হত্যা করে এবং তার আবেগকে পুনরুত্থিত করে; সে ক্লান্ত হয়ে বেড়ে ওঠে এবং তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায়, তার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্ররোচিত হয় এবং এমন একজন ব্যক্তির অনুসরণ করে, যার কাছে সে নিজেকে নীচু করে। ম্যাডাম হ্যানি কি একজন অজ্ঞ মহিলা যিনি তার শারীরিক অভিলাষের অনুসরণ করে প্রকাশ্যে তার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তার প্রিয় যুবকের কাছে চলে এসেছেন? স্বামীর বাড়িতে থাকাকালীন তিনি তো গোপনে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারতেন, কারণ অনেক পুরুষ তার সৌন্দর্যের দাস ছিল এবং তার ভালবাসার শহীদ হতেও রাজি ছিল। ম্যাডাম হ্যানি ছিলেন একজন দুর্দশাগ্রস্থ মহিলা। তিনি কেবল হৃদয়ের সুখ চেয়েছিলেন, তিনি এটি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং আলিঙ্গন করেছিলেন। এটিই সত্য যা সমাজকে অসম্মান করে।” তারপরে আমি ইথারের সাথে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, "কোনও মহিলার পক্ষে কি তার স্বামীর দৈন্যতায় তার সুখ কেনা উচিত?" এবং আমার হৃদয় আরও যোগ করল, "এটা কি কোনও পুরুষের পক্ষে উচিত তার স্ত্রীর অনুরাগের দাসত্ব করা যখন সে বুঝতে পারছে যে সে কখনই এর অধিকারী হবে না?"
আমি হাঁটতে লাগলাম এবং শহরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তখনও আমার কানে ম্যাডাম হ্যানির কন্ঠ ধ্বনিত হচ্ছিল। সূর্য অদৃশ্য হয়ে গেল এবং নীরবতা নেমে এল চারিদিকের মাঠে তৃণভূমিতে, যখন পাখিরা তাদের সন্ধ্যায় প্রার্থনা শুরু করছিল। আমি সেখানে ধ্যানরত অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলাম, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “স্বাধীনতার সিংহাসনের সামনে গাছগুলি উচ্ছল বাতাসে আনন্দিত হয় এবং সূর্যের রশ্মি এবং চাঁদের রশ্মি উপভোগ করে। স্বাধীনতার কর্ণের মাধ্যমে পাখি ফিসফিস করে এবং স্বাধীনতার আশেপাশে তারা সংগীতের ঝর্ণাধারয় ঝড় তোলে। ফুলগুলি তাদের সুগন্ধে শ্বাস নেয় স্বাধীনতার আকাশ জুড়ে এবং তারা হাসে যখন দিবস আসে স্বাধীনতার চোখের সামনে।
“পৃথিবীতে সমস্ত কিছুই প্রকৃতির বিধি অনুসারে বাস করে, এবং সেই আইন থেকেই স্বাধীনতার গৌরব ও আনন্দ প্রকাশ পায়; কিন্তু মানুষ এই ভাগ্যকে অস্বীকার করে, কারণ সে ঈশ্বর-প্রদত্ত আত্মাকে তার নিজের একটি সীমাবদ্ধ এবং পার্থিব আইন দ্বারা স্থির করে। সে নিজের জন্য কঠোর নিয়ম তৈরি করে। মানুষ একটি সংকীর্ণ এবং বেদনাদায়ক কারাগার তৈরি করে যেখানে সে তাঁর প্রেম, স্নেহ ও বাসনাগুলিকে একাকী করে ফেলে। সে একটি গভীর সমাধী খনন করে যেখানে সে তার হৃদয় এবং এর উদ্দেশ্যটিকে সমাহিত করে। যদি কোনও ব্যক্তি তার আত্মার আদেশের মাধ্যমে সমাজ থেকে তার প্রত্যাহার ঘোষণা করে এবং আইন লঙ্ঘন করে, তার পাশের লোকেরা বলবে যে সে নির্বাসনের যোগ্য একজন বিদ্রোহী, বা কেবল মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মতো সে একটি কুখ্যাত প্রাণী। মানুষ কি পৃথিবীর শেষ অবধি আত্ম-বন্দী হয়ে থাকবে? না কি সময়ের সাথে সাথে সে মুক্তি পাবে এবং আত্মার জন্য আত্মায় বেঁচে থাকবে? মানুষ কি পৃথিবীকে নিম্নমুখী করবে এবং পিছনের দিকে ঠেলে দিবে? নাকি সে সূর্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাবে যাতে সে নিজের শরীরের ছায়া কাঁটার মাঝে দেখতে না পায়?”
--------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি
জিবরান খলিল জিবরানঃ
কাহলিল জিবরান নামে পরিচিত।একজন লেবানিজ কবি, লেখক ও শিল্পী। উল্লেখযোগ্য রচনাবলী- দ্য প্রফেট, ব্রোকেন উইংস, স্যান্ড এণ্ড ফোম।
শামীম মনোয়ার
গল্পকার।অনুবাদক।
সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ।
1 মন্তব্যসমূহ
গল্পটা খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন