অনুবাদক : ফারহানা রহমান
আমার খালার খামারবাড়িতে সেদিন পিকনিক ছিল। শুধুমাত্র এই পিকনিকের দিনটিতেই আমাদের পুরো পরিবারের সব সদস্যের মিলনমেলা বসে। আমি আর আমার বোন বিলি, আমরা দএমন মিলে মুরগীগুলোকে তাড়া করে গোলাঘরে ঢুকানোর চেষ্টা করছিলাম।
খোলা দরজা দিয়ে বিলি দৌড়ে ভেতরে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। কিন্তু মাথার উপর ঝুলতে থাকা ছায়াটা দেখে আমি থমকে গেলাম। আমার চাচাতো ভাই টমিও আমার মতোই আট বছর বয়সের একটি বাচ্চা ছেলে ছিল। সেও আমার মতোই আতংকে কেঁপে উঠলো। সেই ঝুলন্ত ছায়াটির মুখের উপর সূর্যের আলো এসে পড়েছিল। আমরা তার মুখটা দেখতে পেলাম। ওটা ছিল পায়ের জুতোর মতোই কালো।
আকাশের মতো উঁচু গোলাঘরের ছাঁদ থেকে ঝুলে পড়া দড়ি দিয়ে তার গলাটা পেঁচানো ছিল। আর সেই দৃশ্যটি আমাদেরকে ভয়ানকভাবে কৌতূহলী করে তুলল। আচ্ছা সে কি আমাদের সবাইকে পিছলে ফেলে সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিল না?তাহলে এখন কি হোলো?
কেউ কেউ আমার পিছনে এসে দাঁড়ালো। কেউ কেউ আতংকে চিৎকার কোরতে লাগলো। আমার মা এসে দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখগুলো ঢেকে দিয়েছিল।
গত একবছর ধরে আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক আছে। আমি এবং জেসি প্রেমিক- প্রেমিকা। ও আমাকে ওর ছেলেবেলার অনেক গল্প শোনায়। ওর বাবা প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতো। ওর মা ওর সব জামাকাপড় বানিয়ে দিতো। ওর দাদির গা থেকে সবসময় ডিল ব্রেড ও ভ্যানিলার গন্ধ মৌ মৌ করে ভেসে আসতো। আমি হা করে এসব গল্প গিলতাম। বিশ্বাস কোরতে ইচ্ছে হোতো যদিও সেটা কোরতে পারতাম না। আর সেইসব রূপকথা যেগুলোকে ও ভাবতো যে সবার জীবনেই আছে সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম।
“তোমার দাদির শরীর থেকে কেমন গন্ধ বের হয়?”
যেভাবে সবসময় আমি বই থেকে মেরে দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতাম। সেভাবেই এবারেও একটা গুল মারলাম। “ল্যাভেন্ডারের সেন্টের মতো সুগন্ধ ভেসে আসে আমার দাদির গা থেকে। এমনই ঝাঁঝালো সে সুগন্ধ যেন মনে হয় সেটা তোমার পাকস্থলী নিংড়ে মধুময় সব অতীত স্মৃতিগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে।”
হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে আমি তো আসলে ল্যাভেন্ডারের গন্ধই চিনি না। আর তখনোই ও ল্যাভেন্ডার সম্পর্কে নতুন কোনো প্রশ্ন করতে পারে যার কিছুই আমি জানি না ভেবেই আতঙ্কে গা শিরশির করে উঠলো। কিন্তু দেখা গেলো উল্টো ঘটনা ঘটেছে। জেসি এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল আর আমার কানের কাছে ওর সুন্দর মুখটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো, “ওহ কী দারুণ! আমার কী সৌভাগ্য যে আমি তোমাদের মতো এতো সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারের অংশ হতে যাচ্ছি!”
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না, শুধু চোখ বুজে ওকে জড়িয়ে থাকলাম।
আমি জন্মেছিলাম আসলে অনেকগুলো বড়বড় এবং ছোট ছোট কাজিনদের মাঝখানে। দুই বাচ্চার মাঝখানে মানুষ যেভাবে কয়েক বছরের বিরতি নেয়। আমি আসলে সেই মাঝখানের সময়টিতেই জন্মে ছিলাম। তাই ঘরের বাইরে বেরুলেই সবাই আমাকে খেয়াল করতো। টমি মারা যাওয়ার ঠিক আগে, সবাই মিলে যখন কাজিন বারবারার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ঠিক তখন আমাকে কিন্তু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ঠেলে দেওয়া হয়েছিলো।
ওর চিৎকারে বাড়ির উপরনিচ সব ভেসে যাচ্ছিলো। কাজিন কোরা একের পর এক বালতি ভর্তি রক্তাক্ত ন্যাকড়াগুলো আগুনে পড়ানোর জন্য বের করে নিয়ে আসছিলো। আর অন্যান্য চাচাতো-খালাতো ভাইবোনরাও সব ডগউড গাছের ডাল দিয়ে খুঁচিয়ে আগুণকে উসকে দেওয়ার জন্য আগুণের স্ফুলিঙ্গের কাছে ছুটে গেলো। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের চিৎকার চ্যাঁচামেচির কারণ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আমি সত্যি বুঝতে পারিনি যে ওখানে আসলে কি হচ্ছে? আমাদের চেয়ে বয়সে যারা বড় ছিল তারা নিশ্চয়ই বুঝেছিল সেদিন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল। ওদের সেই আশ্চর্য বিস্ময়কর অভিব্যাক্তি একসময় অদ্ভুত এক হাসিতে পরিণত হোলো। আমি তাদেরকে দেখেছিলাম আমার খালাতো বোন কোরাকে ধরে ধরে সিঁড়ি ভেঙে উপড়ে উঠে যেতে সাহায্য করতে। সেসময় আমার কাজিনের দুপা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর সেই ন্যাকড়াগুলোয় লেগে থাকা রক্ত প্রথমে পাতলা হয়ে যেতে লাগলো, এরপর পানি পানি হয়ে গোলাপি রঙের হয়ে গেলো। কোরা সেগুলোকে আগুলে ছুঁড়ে ফেলছিল আর দুর্গন্ধময় আগুণের ধোঁয়ার পাশে ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
র্যান্ডল যেতে যেতে বলছিল, ওখানে একটা বাচ্চা ছিল। ডিম ফেটে বের হওয়া মুরগীর বাচ্চার মতোই ওই ন্যাকড়াগুলোর মধ্যে জড়িয়ে একটি বাচ্চাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে সেরকম কিছুই ছিল না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। এমন কিছু থাকলে আমি দেখতে পেতাম। রক্ত ছাড়া ওখানে কিছুই ছিল না। একসময় বাসাটিতে লোকজন কমে গিয়ে শান্ত হয়ে উঠলো। সময়ের সাথে সাথে বিলাপ করা কান্নার শব্দও ধোঁয়ার সাথে মিশে গিয়ে আস্তে আস্তে মোলায়েম ও মৃদু হয়ে হারিয়ে যেতে লাগলো।
আমার র্যালেন খালা হঠাৎ করে বারান্দায় এসে আমাকে খেয়াল না করেই হুড়মুড় করে আমার গায়ের উপর এসে পড়লেন। তিনি কিছুই খেয়াল করলেন না। একেবাকে কোনো দিকেই না। তিনি থাম্বাটার উপরে বারি দিতে দিতে হাতের ছাপ ফেলে দিয়েছিলেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত ওটার উপড়ের পেইন্টিঙয়ের ছাল উঠে না আসছিলো ততোক্ষণ তিনি বারি মারতেই লাগলেন। তিনি থামতাকে এমনভাবে পেটাতে লাগলেন যেন সেটি খুব ব্যথা পাচ্ছে। তিনি থামটাকে রীতিমত গালাগালি আর অভিশাপ দিতে লাগলেন। তিনি তার নিজেকে এবং বারান্দায় বসে বসে জেসব বাচ্চাগুলো হৈচৈ করে গানবাজনা করছিলো সবাইকেই একাধারে অভিশাপ দিয়ে যেতে লাগলেন। “ওহ খোদা! ওহ খোদা! গাধা মেয়েটার কোন বোধবুদ্ধি পর্যন্ত নাই... কী হবে এখন হে খোদা?”
আমার মা আমাকে সেই ছবিগুলো দিয়েছিলো। সেগুলো এখনো আমার কাছে আছে – ধূসর খয়েরী ছোপ ছোপ লেগে থাকা শূন্য ময়লা বারান্দাটা, একের পর এক বাচ্চারা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খালাত-মামাতো ভাইবোনরা, খালা-খালু, মামা-মামি সবাই। চারদিকে রহস্যময় পরিস্থিতি। তারমধ্যে যে ঠিক কতরকমের রহস্য তৈরি হয়েছিলো এখন আর কেউ মনে করতে পারে না। আমি জেসিকে সেই ছবিটা দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে ছবিটিতে কারা কারা ছিল তার কিছুই জানাইনি। যখন ও ভাঙা দাঁত দেখে হাসাহাসি করছিলো, আমি তখন সেখানে দাঁত বসিয়ে নিলাম। সেইসব ময়লা জিনিস আর তছনচ হয়ে যাওয়া সবকিছু যা আমি কখনোই মনে রাখতে চাই না। আর ভুলতেও তো পারি না সেসব।
আমরা ছিলাম অনেক ভাইবোন। বেঙাচির মতো অসংখ্য। এদের মধ্যে কেউ যদি মাঝেমধ্যে নাও থাকে। কেই বা সেটা খেয়াল করে? আমার নানুর মার এগারোটি মেয়ে এবং সাতটি ছেলে ছিল। আমার নানুর ছিল ছয় ছেলে আর পাঁচ মেয়ে। প্রত্যেকে কমসে কম ছয়টা করে পয়দা করেছে। কেউ কেউ আবার নয়টা বাচ্চা নিয়েছে। ছয়বার ছয়টা। এগারোবার এগারোটা। তারা সবাই গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তারা কেউ কেউ মরে যেতো অথচ কেউ যে তাদেরকে খুব মনে করে কষ্ট পেতো তাও নয়। আমি এমন একটি বিশাল পরিবারে জন্মেছে যে আমার পক্ষে সেই পরিবারের অর্ধেক কাহিনিও আসলে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। যে কোনো কারণেই হোক না কেন এমন মনে হোতো যে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে হত্যা করছে। গাড়ির সাথে গাড়ির সংঘর্ষ, শটগান চালানো, দড়ি দিয়ে ঝুলাঝুলি করা, চিৎকার চ্যাঁচামেচি করা, জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এসবই ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের অংশ। আমি হচ্ছি পিরামিডের সুউচ্চ অংশ থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া এমনই এক বস্তু যে অনেক পরের দিকে জন্মেছে। ফলে আমি যে একজন সমকামী (লেসবিয়ান) এবং কখনো কোনো শিশুর জন্ম দেবো না তাতে কারোই কিছু এসে যায় না।
আমি যে গল্পটা বললাম তা হাস্যকর হয়ে গেলো। আমি বারবেন হুইস্কি খাচ্ছিলাম আর খুব ধীরে ধীরে অনেকটা ফিসফিস করে অতীতের যতসব হাস্যকর গল্পগুলো বলে যাচ্ছিলাম। এমন মনে হোতো যে হয়তোবা কেউ আছে যে আমার কাছে জানতে চায়, ওই ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছিল? আমি ছবিগুলো দেখালাম। আর ও বললো, “আচ্ছা এই মেয়েটা কি সেই ছিল না যে ব্রিজের ঘটনাটা ঘটিয়েছিল?” আমি ছবিগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখলাম। আরও অনেকটা মদ খেলাম। আর সবসময়ই কেউ না কেউ ঠিকই এগুলোকে খুঁজে বের করে আর বলে, “ওহ খোদা! সত্যি করো বোলো তো আসলেই তোমরা ওখানে ঠিক কতজন ছিলে?”
আমি কোনো উত্তর দেই না।
জেসি প্রায়ই বলতো, “ তোমার আসলে এইসব হিংস্রতার প্রতি খুব আসক্তি আছে। আর তার তাই এতো এতো ভয়াবহ গল্প তুমি জানো আর বলতেও পারো।”
তার মসৃণ সুন্দর মুখ দিয়ে সে একথাগুলো বলে যাচ্ছিলো। আহা কী সুন্দর তার চিবুক! কেউ কখনো সেটিকে এমন আকার করে দেয়নি। আর আমি তার সেই চিবুকের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু জেসি যখনই তাদের কথা বলতে শুরু করলো, আমার হাতগুলো কাঁপতে লাগলো। আর তার সেই ভয়াবহ গল্পগুলো বলে যাওয়া ছাড়া আমি যেন কখনোই এভাবে আর কোনো কিছুই কোনোদিন চাইনি।
আর তাই আমি একটি লিস্ট বানালাম। আমি তাকে বললাম; যে একজন তার ছোট ভাইকে একটি লোহার সাথে দেখে পাগল হয়ে গেলো। তাদের তিনজনই নিজেদের হাত চির ছিল। তারা তাদের হাতের কবজিগুলো কাটছিল না বরং তারা তাদের কনুইয়ের পাশের বড় শিরাটাকে কাটার চেষ্টা করছিলো। আর তারপর সে যে ছেলেটার সাথে শুতো তাকেই সে গলা টিপে মেরে ফেললো। পরে তাকে এমনভাবে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যেন কেউ একজন লাই খেয়ে হাসতে হাসতে নিঃশব্দে মারা গেছে। এক বছরের মাথায় আমি আটজন কাজিনকে হারালাম। এটি এমনই এক দুঃসহ বছর ছিল যে আমার স কাজিনরা পালিয়ে গিয়েছিল। চারজন একেবারে গায়েব হয়ে গেল এনং আর কখনোই তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। একজনের নদীতে সলিল সমাধি হোলো। আরেকজন উত্তরে চলে গেল হিচহাইকিং করতে আর ফিরে আসেনি। আরও একজন বনের ভেতর দৌড়াতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরল। এদিকে শেষ যে কাজিনটি ছিল গ্রেস সেও কী একটা কারণে যেন গ্রিনভ্যালি থেকে গ্রির দিকে রওনা হয়েছিল আর ফিরে আসেনি অথচ কেউ জানে না কী সেই কারণটি। ও ক্ষুধায় আর প্রচণ্ড গরমে মারা গিয়েছিল। গ্রেস সিয়ারসে এক মাইল দূরের অভারপাসের উপর থেকে পড়ে গিয়ে রোবাকের ওয়্যারহাউজের পাশে মরে পড়ে ছিল।
পরে ঘুমাতে চেয়ে আর ঘুম হোলো না। জেসির চিবুকের নিচে আমার হাতটি ছিল। আমি সেখান থেকে সরে এসেছিলাম। কিন্তু কাদিনি। আমি আসলে কখনোই কাদতে পারি না।
আমি আর আমার বোনরা বলতে গেলে সারাক্ষণই ধ্রসিত হতাম। এতা এক ধরণের কৌতুকই বলতে পার।
সাউথ ক্যারোলিনার কুমারী কারা?
তাদের মধ্যে কেউ কি দশ বছর পর্যন্ত টিকতে পারে?
এভাবে প্রতিনিয়ত আমার মা’র বিছানায় আমারই সৎবাবা যে আমাকে ধর্ষণ করত সেটা আসলে কোনো হাসিঠাট্টার বিষয় ছিল না। আর চিলেকোঠায় নিয়ে গিয়ে আমার মামাতো বোনকে ধর্ষণ করত আমার মামা। অন্যান্য কাজিনদের যেভাবে বনের ভেতর নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হোতো, লুসিলকে সেভাবে করা হোতো না। আবার এদিকে চারজন অপরিচিত মানুষ পারকিং লটে নিয়ে গিয়ে ড্যানিকে ধর্ষণ করতো। আর যারা কাগজ বানাতো তারা ধর্ষণ করতো পাম্মিকে। অপরিচিত সব লোকজনের সামনে কোরা বারবার করে এটি জোরে জোরে পড়তে লাগলো। তারা কারা সেটা সবসময় অজানাই রয়ে গেল কারণ পাম্মি সম্পর্কে কখনই কিছু বলেনি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো করা, কাটাছেড়া করা, রক্তাক্ত করা, ক্ষতবিক্ষত করা। এসব শব্দ আমি বহুবার শুনেছি। অনেক বড় বড় শব্দ, ছোট ছোট শব্দ। এসব শব্দ অনুধাবন করা যে কত কষ্টকর।
মানুষের একটি কাজ দিয়েই। পুরুষ একটিমাত্র কাজ দিয়েই নারীর ভেতরটা একেবারে ছিদ্র করে দেয়। ঝাড়ুর লাঠি, গাছের ডাল এমনকি গ্রিজ গান দিয়ে নারীর দেহ ছিদ্র করে দেয়। অথচ তাদের লিঙ্গটা কিন্তু অক্ষতই রয়ে যায়। এমনসব জিনিসপত্র? হায়রে উদ্দেশ্য্য! বিশ্বাসী হতে চায় না এমন। হুইস্কির বোতল, ক্যান ওপেনারস, ঘাস কাটার কাঁচি, ধাতুর দণ্ড, এমনকি সবজি পর্যন্ত নারীর যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বাস করা যায় না। সত্যি একদমই বিশ্বাস হয় না এসব।
জেসি আমাকে বলে, “ তোমার কথায় জাদু আছে।”
কথা বোলো না। প্লিজ প্লিজ আর একটুও কথা বোলো না। আর তখনই ও আমাকে খুব নীরবে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল।
আমি অতীতের সেইসব চিত্রগুলো চোখের সামনে তুলে ধরলাম। ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ওদের সবার মধ্যে আমি আসলে কোনজন ছিলাম? যারা বেঁচে গিয়েছিলো তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ঘৃণা করতো। আমি জানি যে নিজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থেকে তারা কখনোই জানতে পারতো না আসলে কী এমন কারণ ছিল এয়াসব ঘটার পিছনে। তাই নিজেকেই জিগ্যেস করতো, “আমি কেন? আমার সাথেই কেন এমন হোলো?আমার অপরাধটা কী? এসব কেন অন্য কারো সাথে না হয়ে আমার সাথেই হোলো? এগুলোর ভেতর এমন সব রহস্য জড়িয়ে আছে। আর আমি অন্যদের যতটা ভালবাসতাম নিজেকে ঠিক ততটাই ঘৃণা করতাম। বেঁচে আছি বলে কি আমার সবাইকে বিশেষ কিছু বলা উচিত? নাকি বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি হওয়া উচিত? নাকি মহৎ কোনো কিছু একটা করে দেখান উচিত?
আমি আমার খালাতো ভাই বুচকে খুব ভালোবাসতাম। ওর বুড়োদের মতো একটা বড়সড় মাথা ছিল, ওর মাথায় ছিল পাতলা পাতলা ফ্যাঁকাসে কতগুলো চুল। আর ওর ডাগর ডাগর চোখগুলো সারাক্ষণ ঝলছল করতো। আমরা প্রতিটি ভাইবোন ওকে ভীষণ ভালবাসতাম। যদিও বা হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে ওরই কিন্তু ছিল সবার চেয়ে বড় মাথা আর পাটের আঁশের মতো ফ্যারফেরা ফ্যাঁকাসে চুল। আর আমার ছিল ঘন কালো লম্বা চুল। অথচ আমাদের পুরো পরিবারটিকে দেখলে মনে হতো যেন এরা প্রত্যেকেই ফ্যাঁকাসে সোনালী ব্লন্ড চুলের একেকজন অন্যেজনের কার্বন কপি। অবশ্য পরে দেখা গেলো যে বড় হতে হতে এদের প্রত্যেকেরই চুল খয়েরই অথবা লাল রঙের হয়ে গেছে। এবং শেষপর্যন্ত আমিও আর কালো চুল ধরে রাখতে পারলাম না।
আমি আর বুচ তখন কাজিনদের মধ্যে দলচ্যুত। আমি যেহেতু সবারচেয়ে কালো আর চঞ্চল ছিলাম তাই আমাকে দলচ্যুত করা হয়েছিলো। আর বুচের যেহেতু বিশাল বড় মাথা আর নানা ধরণের পাগলামি ছিল ফলে তাকেও করা হোলো। বুচ যখনতখন আংকেল লুসিয়াসের ট্রাকে উঠে গ্যাস ট্যাংকটা খুলে ওর নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিত। ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মুখটা হা করে দম আটকে রাখতো। তারপর একসময় গরগর করে বমি করে ফেলত। এবং পরে আবারো ওভাবে দম নিতো আর একই কাজ করতো। এসব কাজ এতোই ভয়ানক ছিল যে এমনকি তোমার পায়ের পাতাতে পর্যন্ত ঝিনঝিন ধরে যেতো। আমিও ওর পিছন পিছন ট্রাকে উঠে ওর মতোই গ্যাস চেম্বারে মাথা গলানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি এতোই ছোট ছিলাম যে এতো উঁচুতে উঠে ঝুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হোতো না। আমি মাথা ঘুরিয়ে, সারা শরীর ঝিনঝিন করতে করতে ধপাস করে মাটিতে এসে পড়তাম। বুচ গ্যাস ট্যাংকের ভেতর মাথা গলিয়ে দিয়ে ঝুলে থাকতে পারতো। এবং দুহাতের তালুতে করে গ্যাস ভরে আনত তারপর হাসতে হাস্তে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিত। ও ঝড়ের বেগে উঠে যেতো আর দরজার হ্যান্ডেল্টা ধরে ঝুলে পেট্রোলের দুর্গন্ধ বুকের ভেতর টেনে নিতে নিতে হা হা করে হাসত আর টলতো। এভাবেই একদিন ও ধরা খেলো আর কেউ একজন শিক্ষা দেওয়ার জন্য ম্যাচের কাঠি ছুঁড়ে মেরেছিল।
আর এভাবেই কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই ও চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলো।
না না আমি করিনি, আমি করিনি বলে চিৎকার করতে করতে আমার রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমার নিজেরই পিনপিনে গলার আওয়াজ শুনে ভয়ে আতঙ্কে ঢেঁকুরের মতো দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পানি এসে আমার গলার ভেতর জমতে লাগলো। আমাকে জড়িয়ে ধরো, আনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো বলে গড়াতে গড়াতে এসে জেসি আমার গায়ের উপর এসে পড়লো। আর শক্ত করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল।
সে বারবার করে আমাকে বলতে লাগলো, “আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আমি তোমার সাথে আছি।”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি স্মিত হাসি দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, “ আচ্ছা আমি কি তোমাকে বোকা বানিয়েছি?” আমি ওর পাশ থেকে গড়িয়ে অন্যপাশে সড়ে গেলাম। জেসি দুষ্টুমি করে আমাকে খোঁচা দিলো। আর আমি সাথেসাথেই ওর হাতটা বাতাসের মধ্যেই আঁকড়ে ধরলাম।
ও ওর মুখটি ঘুরিয়ে এনে আমার কাছে এসে চোখ বুজে ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “ আমার সোনা! আমার ভালোবাসা”। আমি আমার মুখের কাছে আমার কাঁপা কাঁপা হাতটি এনে আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা নখগুলো আর কব্জিটি দেখতে লাগলাম। ও যখন উষ্ণ ও শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে তখন আমি ঘণ্টার পর ঘন্টা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। যদিও জানি ও তখনো আমার পক্ষে নেই।
জেমস অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের একজন আংকেল ওর মুখে বাসায় বানানো মন ছুঁড়ে মেরে ওকে অন্ধ করে দিয়েছিলো।
লুসি রেলেন খালার বাসার সাম্নের জানালা দিয়ে ছাঁদে উঠে ওখান থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। তারা সবাই একই কথা বলল যে ও লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু কেউ বললো না ঠিক কি কারণে লুসি এমন করলো।
রেলেন খালাকে খালু সবসময় মারধোর করতো। খালার দুই যমজ ছেলে মার্ক এবং লিউক বাবাকে বাঁধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। একবার তারা দুজন বাবাকে বাড়ির আঙিনার বাইরে বের করে দিয়েছিলো। ঢিলঢিলা চালের বস্তার মতো তাকে বাইরে ছুঁড়ে মেরেছিল। শুয়োরকে জবাই করার সময় যেমন সে চিৎকার করতে থাকে, আংকেল ম্যাথিউ সেভাবেই চিৎকার করছিলো। আমি দেখলাম আমার বোন দুজন নিজেদের বাঁচানোর জন্য শেডের নিচে লুকিয়ে আছে। কিন্তু ওখানে বাইরে কি হচ্ছে সেটা দেখার জন্য আবারো ফিরে গেলাম। ছোট্ট শিশু বো হৈচৈ দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বারান্দা পার হয়ে বাবার পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে গিয়েছিলো। আংকেল ম্যাথিউ ওঁকে খামচে ধরে মাথা নিচে রেখে পা ধরে উন্মাদের মতো ঝোলাতে ঝোলাতে বড় দুই ছেলের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলো। ছোট্ট বো’র মাথা ওর বড় ভাইদের কাঁধের সাথে এবং ঠোঁটের সাথে বারবার ধাক্কা খেতে লাগলো। পরে বো কোনমতে ছাড়া পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে ময়লার ভেতর গিয়ে লুকিয়েছিল। ওর জিভ মুখ থেকে বের হয়ে ঝুলে পড়েছিল। ওর কান থেকে গড়গড় করে স্রতের মতো রক্ত ঝরছিল। এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি স্থির হওয়ার পর যখন মার্ক ও লিউক তাদের বাবাকে একটু শান্ত হতে দেখেছিল, তখন সব শেষ। আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ছোট্ট শিশু বো’র আসলে কী পরিণতি হয়েছিলো সেটা সম্পর্কে তারা কখনোই কাউকে আর কিছু বলেনি। র্যান্ডেল আমাকে আর লুসিকে কুস্তি খেলা শেখাতে চেয়েছিল। “তোমাদের হাতগুলো মাথার উপর ওঠাও।” সে পাদুটো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠানামা করছিলো এবং মাথাটা সারাক্ষণ দুলছিল। হঠাৎ সে আমার গালে একটা সজোরে ঘুষি মারল। আমি ধুলোর ভেতর পড়ে গিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে রইলাম। এরপর সে লুসির দিকে এগিয়ে গেলো। আর আমি যে ওখানেই পড়ে থাকলাম সেদিকে একটুও খেয়াল করলো না। সে হাসতে হাসতে লুসিকেও একটা ঘুসি দিলো। লুসি তাড়াতাড়ি ওর মাথাটাকে দুহাত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। এবং হাঁটু গেঁড়ে বসে গলাটাকে হাঁটুর পেছনে লুকানোর চেষ্টা করলো।
“ না, না,” এভাবে না। ওর মতো করে আগাও। আবারো সে আমাত দিকে ঘুরলো। “ দৌড়াও” জোরে একটা লাথি দিলো। এবারো আমি বলে মতো গড়াতে গড়াতে বরফের মতো জমে হয়ে গেলাম।
“ওহ! না, না! হচ্ছে না!” আবারো একটি ভয়ানক জোরে লাথি মারল আমাকে। আমি গোঁ গোঁ করে গোঙাতে লাগলাম কিন্তু একটুও নড়লাম না পর্যন্ত। ও এবার লুসির দিকে এগিয়ে গেলো। ভয়ে লুসির দাঁতগুলো ঠকঠক করে কাঁপছিল। কিন্তু তবুও ও টুকরো করে কাটা শূয়রের মাংসের পিসের চেয়েও শক্ত পাথরের মতো বসে রইল।
ও চিৎকার করে উঠলো, “দৌড়া!” লুসি ওর মাথাটাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁদতে লাগলো।
র্যান্ডেল হিংস্র আর রাগান্বিত হয়ে শুয়োরের মতো ঘোঁৎঘোঁৎ করে বলতে লাগলো “ কুত্তীর বাচ্চারা, তোরা দুজন কখনো কোনো ভালো জিনিস শিখতে পারবি না।”
- রাগে গজগজ করতে করতে ও হেঁটে চলে গেলো। খুব কষ্টে
আস্তেআস্তে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। দুজন দুজনকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলাম। ধীরে ধীরে দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। আমরা দুজনেই জানতাম যে যদি আমরা ওর সাথে কুস্তিতে লড়ার চেষ্টা করতাম তাহলে ও আমাদেরকে মেরেই ফেলতো।
একদিন হঠাৎ শুনলাম আমার ছোটবোনটা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। ওর বয়স তখন কতই বা হবে? বড়জোর সাত বছর। আমাদের সৎ বাবা ওর বাঁহাতটি ধরে একবার সামনে আর একবার পিছনে এভাবে পেন্ডুলামের মতো দুলাচ্ছে দেখলাম। হাতটা আলগোছে খুলে এসে ঝুলছে আর আমার ছোট বোন পাগলের মতো চিৎকার করেই চলেছে। আমি এমনকি এটাও জানতাম মা যে কেউ ইচ্ছে করলেই মানুষের হাতকে এভাবে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। আমি বসার ঘরের দিকে “মা! মা!” করে চিৎকার করে করে দৌড়ে গেলাম। আমার সৎ বাবা ঠিক আমার পিছনেই ছিলেন। তার বাঁহাতটা। কারণ সে ছিল বাঁহাতি। আর সে তার বাঁ হাত দিয়ে আমার গলা চিপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেশে ধরে আমার গোলা চিপে উপরে ঝুলিয়ে রাখল। আমি লাথি মারার চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। লোকটা চিৎকার করে নোংরা নোংরা গালি দিতে লাগলো। কিন্তু ওখানে সবমিলিয়ে এতোই হৈচৈ হচ্ছিল যে আমি কিছুই শুনতে পেলাম না।
“ ওহ বাবা! ওহ বাবা! দয়া করো আমাকে, আমাকে ক্ষমা করো। আমি প্রমিজ করছি তুমি যা বলবে আমি শুনবো। কথা দিলাম। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও”
এসব কিছুই আমি বলতে পারিনি। কারণ লোকটা আমার গোলা চিপে ধরে ছিল আর আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সম্ভবত আমি জ্ঞ্যান হারিয়েছিলাম। মেঝেতে সজোরে আছড়ে পড়ার পর আমি জ্ঞ্যান ফিরে পেয়ে হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“ ওরে কুত্তি বেশ্যা যদি আমি অনেকদিন বেঁচে থাকি তোকে আমি খুন করবোই!”
লোকটা আমার গলা চিপে ধরে আবার উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখল।
“কুত্তিটার সমস্যাটা কী? ও কেন তোর পিছনে সারাদিন ঘুরঘুর করে?”
এই পরিস্থিতিতে কেউ কোনো উত্তর আশা করে না।
তোমার বয়স যদি নয় বছর হয় তাহলে এক বোতল ভতকাই যথেষ্ট তোমাকে খুব করার জন্য। কিন্তু সেদিন বোতলের চার ভাগের একভাগ মাত্র ভরা ছিল। তবে সেটা প্রমাণ জন্য আমার তিন নম্বর কাজিনটা এক বোতল ভতকা খেয়ে আত্মহত্যা করলো। আমরা সবাই সেটা সম্পর্কে জানতে পারলাম এবং আত্মহত্যা করতে হলে কি কি করতে হয় সে সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই জানতে পারলাম। এবং প্রতি বছরই নতুন নতুন আইডিয়া পেতে লাগলাম।
তুমি বুঝতে পেরেছ সোনা! এভাবেই আমরা সবাই আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম।
আমাদের ক্যাবিনেটে সবসময় কোডিন থাকতো। বাচ্চাদের দাঁতের জন্য প্যারাগোরিক থাকতো। সেইসাথে বাসায় সবসময় হুইস্কি, বিয়ার এবং নানাধরনের মদ থাকতো। জেনি বাসায় এমডিএ, পিসিপি, এসিড, র্যান্ডল, ঘাস, স্পীড, ম্যাস্কেলিন রাখতো। এইসবগুলোই আমাদেরকে হতাশা থেকে বাঁচাত আর এগুলো ব্যাভার করেই আমরা সময় কাটাতাম।
চুরিচামারি করেও আমরা সময় কাটাচ্ছিলাম। যা আমাদের দরকার হতো তাই চুরি করতাম। আবার যা দরকার হোতো না সেসব জিনিসও। স্নায়ু ঠাণ্ডা রাখার জন্য এসব করতাম। আবার কখনো কখনো রাগ দমানোর জন্য বা শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর জন্যও করতাম। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম যে আমরা আসলে বড় হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যত যাইহোক না কেন আগেপিছে সবসময়ই ধরা খেতাম। আর সেভাবেই আমাদের শিক্ষা হোতো।
ধরা খেতাম আর ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটতো। পাগলের মতো অলিগলি খুঁজতাম বেঁচে পালানোর জন্য। মার্ক এবং লিউক মাত্র পনের বছর বয়সে এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য শুয়োরের মতো বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো। তাদেরকে কান কেটে মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো।
কী ব্যাপার বাচ্চাটা? তুমি কি নিতে পারছো না নাকি?
ষোল বছর বয়সে ধরা খাওয়ায় জুনকে জেসআপ বালিকা বিদ্যালয়ের হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ওখান থেকে তার বাচ্চাটাকে পালতে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে সে তার নিজের কব্জিকেই বিছানার স্প্রিং দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল।
লু ধরা খেলো সতেরো বছর বয়সে। একেবারে শহরের মাঝখানের স্টেশনের পায়খানার ট্যাংকির মেঝেতে ওকে ধর্ষণ করে ফেলে রাখা হয়েছিলো।
তুকি ছেলে নাকি মেয়ে? বলতো?
এতো অত্যাচার কি সহ্য করা যায়?
আঠারো বছর বয়সে ধরা খাওয়ায় জ্যাককে জেলখানায় পাঠান হয়েছিলো। ওখান থেকে ও সাত বছর পর সে একেবারে নির্বোধ অসহায় এক পাগলপ্রায় হয়ে ফিরল। ও বলতে গেলে কিছুই আর বুঝতে পারতো না। গ্রামের একটি শান্ত মেয়েকে ও বিয়ে করেছিল। এবং চার বছরের মধ্যে তিনটি সন্তানের বাবা হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ একদিন রাতে জ্যাক টেক্সটাইল মিল থেকে খুব উচ্চগতি সম্পন্ন স্প্লিন্ডেল ম্যাশিনের একটি বিশাল বড় হাতল খুলে নিয়ে আসলো। এরপর সেই হাতল দিয়ে সবাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলে সকালে আবার অফিসে কাজ করতে ফিরে গেলো।
আমার খালাতো বোন মেলভিনা মাত্র চোদ্দবছরে বিয়ে করে ফেলে। আড়াই বছরের মধ্যেই ও তিনটা বাচ্চার মা হয়ে গেলো এবং ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন তাদের সবাইকে নিয়ে চলে গেলো। সে একজন উৎসবগুলোতে মিস্ত্রীর কাজ করে এমন একজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো। মোটরসাইকেল নিয়ে সার্কাস করে বেড়ায় এমন একটি দলের সাথে সেই ম্যাকানিক মেলভিনা ও তার বাচ্চাদেরকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেলো। পালিয়ে যাওয়ার আগে তাদের আরও তিনটা বাচ্চা হয়েছিলো। ওয়েলফেয়ার তাদের দায়িত্বও নিয়ে নিল। কিন্তু পরের বাচ্চাটা হাইড্রোসেফালিক ছিল। মাথার মধ্যে অনেক পানি নিয়ে সে জন্মেছিল। আর এই বাচ্চাটিকেই ওয়েলফেয়ার মেলভিনার কাছে ফেলে রেখে গেলো। এবং তারপরের তিনটি এবং আরও একটি বাচ্চা হয়েছিলো যাকে ও ভীষণ ঘৃণা করতো। এবং আরও একটি বাচ্চা হয়েছিলো যার জন্মের আগে মেলভিনা বারান্দা থেকে পড়ে গিয়েছিলো। আর এই বাচ্চাটার বাবা যে কে সেটাই ও জানতো না।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, “তোমার আসলে সন মিলিয়ে কয়টা বাচ্চা?”
“তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছ? একসময় আমার কয়টা বাচ্চা ছিল সেটা? তাহলে চারটা। আর সবমিলিয়ে হলে এগারোটা।”
আমার যে খালাটির নামের সাথে মিলিয়ে আমার নাম রাখা হয়েছিলো সে একসময় ওকলাহোমা থেকে পালিয়ে গেলো। তার সবচেয়ে ছোট মেয়েছি হারিয়ে যাওয়ার পরপরই সে পালিয়ে গেলো। তারা আমার খালাকে বলেছিল যে বো ঠিক কাজ করেনি। সে বেশ কিছু বিস্কুটের প্যাকেট তার ব্যাগে ভরলো। সাথে নিলো ঠাণ্ডা মুরগীর মাংস, কোকা-কোলা, অনেকগুলো ঢিলাঢোলা জামাকাপড়। কোরা এবং তার মাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া ছোট্ট বাচ্চাটিকেও সাথে নিয়ে গেলো। এবং ছোট চারটি মেয়েকেও সাথে করে নিয়ে গেলো। তারা বিকেলবেলা এই উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো যেন সাপ্তাহিক ছুতির ভেতরেই ওকলাহোমায় পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু তারা কেবলমাত্র অগাস্টা পর্যন্তই পৌঁছাতে পেড়েছিল। আর ওখানকার ব্রিজটিতে ওঠার পরপরই ওটা ওদেরকে নিয়ে নদীর উপর ভেঙ্গে পড়লো।
আমার খালু সংবাদটি জানতে পেরে বলেছিল যে, “ঠিক হয়েছে। এটাই আল্লার বিচার।”
আমার খালা আর কোরা নদী থেকে সাঁতরে পাড়ে উঠে আসতে পেড়েছিল। খালার দুই মেয়ে অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করতে করতে নদীর পাড়ের আগাছার মধ্যে মিশে গিয়েছিলো। ওদের একজন সেই অন্ধকারেই চিরতরে হারিয়ে গেলো। আর একজন মেয়ে ন্যান্সি ওর সবচেয়ে ছোট বোন সাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত। ওদের লাশগুলো পানির ভেতর গাড়ির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো।
আমার কালাও ঠিক খালুর মতোই একই কথা বলেছিল, “সবই উপরওয়ালার ইচ্ছে। আর ওঁর মতো এতো মারাত্মক রসবোধ আর কার আছে বলুন?”
আমার বোনের বাচ্চাটা খুব খারাপ একটি বছরে জন্মালো। ছেলেটি জন্মানোর আগে আমরা এই ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম, “তুই কি খুব ভয় পাচ্ছিস রে?”
আমার বোন কিছু না বুঝেই আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়েই বলেছিল, “ দেখিস বাচ্চাটা ভালোই থাকবে। তুই এসব নিয়ে এতো ভাবিস না, আপু। আর আমাদের পরিবারে তো জারজ জন্ম দেওয়া একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।”
বাচ্চাটা ভালোই ছিল আসলে। আমাদের অনেকের মতোই পাটের মতো ফ্যাঁকাসে চুলওয়ালা শুঁটকাপটকা একটা বাচ্চা। কিন্তু পরবর্তীতে সেই দুর্ভাগ্যের বছরটিতে আমার বোনের ফুসফুসে প্লুরিসি রোগটি এবং মুত্রথলিতে সিস্টাইসিস রোগটি দেখা গেলো। ওর কোনো কাজ ছিল না আর ওর কাছে জীবনধারণের জন্য এমনকি নুন্যতম টাকাপয়সাও ছিল না গলে বাধ্য হয়েই শেষ পর্যন্ত আমার ছোট বোনকে আমাদের সেই বরফশীতল চোখের সৎ বাবার কাছেই ফিরতে হয়েছিলো।
ওকে দেখার জন্য আমাকে এমন একজন মহিলার কাছ থেকে আসতে হোতো যার সাথে আমি থাকতাম অথচ তাকে কখনোই ঠিক সহ্য করতে পারতাম না। আমার বোনের কাছে এসে আমাকে আমার সেই ভয়াবহ রুগ্ন ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে দোলাতে হোতো আর সেই সাথে আমি নিজেও দুলতাম।
হঠাৎ একদিন রাতে বীভৎস চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুনে আমি দৌড়ে ওর ঘরে ঢুকলাম। আমার ছোট বোন আর ওই অসুস্থ বাচ্চাটাই শুধু রুমের মধ্যে ছিল। চোখমুখ লাল টকটকে করে আমার বোন বাচ্চাটার ছোট্ট বিছানার পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গালাগালি করছিলো। “চুপ কর! চুপ কর! কুত্তার বাচ্চা।” বলে ও বাচ্চাটার কান বরাবর একের পর এক ঘুসই মেরে যাচ্ছিলো।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে এমনভাবে ওকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলাম যাতে ওর অপারেশনের সেলাই না ছিরে যায় সেদিকে খেয়াল রেখে বললাম, “এমন করিস না প্লিজ! এমন পাগলের মতো করিস না!” ও তখন আরেকটি হাত দিয়ে ওর অপারেশন করা পেটটাকে শক্ত করে আঁটকে রাখার চেষ্টা করছিলো আর আমাকে বাঁধা দেওয়ার মতো কোনো শক্তিই ওর আর অবশিষ্ট ছিল না। সে শুধু তখন চিৎকার করছিল আর কাঁপছিল।
“এই ছোট্ট জারজ সন্তানটি শুধু সারাক্ষণ চিৎকার করতে থাকে।” আমি এই ছোট্ট বেজন্মাটাকে মেরেই ফেলবো।”
এরপর সে আসতে আসতে থামতে লাগলো। সে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আমার দিকে তাকাল। এদিকে ওর ছেলেটা অনবরত চিৎকার করে করে হাতপা ছুড়তেই লাগলো।
তখনো ছেলেটার মাথায় এবং ম্যাট্রেসে আমার বোনের ঘুষির চিহ্ন রয়ে গেছে।
“ ওহ! আর পারি না! আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শান্ত হয়ে থাকার। আমি তো কখনোই এমন ছিলাম না।” বলে বলে আমার বোন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। এরপর সে তার পেটটা চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো, “আমরা দুজন তো আলাদা নই! আহ! আমরা দুজন তো কখনোই আলাদা নই।”
জেসি ওর পেট দিয়ে আমার পিছনে চাপ দিতে দিতে আমার কোমরটা ওর দুহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি রিল্যাক্স হয়ে ওর উপর নিজেকে সঁপে দিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি শিওর যে তোমার কোনো বাচ্চা হবে না? আমি অবশ্যই দেখতে চাই যে তোমার বাচ্চারা আসলে কার মতো হয়?”
আমি খুব দৃঢ়ভাবে বললাম, “আমার কখনোই বাচ্চা হবে না। আমি কোনোদিন বাচ্চা চাইনি।”
ও উত্তর দিলো, “তবুও! তুইমি আসলে বাচ্চাদের এতো ভালোবাসো! তুমি এতো নরম আর ভদ্র।”
আমি সারাক্ষণই চিন্তা করছিলাম আর আমার হাতটা ঘুষি মারার জন্য মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আর তখন আমি খুব কষ্টে নিজেকে সামলালাম। আমি বারবার আমার মুখটা খুলছিলাম আর বন্ধ করছিলাম কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। আমি এখন আসলে কী বা বলতে পারি? ওর সামনে আমি সারাক্ষণ বোবার মতো চুপ করে থাকলাম। একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারলাম না। আমি ওকে যা কখনোই বলতে পাড়ব না টা হচ্ছে আমার সমস্ত লজ্জাজনক কাহিনীগুলো আর আমার নিজের প্রতি ভয়াবহ ঘৃণার কথাগুলো। আর সেই সমস্ত ভয়ের কারণগুলো যা আমাদের দুজনের মধ্যে দেয়াল হয়ে বেঁড়ে উঠেছে। এম্নি এক শক্ত দেয়াল যা আমার পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়।
আমি ওর দিকে ফিরতে চাইলাম এবং ওর সাথে কথা বলতে চাইলাম। ওকে বলতে চাইলাম...। “আমার মাথার মধ্যে একটি ধুলোর নদী আছে। নামের একটি নদী অবিরাম পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। সেই ঘৃণ্য নোংরা পানি আমার ভেতরে আবারো জেগে উঠতে লাগলো। আর আমার স্মৃতির ভেতর সেইসব জীবন্ত বাচ্চাগুলো তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো। এবং আমি আক্ষরিক অর্থেই অন্য এক মানুষে পরিণত হলাম। এমন একজন মানুষে পরিণত হলাম যা আমি না হওয়ার জন্যই সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে গিয়েছিলাম।
কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। আর আমি খুব ভালো করেই জানি যে আমার কখনোই কোনও বাচ্চা হবে না। আর সেসব কোনো কথাই না বলে আমি আমাদেরকে গালাগালি করতে লাগলাম। আমি বলা শুরু করলাম যে মাই আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারছি না। আমার পক্ষে তোমাকে ভালোবাসা আর কখনো সম্ভব নয়। আর তোমার জীবনের এইসব রূপকথার কল্পকাহিনীর জন্য আমি তোমাকে আসলে ভীষণ ঘৃণা করতে শুরু করেছি। আর তোমার যে এতকিছু কল্পনা করার কোনো দরকারই ছিল সেটা তোমাকে জিজ্ঞেস না করার জন্য আর তোমার এই সরল নরম চিবুক যা খুব ভালোবাসি তার জন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি।
জেসি আমার কাঁধের পিছনে ওর হাতটা রাখল। আর হেসে হেসে বললো, “তুমিও না পারো সত্যি। যতসব হাস্যকর গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারো।”
আমিও আমার হাত দিয়ে ওর পিছনটা জড়িয়ে ধরলাম। আমি অনুভব করতে লাগলাম যে আমার হাতের আঙ্গুলগুলো সব আসতে আসতে ওর শরীরকে চাপ দিচ্ছে।
আমি ওকে বললাম “হুম! একেবারে ঠিক বলেছো। কিন্তু আমি তখনো আসলে মিথ্যেই বলেছিলাম।”
লেখক পরিচিতি
ডরথি এলিসন
আমেরিকান লেখক। জন্ম ১৯৪৯। শ্রেণী সংগ্রাম, যৌন নিগ্রহ, শিশু নিগ্রহ, নারীবাদ ও সমকাম তাঁর লেখার বিষয়। Bastard Out of Carolina তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।
আমেরিকান লেখক। জন্ম ১৯৪৯। শ্রেণী সংগ্রাম, যৌন নিগ্রহ, শিশু নিগ্রহ, নারীবাদ ও সমকাম তাঁর লেখার বিষয়। Bastard Out of Carolina তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।
অনুবাদক পরিচিতি
ফারহানা রহমান
কবি, গল্পকার, অনুবাদক। ঢাকায় থাকেন।
ফারহানা রহমান
কবি, গল্পকার, অনুবাদক। ঢাকায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ