মার্গারেট মিচেল'এর ধারাবাহিক উপন্যাস : যে দিন ভেসে গেছে--পর্ব ২৪



অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁয়ে পড়া প্রখর সূর্যের আলো স্কারলেটের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। দলামোচড়া করে শোওয়ার ফলে হাত পা বেশ আড়ষ্ট। কোথায় আছে প্রথমে বুঝতেই পারছিল না। চড়া আলোয় চোখ ঝলসে গেল। ওয়াগনের শক্ত পাটাতন গায়ে বিঁধছে। ভারি একটা অনুভুতি পায়ের ওপর। উঠে বসবার চেষ্টা করতেই দেখল ওয়েড ওর হাঁটুকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেলানির একটা পা প্রায় ওর মুখের সামনে ঝুলছে। প্রিসি কালো একটা বেড়ালের মত কুঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। ওয়েড আর প্রিসির মাঝখানে আটকে পড়ে বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে।

আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে গেল। উঠে বসে চট করে আশপাশটা দেখে নিল। ঈশ্বরের অপার করুণা, কোনও ইয়াঙ্কিকেই দেখা যাচ্ছে না! ভাগ্য ভাল, রাত্রে কেউ এই লুকোনোর জায়গাটার হদিশ পায়নি। ঘটনাগুলো এক এক করে মনে পড়তে লাগল। রেটের চলে যাওয়া; দুঃস্বপ্নের পথ চলা; খানাখন্দে ভর্তি অন্ধকার রাস্তা; টাল সামলে এগিয়ে চলা; রাস্তার দু’ধারে গভীর নালা; নালায় ওয়াগনের পড়ে যাওয়ার সেই ভয়ার্ত মুহুর্তটা; প্রিসির আর ওর চেষ্টায় ওয়াগনটাকে ঠেলেঠুলে রাস্তায় তোলা! সৈন্যদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে অনিচ্ছুক ঘোড়াটাকে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া! ঘটনাটা মনে পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। বন্ধু কী শত্রু কে জানে? একটু কাশির আওয়াজ – কি ওয়েডের হেঁচকি তোলার শব্দ – এক বিন্দু আসাবধানতা - ওরা ধরা পড়ে যেতে পারত!

দলটা পেরিয়ে গেল, প্রায় অশরীরী পদক্ষেপে – বলতে গেলে একেবারে ঘাড়ের ওপর দিয়েই – ওদের ঘামের গন্ধ পর্যন্ত নাকে এসে লাগছিল। ছোট ছোট কামান নিয়ে একদল অশ্বারোহী। নিঃশ্বাস নিতেও ভয় করছিল!

রাফ অ্যান্ড রেডির কাছাকাছি পৌঁছাল। দূরে কয়েকটা মশাল জ্বলছে। হয়ত স্টিভ লীর বাহিনীর রক্ষীদের দলের কিছু লোক পশ্চাদপসারণের নির্দেশের অপেক্ষা করছে। ক্ষেতের সীমানা ধরে ঘুরপথে প্রায় এক মাইল যাবার পর মশালের আলো আর দেখা গেল না। আর তখনই স্কারলেট বুঝতে পারল যে অন্ধকারে ওরা পথ হারিয়ে ফেলেছে। এত পরিচিত সেই ওয়াগন যাবার পথটা কিনা হারিয়ে ফেলল! স্কারলেটের কান্না পেয়ে গেল! খুঁজে পাওয়া গেল শেষমেশ, কিন্তু ঘোড়া বেঁকে বসল – দুজনে মিলে লাগাম ধরে হাজার টানাটানি করেও ক্লান্ত পশুটাকে বাগে আনতে পারল না।

হাল ছেড়ে দিয়ে পশুটার ধড়াচূড়া খুলে দিয়ে, ক্লান্ত, অবসন্ন, বিমর্ষ স্কারলেট ওয়াগনের পেছনে পা দুটো ছড়িয়ে দিল। চোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে আসার আগে এক আবছা স্মৃতি – মেলানির দ্বিধাজড়িত ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, “স্কারলেট একটু জল খাওয়াতে পারবে, প্লীজ়?”

জবাবে ও যেন বলেছিল, “একফোঁটাও জল নেই”, তারপর কথাটা ঠিকমত মুখ থেকে বেরোনোর আগেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিল।

সকালবেলায় সূর্যের সোনালী আলোয় পরিবেশ শান্ত আর সবুজ। স্কারলেট একবার চারপাশে নজর করে দেখল। সৈন্যদলের কাউকেই দেখতে পেল না। জোর খিদে পেয়েছে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সারা গায়ে বেদনা। অবাক হয়ে ভাবল যে ও কিনা স্কারলেট ও’হারা –পরিপাটি করে পাতা পালকের নরম বিছানা ছাড়া ঘুমোতে পারে না, সে কিনা কাল সারা রাত ক্ষেতের মজুরদের মত শক্ত কাঠের পাটাতনের ওপর শুয়ে ঘুমিয়েছে!

আলোতে ঝলসে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতেই মেলানির ওপর চোখ পড়ে আঁতকে উঠল। এমন নিঃস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছে! আর এত ফ্যাকাসে লাগছে? মরে-টরে গেল নাকি? যেন একটা বুড়ি মরে পড়ে আছে – জট পাকানো কালো চুল বিধ্বস্ত মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়া। তারপর বুকের হালকা ওঠা নামা খেয়াল করল। যাক বাবা, মেলানি কোনোক্রমে রাতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে!

হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে স্কারলেট আবার চারপাশটা দেখে নিল। কারুর বাড়ির সামনের উঠোনের একটা গাছের তলায় ওরা রাতটা কাটিয়েছে। সেডার গাছ শোভিত বালি আর নুড়িপাথর দিয়ে তৈরি একটা ড্রাইভওয়ে।

“আরে এটা তো ম্যালরিদের বাড়ি,” খুশিয়াল হয়ে উঠল। বন্ধু যখন সাহায্যের আশা করাই যায়!

পুরো প্ল্যান্টেশন জুড়ে মৃত্যুর স্তব্ধতা! লনের ঘাস আর গুল্ম ঘোড়ার গাড়ির চাকায় পিষে একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় মাটি দলা পাকিয়ে উঠে এসেছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বাড়িটা নজর করবার চেষ্টা করল। কোথায় সেই চেনা দোতলা সাদা বাড়িটা? গ্র্যানাইট পাথরের মূল ভিতটুকু শুধু থেকে গেছে আর দুটো লম্বা চিমনির পেছনে সামান্য ইটের কাঠামো!

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। তাহলে কি টারাতেও এরকমই এক দৃশ্য অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য? মৃত্যুর নীরবতা বুকে নিয়ে ধুলোয় মিশে গেছে টারা?

“না না এখন এসব কথা একদম ভাবব না,” অশুভ ভাবনাকে মন থেকে সরিয়ে দিল তাড়াতাড়ি। এসব একদম ভাবতে চাই না। তাহলে দুর্বল হয়ে পড়ব।” তবুও মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকল। “আমাকে বাড়িতে পৌঁছাতেই হবে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!”

সময় নষ্ট না করে আবার চলা শুরু করতে হবে। তার আগে কিছু পেটে পড়া দরকার। জল খাওয়া তো খুব দরকার! ডাকাডাকি করে প্রিসিকে ঘুম থেকে তুলল। ঘুম জড়ানো চোখে প্রিসি একবার চারদিকে তাকাল।

“হে ভগবান, মিজ় স্কারলেট! আমি এখন জাগতে চাইনা – যতক্ষণ না ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’তে পৌঁছাচ্ছি।”

সেটা এখনও অনেক দূরে,” হাত দিয়ে অবিন্যস্ত চুলগুলো ঠিক করতে করতে স্কারলেট বলল। মুখটা তেল তেল করছে, শরীর ঘামে জবজব করছে। বড় অপরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল নিজেকে। গা থেকে বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। জামাকাপড় একদম কুঁচকে গেছে। জীবনে এত ক্লান্ত বোধ করেনি কখনও। অনভ্যস্ত পরিশ্রমে পেশীতে টান ধরেছে। ব্যথা সারা গায়ে।

মেলানির দিকে তাকিয়ে দেখল ওর গভীর চোখদুটো খোলা। অসুস্থ চোখ, ছলছল করছে, চোখের নীচে কালি পড়েছে। ঠোটদুটো ফাঁক করে মিনতি করে বলল, “একটু জল।”

“উঠে পড়্‌ প্রিসি,” স্কারলেট হুকুম করল। “চল্‌ দুজনে মিলে কুঁয়ো থেকে জল তুলে আনি।”

“কিন্তু মিজ় স্কারলেট! যদি ভূত-পেত্নী থাকে? কে জানে কারা ওখানে মরে পড়ে আছে!”

“ওয়াগন থেকে এখুনি যদি না নামিস, তাহলে তোকেই আমি পেত্নী বানিয়ে ছাড়ব,” স্কারলেটের তখন তর্কাতর্কি করবার ইচ্ছে মোটেও নেই। নিজেও খোঁড়াতে খোঁড়াতে নীচে নেমে এল।

ঘোড়াটার কথা মনে পড়ল। হে ভগবান! ঘোড়াটা রাত্রে মরে যায়নি তো! বাঁধন খুলে দেবার সময় মনে হচ্ছিল যেন বেচারা মরে বাঁচতে চায়। ওয়াগনের চারপাশে চক্কর দিয়ে খুঁজল ঘোড়াটাকে। কাত হয়ে শুয়ে আছে। মরে গিয়ে থাকলে ঈশ্বরকে অভিশাপ দেওয়া কিংবা নিজে মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথই নেই। বাইবেলেও পড়েছিল না, একজন এরকমই করেছিল! ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন? সে বেচারার মনের অবস্থা কল্পনা করা মোটেই শক্ত নয়! যাক ঘোড়াটা বেঁচেই আছে! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, অসুস্থ চোখদুটো আধখোলা। ওরও একটু জল খাওয়া দরকার।

বেজার মুখে, কাঁদতে কাঁদতে প্রিসিও ওয়াগন থেকে নেমে ভীরু পদক্ষেপে স্কারলেটের পেছন পেছন গেল। ভগ্নস্তূপের পেছনে ক্রীতদাসদের পরিত্যক্ত সাদা সাদা কোয়ার্টারগুলো গাছপালার ফাঁকে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিক দিয়ে এগোতেই বাড়িটার ভগ্নস্তূপের পাশেই ওরা একটা কুঁয়ো খুঁজে পেল। কুঁয়োর ছাদের থেকে দড়ি বাঁধা বালতিটা একেবারে কুঁয়োর তলায় পড়ে আছে। দড়ি টেনে বালতিটা ওপরে তুলল। অন্ধকার গহ্বর থেকে ওঠা ঠাণ্ডা জল স্কারলেট সশব্দে নিজের গলায় ঢেলে দিল। কিছুটা জল ওর গায়ের ওপর ছলকে পড়ল।

জল খাওয়া আর শেষই হয় না। প্রিসি যখন খিটখিটে গলায় বলল, “আমারও তেষ্টা পেয়েছে, মিজ় স্কারলেট”, তখন হুঁশ ফিরল যে অন্যদেরও জল খাবার প্রয়োজন আছে।

“দড়িটা খুলে বালতিটা নিয়ে সবাইকে জল খাওয়া। বাকি জলটা ঘোড়াটাকে দিস। মেলানিরও তো বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হবে, তাই না? নইলে ও তো উপোস করে থাকবে।”

“না, মিজ় স্কারলেট। মিজ় মেলানির একটুও দুধ নেই – বাচ্চাটা একফোঁটাও খেতে পাবে না।”

“তুই কী করে জানলি?”

“আমি ওঁর মত আরও অনেককে দেখেছি।”

“বেশি বড় বড় কথা বলিস না। বাচ্চাদের ব্যাপারে তুই কত জানিস, সেটা কালই বোঝা গেছে। এখন তাড়াতাড়ি যা। আমি দেখি কিছু খাবার জোগাড় করতে পারি কিনা।”

অনেক চেষ্টার পর ফলের বাগান থেকে কয়েকটা আপেল জোগাড় করল। সৈন্যরা আগেই এসে সব সাবাড় করে দিয়েছে। গাছে কিছুই প্রায় নেই। মাটিতে পড়ে থাকা আপেলগুলোর বেশির ভাগ পচে গেছে। তার মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত ভালগুলো বেছে নিয়ে কোঁচড়ে রাখল। নরম মাটির পথ দিয়ে ফিরতে ফিরতে ওর স্লিপারের ভেতরে অনেক কাঁকর ঢুকে গেল। কেন যে আরও একটু শক্ত জুতো পরে আসেনি! কেন যে রোদটুপিটা নিয়ে আসেনি! খাবার জন্যও কিছু নিয়ে আসেনি! একেবারে বোকার মত কাজ করেছে! অবশ্যই আশা করেছিল যে রেট ঠিক ওদের খেয়াল রাখবেন।

রেট! নামটা মনে আসতেই ঘেন্নায় রাস্তার ওপর থুতু ফেলল। নামটাই অসহ্য! অত্যন্ত ঘৃণ্য লোক! নীচ প্রকৃতির মানুষ! আর ও কিনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওঁকে চুমু খেতে দিয়েছে! আর সেটা কিনা ওর ভালও লেগেছিল! নাহ্‌ কাল রাতে ওর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছিল। এক নম্বরের লুচ্চা!

ফিরে এসে আপেলগুলো ভাগ করে নিয়ে বাড়তি আপেলগুলো ওয়াগনের পেছনে রেখে দিল। ঘোড়াটা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তবুও জল খাবার পরেও খুব একটা চাঙ্গা লাগছে না। রাতের অন্ধকারের তুলনায় দিনের আলোয় ওটার অবস্থা আরও করুণ লাগছে। বুড়ো গরুর মত ওর পেছনের হাড়গুলো বেরিয়ে আছে, পাঁজরের হাড়গুলো জিরজিরে, আর পিঠ ভর্তি দগদগে ঘা। লাগাম পরানোর সময় ওর গায়ে হাত লাগাতে অস্বস্তি হচ্ছিল। লাগামের দড়িটা মুখের ভেতর ঢোকাতে গিয়ে লক্ষ্য করল ঘোড়াটা প্রায় ফোকলা। সামনের ওই পাহাড়গুলোর থেকেও বেশি পুরোনো! রেট যদি সেই ঘোড়া চুরিই করলেন, একটু ভাল দেখে করতে পারলেন না?

গাড়িতে বসে গাছের ডালটা দিয়ে স্কারলেট ঘোড়াটার পিঠের ওপর মারল। ঘোড়াটা চলতে শুরু করল। তারপর স্কারলেটের একটা চেনা রাস্তায় ওকে ঘুরিয়ে দিতেই ঘোড়াটা এমনই ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলতে লাগল, যে ওর মনে হল হেঁটে গেলে এর চেয়ে তাড়াতাড়ি হবে। ইশ্‌, যদি ওকে মেলানি, ওয়েড, বাচ্চাটা আর প্রিসির কথা না ভাবতে হত! কত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেতে পারত! দৌড়ে দৌড়ে চলে যেত। প্রত্যেক পদক্ষেপে ও টারার নিকটবর্তী হতে থাকত। আর মায়েরও!

বাড়ি থেকে এখন পনেরো মাইলের থেকে বেশি দূরে ওরা নেই। এরকম ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চললে সেই পথটুকু যেতেই সারাদিন লেগে যাবে। ওটাকে বিশ্রাম দেবার জন্য মাঝে মাঝে থামতেও হবে যে! সারাটা দিন! উজ্জ্বল লালমাটির রাস্তাটার দিকে তাকাল। কামান আর অ্যাম্বুলেন্সের চলাচলে গভীর খাদ তৈরি হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের কাঠফাটা রোদ্দুরের মোকাবিলা করে যাত্রা শেষ হতে অনেকটাই সময় লাগবে। তারপরই জানা যাবে টারা আর আছে না নেই!

ঘাড় ঘুরিয়ে মেলানির দিকে তাকাল। রোদ থেকে বাঁচবার জন্য অসুস্থ চোখদুটো বন্ধ করে আছে। এক টানে ফিতেটা খুলে বনেটটা প্রিসির দিকে ছুঁড়ে দিল।

“ওর চোখটা ঢেকে দে এটা দিয়ে, যাতে রোদ না লাগে।” অনাবৃত মাথায় যেই রোদের তাপ ঝরে পড়ল, ওর মনে হল যে দিনটা শেষ হবার আগেই ওর মাথায় ফোস্কা পড়ে যাবে।

জীবনে কখনওই স্কারলেট টুপি কিংবা শিরাবরণ ছাড়া রোদে বেরোয়নি। হাতের সাদা চামড়া সুরক্ষিত রাখার জন্য দস্তানা ছাড়া লাগামও ধরেনি। আর এখন একটা ভাঙ্গা ওয়াগনে, একটা অসুস্থ ঘোড়ার ওপর ভরসা করে, গরমে ঘেমে, খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে অসহায়ভাবে শামুকের গতিতে জনশূন্য রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে! এই তো অল্প কিছুদিন আগেও ও কত নিরাপদ ছিল, নিশ্চিন্ত ছিল! এই তো কিছুদিন আগেও ওর সব কিছুই ছিল আর মনে মনে ভরসা ছিল যে অ্যাটলান্টার পতন কিছুতেই হতে পারে না। তাহলে জর্জিয়াও বেঁচে যাবে। কিন্তু মাসচারেক আগে যে বিপদের সম্ভাবনা ছোট্ট মেঘের আকারে দেখা দিয়েছিল, সেটাই দেখতে দেখতে তুমুল ঝড়ের আকার নিয়ে ওর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। নিরাপদ আশ্রয় থেকে ছিটকে একেবারে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি।

টারা কি এখনও মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে? নাকি জর্জিয়ার ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তাতেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে? কে জানে?

ক্লান্ত ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষিয়ে দিয়ে ওটাকে এগিয়ে যাবার আর্জি জানাল। ওয়াগনের নড়বড়ে চাকাগুলো এবড়ো খেবড়ো রাস্তার ওপর দিয়ে মাতালের মত টলতে টলতে গড়িয়ে চলল।

***

বাতাসে মৃত্যুর ছোঁয়া। পড়ন্ত বিকেলের ম্লান সূর্যালোকে পরিচিত ক্ষেত আর সবুজ বনানীর নিস্তব্ধতা স্কারলেটের বুকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করল। গোলা বিধ্বস্ত খালি বাড়িগুলো, নিভে থাকা কালো কালো চিমনীগুলো পেরিয়ে যেতে যেতে, সেই আতঙ্ক ওকে আরও বেশি করে গ্রাস করল। কাল রাত থেকে রাস্তার ওপর মাছি ভনভন করা মানুষ, ঘোড়া আর খচ্চরের অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে, কিন্তু একটাও জীবন্ত প্রাণী নজরে আসেনি। একবারের জন্যও দূর থেকে গরু বাছুরের হাম্বারব অথবা পাখীদের কলকাকাকলি ভেসে আসেনি। একটা গাছের পাতাও বাতাসে নড়েনি। ক্লান্ত ঘোড়াটার খটখট করে খুরের শব্দ, আর মাঝে মাঝে মেলানির বাচ্চার ক্ষীণস্বরে কেঁদে ওঠা – এছাড়া চারদিক একেবারেই নিস্তব্ধ।

কে জানে কার অভিশাপে প্রকৃতির বাকরোধ হয়ে গেছে! দুঃসহ কষ্টের অবসানে মৃত্যুরূপী মুক্তির নিঃশব্দ অভিসার! ভাবতে গিয়ে স্কারলেটের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! এক অশরীরী মৌনতা চিরচেনা এই বনভুমিকে এক অচেনা আবরণে বদ্ধ করে ফেলেছে। মৃত মানুষের প্রেতাত্মারা যেন ওদের এই ভাঙ্গা ওয়াগনে করে যাওয়ার ওপর অলক্ষ্যে নজর রেখে চলেছে।

“মাগো! মা!”, মনে মনে ডাকল। যদি চোখের পলকে এলেনের কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত! যদি টারা অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়ে থাকে! গাছের সারির ভেতর দিয়ে চওড়া রাস্তা বেয়ে বাড়ি পৌঁছে মায়ের কোমল মুখটা যদি দেখা যেত! মায়ের সাহস যোগানো হাতের স্পর্শ লাভ করত! এলেনের বুকে মাথা গুঁজে বিশ্রাম নিতে পারত! মা ঠিক জানেন যে কী করতে হবে। উনি কিছুতেই মেলানি আর ওর বাচ্চাকে মরে যেতে দেবেন না। ওঁর বকুনিতে সব প্রেতাত্মারা পালিয়ে যাবে! মা যে অসুস্থ, কে জানে হয়ত বা মৃত্যুশয্যায়!

স্কারলেট আবার জোরে চাবুক চালাল। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। সারাদিন ধরে অসহ্য গরম মাথায় করে এই রাস্তা ধরে যেতে হচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে অন্ধকার হয়ে যাবে। এই ধুধু প্রান্তরে আবার ওরা একা হয়ে যাবে! ফোস্কা পড়া হাত দিয়ে লাগামটা শক্ত করে টেনে ধরে ঘোড়ার পিঠের ওপর চাপড় দিতে লাগল। হাত নাড়ালেই ব্যথা লাগছে।

যদি এক ছুটে টারার নিরাপদ আশ্রয়ে মায়ের কাছে পৌঁছে গিয়ে সব বোঝা হালকা করে ফেলা যেত! বয়সের তুলনায় খুব ভারি যে এই বোঝা – মৃতপ্রায় একজন মহিলা, দুধের শিশু, ওর নিজের ক্ষুধার্ত ছেলে আর ভয় পেয়ে যাওয়া এক নীগ্রো মেয়ে – এরা প্রত্যেকেই ওর মুখে চেয়ে সাহস পাচ্ছে! ভরসা করছে! সত্যি বলতে কী সাহস কি ওর কোনোকালে ছিল? আর ভরসা দেবার শক্তিও যে ও হারিয়ে গেছে গত কয়েকদিনের ডামাডোলে!

ক্লান্ত ঘোড়াটা চাবুককেও আর গ্রাহ্য করছে না, ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে, বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে চলছে – যেন একটু সুযোগ পেলে চিৎপাত হয়ে পড়ে যাবে। তা সত্ত্বেও সন্ধ্যের আগেই ওদের যাত্রাপথ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ওয়াগনের সরু পথ থেকে একটা বাঁক নিয়ে ওরা বড় রাস্তায় পড়ল। এখান থেকে আর বড় জোর এক মাইল!

কমলা রঙের বেড়া দিয়ে ঘেরা ম্যাকিন্টশদের জমিদারির সীমানা চলে এল। আরও একটু এগিয়ে এসে ওক গাছের সারির ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেখানে স্কারলেট ঘোড়ার লাগামের রাশ টেনে ধরল। এই রাস্তার শেষে বুড়ো অ্যাঙ্গাস ম্যাকিন্টশের বাড়ি। বিকেলের ম্লান আলোয় বুড়ো গাছের সারির ফাঁক দিয়ে তাকাল। অন্ধকার। একটাও আলো জ্বলছে না অতীত দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে ভাঙ্গা দোতালা বাড়িটার পেছন থেকে দুটো চিমনি দেখা গেল। বাড়ির জানলাগুলো ভেঙ্গে গেছে। আলো জ্বলার চিহ্ন নেই।

“কেউ আছ নাকি!” গলার সবটুকু জোর লাগিয়ে ও চেঁচিয়ে উঠল। “কেউ আছ?”

প্রিসি ওর হাতটা চেপে ধরল। মুখ ফিরিয়ে স্কারলেট দেখল ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেছে।

“চেঁচাবেন না, মিজ় স্কারলেট, প্লীজ়! দয়া করে ওরকম করে চেঁচিয়ে উঠবেন না!” ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল। “আপনার ডাক শুনে প্রেতাত্মারা বেরিয়ে আসবে!”

স্কারলেট শিউরে উঠল ওর কথা শুনে। ঠিকই বলেছে, ওই ভূতুড়ে বাড়ি থেকে যে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে!

লাগাম ধরে ঘোড়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। ম্যাকিন্টশদের বাড়ির অবস্থা দেখে মনে মনে যে আশার আলো জ্বলছিল সেটাও নিবে গেল। সব প্ল্যান্টেশনই পুড়ে খাঁক হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা মানুষেরও দেখা নেই। টারা তো আর মাত্র আধ মাইল দূরে! এই রাস্তার ওপরেই পড়ে। সৈন্যবাহিনী তো এই রাস্তা ধরেই গেছে। টারাও তাহলে মাটিতে মিশে গেছে। পুড়ে যাওয়া কালো ইট, ছাদহীন দেওয়াল, এলেন আর জেরাল্ড নেই, ম্যামি নেই, সব নীগ্রোরা চলে গেছে – কে জানে কোথায় – আর চারদিক নিস্তব্ধ – এটাই তার মানে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে!

কেন যে বোকার মত এল বুদ্ধিশুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে – এমনকি মেলানিকেও ওর দুধের শিশুসমেত টেনে নিয়ে এল! এর থেকে অ্যাটলান্টাতেই ওদের মরে যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে এই রোদের তাপ, ওয়াগনের লটরপটর করে চলা সহ্য করতে হত না। টারার ধ্বংসাবশেষ দেখতে হত না!

অ্যাশলে মেলানিকে ওর জিম্মায় রেখে গেছে। সেই মধুর অথচ বেদনাতুর দিনে চুম্বন করে বিদায় নেবার সময় বলে গেছিল, “ওকে তুমি দেখো”। তারপর চিরদিনের মত হারিয়ে গেল! “তুমি ওর খেয়াল রাখবে! আমাকে কথা দাও!” স্কারলেট কথা দিয়েছিল। কেন যে কথা দিয়েছিল! আর এখন অ্যাশলে না থাকায় সেই কথা রাখার দায় শতগুণে বেড়ে গেছে। এই যে ওর এত ক্লান্তি, তবুও মেলানিকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে ও, ওর বাচ্চার মিনমিনে কান্নার শব্দ ভাল লাগে না! কিন্তু কথা যখন দিয়ে ফেলেছে, তখন ওয়েড আর প্রিসির সঙ্গে ওদের সমস্ত দায়িত্বও ওর ওপরেই বর্তেছে। যতক্ষণ ও বেঁচে থাকবে ততক্ষণ ওদের রক্ষা করার দায়িত্ব ওরই। অ্যাটলান্টাতেই ওদের রেখে আসতে পারত, মেলানিকে হাসপাতালে ফেলে আসতে পারত। কিন্তু সেটা করলে ও কখনও অ্যাশলের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই পারত না – মরে যাবার পরও যদি ওর সাথে দেখা হত তাও পারত না। বলতেই পারত না যে ওর বউ আর ছেলেকে প্রতিকূল অবস্থায় মরবার জন্য ফেলে রেখে এসেছিল।

“ওহ অ্যাশলে! তুমি আজ কোথায়? যখন আমি তোমার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এত কষ্ট করে এই দুর্গম পথ পেরোচ্ছি, তখন তুমি কি রক আইল্যাণ্ডের জেলখানায় বসে আমার কথা একবারও ভাবছ? নাকি তুমি গুটি বসন্ত হয়ে মরে গেছে অনেক মাস আগে, আর তোমার শরীর অন্য কনফেডারেটদের সঙ্গে কোনও পরিখায় পড়ে পচে যাচ্ছে?”

ঝোপের কাছ থেকে হঠাৎ একটা আওয়াজ আসতেই স্কারলেট একদম চমকে উঠল। প্রিসি হাউমাউ করে ওয়াগনের মেঝেয় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাচ্চাটা ওর নীচে চাপা পড়ে গেল। মেলানি দুর্বল ভাবে নড়াচড়া করে হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে খুঁজতে লাগল। ওয়েড দু’হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল, কিন্তু ভয়ে মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটাও করল না। একটা মৃদু হাম্বাধ্বনি। খুরের চাপে ঝোপটা পিষে গেল।

“ওহ, একটা গরু,” স্কারলেটের স্বরে তখনও উৎকণ্ঠা। “প্রিসি বোকার মত কাজ করিস না। তুই বাচ্চাটাকে একেবারে চেপে দিয়েছিস, আর মেলি আর ওয়েডকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিস।”

“ওটা ভূত,” ওয়াগনের পাটাতনের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে প্রিসি কেঁদে ফেলল।

স্কারলেট ঘুরে গিয়ে, যে ডালটা দিয়ে ঘোড়ার চাবুকের কাজ করছিল, সেটা সজোরে প্রিসির পিঠে বসিয়ে দিল। ও নিজেই এত ভয় পেয়ে আছে আর এত ক্লান্ত, যে অন্য কারও দুর্বলতা সহ্য করা মুশকিল।

“উঠে বস, বলছি, নইলে এটা আমি তোর পিঠে ভাঙব।”

কাঁদতে কাঁদতে উঠে বসে ওয়াগনের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখল সত্যিই ওটা একটা লাল সাদা রঙের গরু। খুব করুণ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার খুব আস্তে করে ডাকল। মনে হল কোনও কারণে ওর খুব ব্যথা লাগছে।

“ওটার চোট লেগেছে বলেই মনে হচ্ছে। ডাকটা স্বাভাবিক নয়।”

“মনে হচ্ছে অনেক দুধ জমে গিয়ে ও কষ্ট পাচ্ছে। দুধটা দুয়ে নেওয়া দরকার।” প্রিসি আস্তে আস্তে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই মিস্টার ম্যাকিন্টশদের গরু, কোনও নিগ্রো জঙ্গলে তাড়িয়ে নিয়ে গেছিল, যাতে ইয়াঙ্কিরা ওটাকে খুঁজে না পায়।”

“আমরা ওটা সঙ্গে নিয়ে যাব,” স্কারলেট তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলল। “তাহলে বাচ্চাটা একটু দুধ খেতে পারবে।”

“কিন্তু গরু আমরা কী করে সঙ্গে নিয়ে যাব, মিজ় স্কারলেট? সাথে গরু নেওয়া যাবেই না। ইদানিং ওর দুধ দোয়ানো হয়নি বলে থলিটা ভরে গেছে। তাই ও চেঁচাচ্ছে।”

“তুই যখন এত কিছুই জানিস, তাহলে তোর পেটিকোটটা ছিঁড়ে গরুটাকে ওয়াগনের সাথে বেঁধে নে।”

“আপনি জানেন, মিজ় স্কারলেট গত এক মাস ধরে আমার কোনও পেটিকোট নেই। তাছাড়া আমি বাঁধতেও পারতাম না। আমি গরু নিয়ে কখনও কাজ করিনি। আমি গরুকে ভয় পাই।”

স্কারলেট লাগামটা নামিয়ে রেখে স্কার্টটা তুলল। ভেতরের লেস দেওয়া পেটিকোটটাও ওর একমাত্র পোশাক যেটা খুবই সুন্দর আর এখনও আস্ত আছে। কোমরের ফিতেটা খুলে নরম লিনেনটা মুঠোয় ধরে পায়ের ওপর দিয়ে ফেলে দিল। নাসাউ থেকে রেট এই লিনেনটা ওর জন্য নিয়ে এসেছিলেন, যেবার উনি শেষবারের মত অবরোধের ফাঁক দিয়ে ওঁর শেষ জাহাজটা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। প্রায় এক সপ্তাহের মেহনতে ও এটা সেলাই করেছিল। হাত দিয়ে ধরে আর দাঁত দিয়ে কামড়ে ও কাপড়টাকে ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর একটার সাথে আরেকটা গিঁট দিয়ে জুড়তে গিয়ে হাতের ফোস্কা ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। অবসন্ন লাগছিল খুবই।

“এটা ওর শিংএর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দে,” প্রিসিকে বলল। কিন্তু প্রিসির নড়বার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না।

“আমি গরুকে ভয় পাই, মিজ় স্কারলেট। আমি কখনও গরু নিয়ে কাজ করিনি। আমি খেতের মজুর নই। আমি বাড়ির কাজ করেছি।”

“তুই এক নম্বরের বুদ্ধু নিগার, আর তোকে কিনে নেওয়াটাই বাপীর সব থেকে ভুল হয়েছে!” স্কারলেট আস্তে আস্তে বলল, যেন চেঁচামেচি করতেই যে পরিশ্রম করতে হয় সেটা করতেও ওর ইচ্ছে করছে না। “আমার হাতটা ভাল হয়ে গেলেই এই চাবুকটা তোর পিঠে আমি ভাঙব।”

কথাটা বলেই ওর মনে হল ও “নিগার” কথাটা বলে ফেলেছে, যেটা মা একেবারে পছন্দ করবেন না।

প্রিসি গোলগোল চোখ করে একবার স্কারলেটকে আর তারপরে গরুটাকে দেখল – যেটা আর্তনাদ করেই চলেছে। মনে হল এই দু’জনের মধ্যে স্কারলেটই কম বিপজ্জনক, তাই ওয়াগনের পাটাতন ধরে চুপচাপ বসে থাকল।

স্কারলেট ব্যথাভরা শরীর নিয়ে ওয়াগন থেকে নামল। প্রিসিই যে কেবল গরুকে ভয় পায় তা নয়, স্কারলেটও সব সময়ই গরুকে ভয় পেয়েছে আর দূরে দূরে থেকেছে। খুব শান্ত গরুও ওর কাছে ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে এই সব ছোটখাট ভয়কে পাত্তা দিলে চলবে না, বিশেষত, ওর মন এখন অনেক বড় আতঙ্কে ভারাক্রান্ত। ভাগ্য ভাল যে গরুটা খুবই শান্ত। ব্যথার তাড়নায় ওটা মানুষের সঙ্গ আর সাহায্য চাইছিল, তাই কোনও রকম বাধা না দিয়েই স্কারলেটকে শিংএর মধ্যে পেটিকোটের দড়িটা গলাতে দিল। দড়ির অন্য প্রান্ত ওয়াগনের পেছনে বেঁধে দিল। অনভ্যস্ত হাতে যতখানি ভাল করে বাঁধা যায়। আবার ও চালকের জায়গায় ফিরে এল। শ্রান্তিতে মাথাটা পাক দিচ্ছে। ওয়াগনের একটা দিক শক্ত করে ধরল, পাছে পড়ে যায়।

মেলানি চোখ খুলে স্কারলেটকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “সোনা – বাড়ি পৌঁছে গেছি আমরা?”

বাড়ি! স্কারলেটের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল। মেলানি জানেই না যে বাড়ি বলে আর কিছু নেই। এই উন্মাদ পৃথিবীতে ওরা খুবই একলা আর নিঃসঙ্গ।

“এখনও পৌঁছাতে পারিনি,” যতখানি সম্ভব কোমল ভাবে বলল, “তবে শিগগিরই পৌঁছে যাব। একটা গরু পেয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি তোমার আর তোমার বাচ্চার জন্য একটু দুধের ব্যবস্থা করা যাবে।”

“বেচারা,” চাপা গলায় মেলানি বলল। বাচ্চার দিকে দুর্বলভাবে হাত বাড়াল, কিন্তু পৌঁছোতে পারল না।

মনকে খুব শক্ত করে স্কারলেট আবার ওয়াগনের কাছে গেল। আবার লাগাম হাতে তুলে নিল। মাথা নীচু করে হাল ছেড়ে দিয়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে। চলবার ইচ্ছেটাই ছিল না। স্কারলেট নির্দয় ভাবে ওর পিঠে চাবুক বসিয়ে দিল। মনে মনে ক্লান্ত একটা জীবকে কষ্ট দেবার জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল। যদি উনি ক্ষমা না করেন তো ও নাচার। যতই হোকে টারা তো এসেই গেল, আর আধ মাইল গিয়ে ঘোড়াটা যত খুশি আরাম করতে পারবে।

অবশেষে ওটা শ্লথগতিতে চলতে শুরু করল। ওয়াগন ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে চলল, আর গরুটা প্রতি পদক্ষেপে করুণ ভাবে ডাকতে লাগল। ডাকটা স্কারলেটের স্নায়ুর ওপর এতই চাপ তৈরি করছিল যে একবার ভাবল ওয়াগন থেকে নেমে গিয়ে দড়িটা খুলে দেয়। টারাই যদি না থাকে তো গরু নিয়ে গিয়ে কিইবা লাভ হবে? ও তো আর ওর দুধ দুইতে পারবে না। আর যদি পারেও, পশুটা কি ওর যন্ত্রণাদায়ক বাঁটে হাত দিলেই একটা লাথি মেরে সরিয়ে দেবে না! তবে পাওয়াই যখন গেছে গরুটা, তখন বরং থাক ওটা। এই বিশাল পৃথিবীতে নিজের বলতে আর কী রইল!

***

ঢালু জমিটা পার হলেই টারা! ওর চোখদুটো সজল হয়ে উঠল। ভয় হল এই দুর্বল জীবটা ওই টিলা বেয়ে ওপরে উঠতে পারবে তো? আগে যখন ওর চনমনে ঘোড়ায় চড়ে লাফিয়ে এই টিলা বেয়ে উঠে যেত, তখন ওটা উঁচু বলে মনেই হত না। এখন ওটা এত খাড়া মনে হচ্ছে। কী করে এই ঘোড়াটা এই খাড়াই বেয়ে উঠবে!

ক্লান্তভাবে ওয়াগন থেকে নেমে ঘোড়ার লাগামটা টেনে ধরল। হুকুম দিল, “নেমে আয় প্রিসি। আর ওয়েডকেও নামিয়ে আন। বাচ্চাটাকে মেলানির পাশে শুইয়ে দে।”

ওয়েড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছু বলছে। স্কারলেটের মনে হল ওয়েড বলছে, “কত অন্ধকার! ওয়েড ভয় পাচ্ছে!”

“মিজ় স্কারলেট, পায়ে এত ফোস্কা পড়েছে, জুতোটাও পরতে পারছি না – আমি হাঁটতে পারব না। ওয়েড আর আমি তো হাল্কা __”

“নেমে আয় বলছি, নইলে তোকে টেনে নামাব আর এখানে এই অন্ধকারের মধ্যে একলা ফেলে রেখে যাব, বুঝলি? তাড়াতাড়ি কর!”

ঘ্যানঘ্যান করতে করতে প্রিসি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারির দিকে তাকাল। রাস্তার দু’ধার থেকে এমন ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে যে প্রিসির মনে হল ওয়াগন থেকে নামলেই গাছগুলো ওকে জাপটে ধরবে। তবুও বাচ্চাটা মেলানির জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে মাটিতে নেমেই পড়ল। হাত বাড়িয়ে ওয়েডকেও টেনে নামাল। ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওকে জড়িয়ে ধরল।

“ওকে চুপ করতে বল। আমার অসহ্য লাগছে!” লাগামের রশি ধরে গররাজি ঘোড়াকে টানতে টানতে স্কারলেট বলল। “তুই না পুরুষ মানুষ ওয়েড? কান্না বন্ধ কর, নইলে তোকে আমি টেনে এক চড় মারব।”

কী কুক্ষণেই যে ঈশ্বর বাচ্চা দেন! অন্ধকার রাস্তায় হাঁটুর যন্ত্রণা নিয়ে চলতে চলতে হিংস্রভাবে কথাটা ওর মনে এল। কাজে লাগা তো দূর, অনবরত বিশ্রাম নেবার বায়না! সময় কোথায় এই অবস্থায় প্রিসির হাত ধরে নাকি সুরে কাঁদতে থাকা একটা অবুঝ বাচ্চাকে সহানুভূতি দেখানোর! আর বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার দায়টা যে ওরই, সেটা ভেবেও মনের মধ্যে তোলাপাড়া হচ্ছে। কেন যে মরতে চার্লস হ্যামিলটনকে বিয়ে করতে গেছিল!

স্কারলেটের বাহু চেপে ধরে প্রিসি প্রায় ফিসফিস করে বলল, “মিজ় স্কারলেট, টারায় না যাওয়াই ভাল। ওরা বোধ হয় কেউ আর নেই। সবাই চলে গেছে। কে জানে হয়তবা মরেই গেছে – মা আর অন্যরা।”

নিজেরই ভাবনার প্রতিধ্বনি, স্কারলেট ফুঁসে উঠে ওর হাত ছাড়িয়ে নিল।

“ঠিক আছে, ওয়েডকে আমার কাছে দে। তুই এখানেই পড়ে থাক!”

“না না ম্যাম!”

“তাহলে মুখ বন্ধ কর!”

কত আস্তেই না চলছে ঘোড়াটা! মুখ থেকে লালা ঝরে স্কারলেটের হাতটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। রেটের সঙ্গে গাওয়া গানটার কয়েকটা লাইন ওর মনে পড়ে গেল – বাকিটা কিছুতেই মনে করতে পারল নাঃ

“বাস্‌ ক’টা দিন, বয়ে যাব এই ভার,

হয়ত এ বোঝা বইতে হবে না আর --”

মনে মনে ঘুরে ফিরে গুনগুন করে গাইতে লাগল, “বাস্‌ ক’টা দিন, বয়ে যাব এই ভার, হয়ত এ বোঝা বইতে হবে না আর।”

আস্তে আস্তে ওরা চড়াইতে উঠে পড়ল। টারার ওক গাছের সারি – অন্ধকার আকাশের গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে –চোখের সামনে। কোথাও আলো জ্বলছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। নাহ্‌, সব অন্ধকার!

অন্তরাত্মা বলে উঠতে চাইল, “কেউ নেই! সবাই হারিয়ে গেছে!”

মধ্যরাত্রের সেডার সারির পাতায় ছাওয়া নিস্তব্ধ অন্ধকার গাড়িবারান্দা ধরে ঘোড়াটা নিয়ে এগিয়ে গেল। দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে চোখ কুঁচকে অনেক দূরে একটা আবছা আভাস কি দেখতে পাচ্ছে? সত্যিই তো! নাকি মনের ভুল? ক্লান্ত চোখ ঠিক দেখছে তো? টারার সাদা ইটের গাঁথনি – অস্পষ্ট যদিও। আহ্‌, বাড়ি! বাড়ি! সেই প্রিয়তম সাদা দেওয়াল, পর্দা ঢাকা জানলা, চওড়া বারান্দা – সব কিছু – আর মাত্র একটু দূরে! ওই অন্ধকারের মধ্যে? নাকি ম্যাকিন্টশদের বাড়ির মতই অবস্থা – করুণা করে অন্ধকার আড়াল করে রেখেছে?

এই পথটুকু কত লম্বাই না মনে হচ্ছে! আর ঘোড়াটা তো এগোতেই চাইছে না! ছাদটা অক্ষত আছে বলেই মনে হচ্ছে। সেটা কি সত্যিই হতে পারে? হতেই পারে না! যুদ্ধ কি আর এমনি এমনি থেমেছে! পাঁচশ বছর টিকে থাকার মত মজবুত করে বানানো হলেও, টারা কিছুতেই দাঁড়িয়ে নেই। যুদ্ধের আঁচ টারার গায়ে লাগেনি, এটা হতেই পারে না!

আস্তে আস্তে ছায়ারেখাগুলো আরও স্পষ্ট হল। ঘোড়াটাকে আরও দ্রুত চালানোর চেষ্টা করল। অন্ধকারের মধ্যেও সাদা দেওয়ালগুলো বোঝা যাচ্ছে এখন। পুড়ে কালো হয়ে যাবার কোনও চিহ্ন নেই। আহ্‌ টারা তাহলে বাঁচতে পেরেছে! বাড়ি! লাগামটা ফেলে দিয়ে বাকি কয়েক পা দৌড়ে গেল – ওই দেওয়ালগুলো জড়িয়ে ধরতে ওর আর তর সইছিল না। আর তখনই অন্ধকারের মধ্যে অস্পষ্ট একটা মূর্তিকে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। হে ঈশ্বর টারা ছেড়ে সবাই পালিয়ে যায়নি। কেউ একজন বাড়িতে আছে!

আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও আওয়াজটা গলায়ই আটকে গেল। বাড়িটা এত অন্ধকার! আর ওই মূর্তিটা তো নড়ছে না, কিংবা ওকে ডাকলও না! তবে কী হতে পারে? টারা তো অক্ষতই আছে! তবু কেমন যেন অশরীরী নৈঃশব্দ! ঠিক তখনই মূর্তিটা নড়ে উঠল। খুব আস্তে আস্তে আড়ষ্ট পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল।

“বাপী!,” স্কারলেট ফিসফিস করে বলল, বাপী কিনা মন থেকে এখনও সন্দেহ পুরোপুরি যায়নি। “আমি বাপী – কেটি স্কারলেট। আমি বাড়ি ফিরে এসেছি।”

জেরাল্ড পা টেনে টেনে ওর দিকে এগিয়ে এলেন, মুখে সাড়া নেই – যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন। এগিয়ে এসে একটা বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন – যেন উনি স্বপ্ন দেখছেন। ওর কাঁধে হাত রাখলেন। স্কারলেটের মনে হল হাতটা যেন কাঁপছে। যেন একটা দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে এখনও পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে আসতে পারেননি।

খুব কষ্ট করে বলে উঠলেন, “মেয়ে! আমার মেয়ে!” তারপর আবার চুপ করে গেলেন।

বাপী কত বুড়ো হয়ে গেছে, স্কারলেট মনে মনে ভাবল।

জেরাল্ডের কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে। ওঁর মুখে – অন্ধকারে খুব স্পষ্ট করে দেখতে না পেলেও – স্কারলেট অনুভব করতে পারল – ওঁর স্বাভাবিক উদ্দাম ভাবটা আর নেই। জেরাল্ডের সেই চঞ্চল উদ্দাম ভাবটা। আর চোখ দুটোতে এক ভয়মিশ্রিত দৃষ্টি – ঠিক যেমন ছোট্ট ওয়েডের চোখে ও দেখতে পায়। একেবারে ভেঙে পড়া বৃদ্ধ এক মানুষ!

আর তখনই নানা রকম অজানা আশঙ্কায় ওর বুক দুরদুর করে উঠল। মনের সমস্ত কৌতুহল ঠোঁটের গোড়ায় এসে আটকে রইল। ও কেবল ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ওয়াগনের ভেতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেই জেরাল্ড কোনও রকমে যেন নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন।

“মেলানি আর ওর বাচ্চা,” স্কারলেট নীচু গলায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল। ও খুব অসুস্থ – ওকে বাড়িতে নিয়ে এলাম।”

জেরাল্ড ওর কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। আগে যেমন গৃহকর্তা হিসেবে যেভাবে টারায় অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করতেন সেই ভঙ্গীতে আস্তে আস্তে ওয়াগনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই সব দিনের আবছা হয়ে যাওয়া স্মৃতিকে রোমন্থন করতে করতে।

“কাজ়িন মেলানি!”

মেলানি অস্পষ্ট স্বরে কিছু জবাব দিল।

“কাজ়িন মেলানি, এটাই তোমার বাড়ি। টুয়েল্ভ ওকস আগুনে পুড়ে গেছে। এখন থেকে তুমি আমাদের কাছেই থাকবে।”

মেলানির দীর্ঘায়িত কষ্টভোগের কথা মনে পড়তেই স্কারলেট অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরে এল। মেলানি আর ওর ছেলেকে নরম বিছানার আশ্রয় দিতে হবে, আর যা কিছু করার দরকার সেগুলো করে ফেলতে হবে।

“ওকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে। ও হাঁটতে পারবে না।”

পায়ের শব্দ শোনা গেল, তারপর একটা কালো মূর্তি সামনের হলের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল। পোর্ক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল।

“মিজ় স্কারলেট! মিজ় স্কারলেট!” উচ্ছ্বসিত গলায় ও বলে উঠল।

স্কারলেট ওর বাহু জড়িয়ে ধরল। পোর্ক! টারার প্রতিটি ইঁট আর স্নিগ্ধ বারান্দার মতই এই বাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ। “তুমি ফিরে এসেছ – আমার কত আনন্দ হচ্ছে – কী বলব –,” স্কারলেটের হাতটা এলোমেলো ভাবে চাপড়াতে চাপড়াতে বলে চলল। গড়িয়ে পড়া অশ্রু স্কারলেটের হাত ভিজিয়ে দিল।

প্রিসি জোরে জোরে কেঁদে উঠল, “পোক! পোক! বাবা!” বড়দের বিহ্বল অবস্থা দেখে সাহস পেয়ে কাতর গলায় ওয়েড বলল, “ওয়েডের তেষ্টা পেয়েছে!”

স্কারলেট সবার হাত ধরল।

“মিজ় মেলানি ওয়াগনে আছে। ওর বাচ্চাও। পোর্ক, তুমি খুব সাবধানে ওকে দোতলায় নিয়ে পেছনের ঘরে শুইয়ে দাও। আর প্রিসি তুই বাচ্চা আর ওয়েডকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে ওকে একটু জল দে। ম্যামি কাছাকাছি আছে? তাহলে পোর্ক বোলো আমার ওকে দরকার।”

ওর গলার কর্তৃত্বের সুরে সম্মোহিত হয়ে পোর্ক ধীর পদক্ষেপে ওয়াগনের কাছে গিয়ে পেছনের বসার জায়গায় হাতড়াতে লাগল। যে পালকের গদির ওপর শুয়ে মেলানি এতটা পথ এসেছে, সেখান থেকে ওকে খানিকটা তুলে ধরে আর খানিকটা টেনে বের করার সময় মেলানির একটু কোঁকানি শোনা গেল। ততক্ষণে ও পোর্কের সবল বাহুতে চলে এসেছে। ওর কাঁধে মাথাটা এলিয়ে পড়েছে – ঠিক বাচ্চাদের মত। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আর ওয়েডকে হাত ধরে টেনে প্রিসি ওদের পেছন পেছন চলল। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে এক নিমেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

স্কারলেট ওর রক্তক্ষরিত আঙুল দিয়ে বাপীর হাত ধরে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ওরা ভাল হয়ে গেছে তো বাপী?”

“মেয়েরা আস্তে আস্তে ভাল হচ্ছে।”

তারপর আবার অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ। মুহুর্তে একটা ভয়ঙ্কর কল্পনা স্কারলেটের সমস্ত অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কথাটা মনে আসলেও মুখে আনার সাহস হচ্ছিল না। হঠাৎ গলাটা শুকিয়ে গেল। টারার এই ভয়াবহ নীরবতা কি সেই অশুভ ইঙ্গিতই বহন করছে? যেন স্কারলেটের মনের কথা বুঝতে পেরেই জেরাল্ড বলে উঠলেন, “তোমার মা – ,” বলেই আবার থেমে গেলেন।

“হ্যাঁ, -- মা?”

“তোমার মা কাল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।”

বাপী খুব শক্ত করে ওর হাতটা ধরে এগিয়ে চললেন। অন্ধকার হলেও চিরপরিচিত হলঘরটা আন্দাজে বুঝতে পারল। পিঠ-উঁচু চেয়ারগুলো ছাড়িয়ে, বন্দুক রাখবার খালি র‍্যাকটা পেরিয়ে এসে, দেওয়াল ঘেঁষা বড় বড় পাওয়ালা আলমারিটা পেছনে ফেলে স্বপ্নচালিতের মত এগিয়ে চলল বাড়ির পেছনের দিকে মায়ের সেই ছোট্ট অফিসের পানে যেখানে এলেন বসে হিসেবের খাতা লেখার কাজ করতেন। যখন ওই ঘরে ঢুকবে, মা নিশ্চয়ই তাঁর সেক্রেটারির সাথে বসে থাকবেন। ওকে দেখে মুখ তুলে তাকাবেন। উঠে পথশ্রমে ক্লান্ত মেয়ের দিকে এগিয়ে আসবেন। ওঁর শরীরের সেই সুন্দর গন্ধ নাকে আসবে। এলেন কিছুতেই মারা যেতে পারেন না, যদিও বাপী বলেছেন, “উনি কাল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন – উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন – উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।” কথাটা কেবলই ঘুরে ফিরে মনে আসতে থাকল।

না না এখন এসব ভাববে না। এত ক্লান্ত, এত ক্ষুধার্ত। মায়ের কথা পরে ভাববে। এখন মায়ের কথা মন থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। নইলে জেরাল্ডের মত নিজেও হোঁচট খেয়ে পড়বে অথবা ওয়েডের মত এক নাগাড়ে ফুঁপিয়ে উঠবে।

পোর্ক চওড়া সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে স্কারলেটের কাছে এসে দাঁড়ালো। যেন ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া প্রাণীকে যেমন উষ্ণতার স্পর্শ দেওয়ার জন্য।

“আলো কোথায়?” স্কারলেট প্রশ্ন করল। “বাড়িটা এত অন্ধকার কেন পোর্ক। মোমবাতি নিয়ে এস।”

“সব মোমবাতি ওরা নিয়ে গেছে, মিজ় স্কারলেট। যেটা দিয়ে আমরা জিনিসপত্র খুঁজছিলাম, সেটা ছাড়া। সেটাও শেষ হয়ে এল বলে। ম্যামি শুয়োরের চর্বিতে ভিজিয়ে একটা কম্বলের টুকরো জ্বালিয়ে মিজ় ক্যারীন আর মিজ় স্যুয়েলেনের সেবাযত্ন করছে।”

আদেশের ভঙ্গীতে স্কারলেট বলল, “মোমবাতির যেটুকু বাকি আছে, সেটাই নিয়ে এস – মায়ের – অফিস ঘরে।”

পোর্ক ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেল। স্কারলেট অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে অন্ধকার ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিল। বাপী এখনও ওর হাতটা ধরে আছেন – অসহায় ভাবে, সন্ত্রস্তভাবে। ঠিক যেমন ভাবে খুব ছোটরা বা খুব বয়স্করা একটা অবলম্বন খোঁজে, ঠিক সেই ভাবে।

“উনি খুবই বুড়ো হয়ে গেছেন, আর খুবই পরিশ্রান্ত,” কথাটা আবার মনে হল, আর অবাক হল এই ভেবে যে ব্যাপারটা ওর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কাঁপা কাঁপা শিখায় ঘরটা অল্প আলোকিত হল যখন পোর্ক প্লেটে লাগানো অর্ধদগ্ধ মোমবাতিটা নিয়ে প্রবেশ করল। মনে হল যেন অন্ধকার গুহায় প্রাণসঞ্চার হল। যে সোফাটায় ওরা বসে আছে, সেটার গদি ঝুলে পড়েছে। লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার সামনে মায়ের বাঁকানো পল্কা চেয়ারটা, র‍্যাকের খোপগুলোতে এখনও মায়ের পাকা হাতে লেখা অনেক কাগজপত্র গোঁজা, মেঝেয় রঙচটা কার্পেট – সবই আগের মত রয়েছে – কেবল এলেনই নেই। লেমন ভারবেনার মৃদু সৌরভ ছড়ানো এলনের সেই স্নিগ্ধ চাউনিটা! বুকের মধ্যে একটা হালকা বেদনা বোধ করল স্কারলেট, স্নায়ুগুলো সব অসাড় হয়ে গেল। এই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো দরকার। কাঁদার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। হে ঈশ্বর! এখন নয়! এখন নয়!

জেরাল্ডের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকাল। জীবনে এই প্রথম বাপীকে দাড়ি না কামানো অবস্থায় দেখল। লালচে মুখটা সাদা সাদা দাড়িতে ভরা। পোর্ক মোমবাতিটাকে বাতিদানে রেখে ওর পাশে এসে দাঁড়াল। স্কারলেটের মনে হল পোর্ক যদি কুকুর হত, তাহলে ওর কোলে মুখ লুকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার আবদার করত।

“এখানে ‘ডার্কি’ ক’জন টিঁকে আছে পোর্ক?’

“মিজ় স্কারলেট, বেজন্মা ‘নিগার’গুলো পালিয়ে গেছে, আবার অনেকেই ইয়াঙ্কিদের সঙ্গে চলে গেছে আর – ”

“ক’জন টিঁকে আছে?”

“আমি আছি, মিজ় স্কারলেট, আর ম্যামি সারাদিন আপনার দুই বোনের সেবা যত্ন করছিল, আর ডিলসি – এখন দু’বোনের কাছে বসে আছে। হ্যাঁ আমরা তিনজন আছি, মিজ় স্কারলেট।”

“আমরা তিনজন!” এক সময় ছিল একশজন। খুব কষ্ট করে স্কারলেট মাথা তুলল। ব্যথায় ঘাড়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে ওকে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখতে হবে। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখল, ও খুব ঠাণ্ডা মাথায় আর স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, যেন যুদ্ধ নামে কিছুই হয়নি। যেন হাত নাড়লেই এখুনি দশজন দাস-দাসী এসে হাজির হবে।

“পোর্ক খুব খিদে পেয়েছে। খাবার আছে কিছু?”

“না ম্যাডাম, ওরা সব নিয়ে চলে গেছে।”

“কিন্তু বাগানে?”

“ওখানে ওরা ঘোড়াদের চরতে ছেড়ে দিয়েছিল।”

“রাঙা আলুর ঢিবিতেও?’

ওর পুরু ঠোঁটে একটা আনন্দের অভিব্যক্তি দেখা দিল।

“মিজ়, স্কারলেট, রাঙা আলুর কথা একদম ভুলে গেছিলাম। মনে হয় ওগুলো পাওয়া যাবে। ইয়াঙ্কিরা ওগুলো শেকড় ভেবে ছুঁয়ে দেখেনি আর – ”

“একটু পরেই চাঁদ উঠে যাবে। মাটি খুঁড়ে কয়েকটা রাঙা আলু তুলে এনে একটু ঝলসে দাও। ভুট্টা আছে? কিংবা শুকনো মটর? বা মুরগি?”

“না ম্যাম। না ম্যাম। যেসব মুরগি ওরা কেটে খেয়ে উঠতে পারেনি, সেগুলো ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে বেঁধে নিয়ে চলে গেছে।”

ওরা – ওরা – ওরা! ওরা এই করেছে – ওরা সেই করেছে – এর কি কোনও শেষ নেই! খুন করে আর জ্বালিয়ে দিয়েও কি ওদের আশ মেটেনি! মহিলা, বাচ্চা আর অসহায় নিগ্রোদের উপোস করবার জন্য ফেলে গেছে গাঁ উজাড় করে লুটপাট করে?

“মিজ় স্কারলেট, কয়েকটা আপেল আছে। ম্যামি মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। আজ আমরা ওগুলো খেয়েই আছি।”

“তাহলে রাঙা আলু তোলার আগে ওগুলোই নিয়ে এস। আর পোর্ক – মাথাটা খুব ঘোরচ্ছে। সেলারে কি সামান্যও মদ আছে – যদি জাম থেকে তৈরি হয় – তাও?”

“কী বলব, মিজ় স্কারলেট! ওরা সবার আগে সেলারই লুট করল।”

একটার পর একটা আঘাত, খিদে, অনিদ্রা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে ওর গা গুলিয়ে উঠতে থাকল। গোলাপের নকশা কাটা হাতলটা চেপে ধরল।

“মদ নেই,” হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল। স্মৃতিতে ভেসে উঠল সার সার কত বোতল রাখা থাকত সেলারে।

“আচ্ছা পোর্ক, বাপী যে সেই ওকে কাঠের ব্যারেলে ভুট্টার হুইস্কি আঙ্গুরঝোপের মাটিতে পুঁতে রেখেছিল?”

আবার কালো মুখে সম্ভ্রম মেশানো পরিতৃপ্তির হাসির আভাস পাওয়া গেল।

“মিজ় স্কারলেট, আপনাকে হার মানানো শক্ত। ব্যারেলটার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মিজ় স্কারলেট ওই হুইস্কি মোটেও ভাল নয়। আমি অবশ্য বছরখানেকের মধ্যে ওটার হদিশ করিনি। তাছাড়া মহিলাদের জন্যও হুইস্কি একদম ভাল জিনিস নয়।”

সত্যি নিগ্রোরা কত মূর্খই না হয়! ওদের না বলে দিলে ওরা নিজে থেকে চিন্তাও করতে পারে না। আর ইয়াঙ্কিরা কিনা ওদের স্বাধীন করে দিতে চেয়েছিল!

“এই মহিলা আর তার বাপীর জন্য ওই হুইস্কি খুবই ভাল জিনিস হবে। যাও পোর্ক, দেরি কোরো না। ওটা তুলে নিয়ে এস, আর আমাদের জন্য দুটো গেলাস, একটু পুদিনা আর চিনি নিয়ে এস। আমি মিশিয়ে ‘জুলেপ’ তৈরি করে নেব।”

“মিজ় স্কারলেট আপনি জানেন যে টারায় অনেকদিন ধরেই চিনি নেই। আর ঘোড়াগুলো সব পুদিনা খেয়ে ফেলেছে, আর ওরা সব গেলাস ভেঙে দিয়েছে।”

আর একবার যদি “ওরা” কথাটা ও উচ্চারণ করে তাহলে আমি চেঁচিয়ে উঠব। আমি সহ্য করতে পারছি না। কথাটা মনে মনে ভেবে, স্কারলেট মুখে বলল, “ঠিক আছে তুমি তাড়াতাড়ি হুইস্কিটা নিয়ে এস। আমরা কিছু না মিশিয়েই খেয়ে নেব।” তারপর পোর্ক যেই যাবার জন্য ঘুরল, তখন বলে উঠল, “এক মিনিট পোর্ক, কী যেন বলার ছিল – মাথায় কিছু আসছেও না – ও হ্যাঁ, একটা ঘোড়া নিয়ে এসেছি – আর একটা গরুও। গরুটার দুধ দোয়ানো দরকার, খুব তাড়াতাড়ি। ঘোড়াটার জিন খুলে জল খেতে দাও। ম্যামিকে বল, গরুটার কিছু ব্যবস্থা করতে। মেলানির বাচ্চাটা – কিছু না খাওয়াতে পারলে – বেচারা মরেই যাবে আর – ”
“মিজ় মেলিই তো – উনি কি – ?” পোর্ক অস্বস্তিতে চুপ করে গেল।

“মিজ় মেলানির বুকে দুধ নেই।” হে ভগবান, মা শুনতে পেলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন!

“ঠিক আছে, মিজ় স্কারলেট, আমার বউ ডিলসি মিজ় মেলির বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারবে। ওর একটা বাচ্চা হয়েছে। দুজনকে খাওয়ানোর পরও বেশি থেকে যাবে।”

“তোমার নতুন বাচ্চা হয়েছে পোর্ক?”

বাচ্চা, বাচ্চা আর বাচ্চা। কেন যে ভগবান এত বাচ্চা তৈরি করেন? কিন্তু না, ভগবান ওদের তৈরি করেন না। বেকুব লোকগুলোই তৈরি করে।

“হ্যাঁ, ম্যাম, বড়, মোটাসোটা, কালো ছেলে। ওর – ”

“যাও ডিলসিকে বল মেয়েদের ছেড়ে মেলানির বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে। ওদের দেখভাল আমি করব। মেলানির দেখাশোনাও ওকে করতে বল। ম্যামিকে গরুটার বন্দোবস্ত করতে বল। আর বেচারা ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে যাও।”

“আস্তাবল নেই ম্যাম। ওরা কাঠকে আগুন জ্বালাবার জন্য ব্যবহার করেছে।”

“বন্ধ করতো “ওরা” কী করেছে তার সাতকাহন! ডিলসিকে ওদের দেখতে বল। আর তুমি গিয়ে মাটি খুঁড়ে হুইস্কি আর কিছু আলু নিয়ে এস।”

“মিজ় স্কারলেট খোঁড়াখুঁড়ি করবার জন্য যে আলো লাগবে!”

“জ্বালানি কাঠে আগুন ধরিয়ে নিয়েও তো যেতে পার, পার না?”

“জ্বালানির কাঠও যে নেই! ওরা – ”

“কিছু শুনতে চাইনা আমি। যাহোক কিছু ব্যবস্থা করে তুমি ওগুলো তাড়াতাড়ি খুঁড়ে বের করে আন। যাও!”

স্কারলেটের গলার পর্দা চড়ে যাওয়ায় পোর্ক ভীরুপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঘরে শুধু জেরাল্ডের সাথে স্কারলেট রয়ে গেল। ও মৃদুভাবে ওঁর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দেখল ওঁর ঊরুদুটো সংকুচিত হয়ে গেছে। আগে যখন ঘোড়া হাঁকিয়ে যেতেন তখন চওড়া ঊরুগুলো কত ফুলে থাকত। ওঁকে এই বিষণ্ণতা থেকে বের করে আনতে হবে। কিন্তু মায়ের কথা এখন জিজ্ঞেস করতে পারবে না। আরও পরে করবে, যখন ও সহ্য করতে পারবে।

“ওরা টারাকে জ্বালিয়ে দিল না কেন?”

জেরাল্ড ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, যেন কথাটা শুনতেই পাননি। স্কারলেট আবার জিজ্ঞেস করল।

“কেন – ”, উনি এলোমেলোভাবে বললেন, “বাড়িটাকে ওরা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করছিল।”

“ইয়াঙ্কিরা! – এই বাড়িতে?”

বাড়ির এই প্রিয় দেওয়ালগুলো যেন অপবিত্র হয়ে গেছে বলে ওর মনে হল। এলেন এখানে থাকতেন – সেই জন্য এত পবিত্র এই বাড়ি – আর সেখানে কিনা ওরাও থেকেছে!

“হ্যাঁ, ওরা এখানে ছিল, সোনা। আমরা টুয়েলভ ওকস থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেছি, নদীর ওপার থেকে, ওদের এখানে আসার আগে। মিজ় হানি আর মিজ় ইণ্ডিয়া আর ওদের কয়েকজন ‘ডার্কি’ ম্যাকনে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মেয়েরা এত অসুস্থ ছিল – আর তোমার মা – আমরা পালাতে পারিনি। আমাদের ‘ডার্কিরা’ পালিয়ে গেল – কোথায় জানিনা। ওয়াগন, খচ্চরগুলো – সব ওরা চুরি করে নিল। ম্যামি, ডিলসি আর পোর্ক – ওরা পালাল না। মেয়েরা – তোমার মা – ওদের নিয়ে যেতে পারলাম না।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে।” মায়ের সম্বন্ধে ওঁকে কিছু বলতে দেওয়া যাবে না। অন্য কিছু হলে ঠিক আছে। আর জেনারাল শেরম্যান এই ঘর – মায়ের অফিসঘর – ব্যবহার করেছেন – হেডকোয়ার্টার হিসেবে – সেটাও শুনতে চায় না। বাকি সব শুনতে রাজী আছে।

“ইয়াঙ্কিরা জোনসবরোর দিকে যাচ্ছিল – রেললাইনটা উপড়ে ফেলার জন্য। নদী পেরিয়ে ওরা এল – হাজারে হাজারে – ঘোড়া আর কামান নিয়ে –অনেক লোক ওরা। আমি সামনে বারান্দায় ওদের মোকাবিলা করলাম।”

গর্বে স্কারলেটের বুক ফুলে উঠল। “ছোট্টখাট্টো, কিন্তু সাহসী জেরাল্ড!’ মনে মনে ভাবল। টারার সামনের বারান্দায় জেরাল্ড শত্রুদের মোকাবিলা করছেন – যেন ওঁর পেছনে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে – সামনে নয়।

“ওরা আমাকে বলল চলে যেতে – এখানে আগুন লাগিয়ে দেবে। আমি বললাম, আগুন লাগালে আমার ওপরেও আগুন লাগাতে হবে। আমি চলে যেতে পারব না। মেয়েরা – তোমাদের মা – ওরা – ”

“তারপর?” ওহ, উনি কি ঘুরে ফিরে সেই এলেনের কথাই তুলবেন?

“ওদের বললাম যে বাড়িতে অসুস্থ মানুষ আছে – টাইফয়েডের রুগী – ওদের সরানো মানে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। ওরা টারা জ্বালিয়ে দিতে পারে – কিন্তু কোনও ভাবেই টারা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে – ”

বলতে বলতে ওঁর গলার স্বর নামতে নামতে উনি নীরব হয়ে গেলেন। অন্যমনস্কভভাবে উনি দেওয়ালের দিকে চেয়ে রইলেন। স্কারলেট ওঁর মনের বেদনা অনুভব করতে পারল। অগণিত আইরিশ পূর্বপুরুষের স্মৃতি জেরাল্ডের মন ভারাক্রান্ত করে রেখেছে, যাঁরা নিজেদের জন্মভূমি, পায়ের তলার মাটি আঁকড়ে থাকার জন্য আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেছেন।

“আমি বললাম বাড়িটা যদি জ্বালিয়ে দিতেই হয় তাহলে তিন মৃত্যুপথযাত্রী মহিলাকে নিয়েই জ্বালাতে হবে। আমরা চলে যেতে পারব না। তরুণ অফিসারটা – ও ভদ্রলোক ছিল।”

“একজন ইয়াঙ্কি! – ভদ্রলোক! কেন বাপী!”

“হ্যাঁ ভদ্রলোক। তখুনি ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে একজন ক্যাপটেনকে নিয়ে এল – একজন ডাক্তার। উনি মেয়েদের পরীক্ষা করে দেখলেন – তোমাদের মাকেও।”

“তুমি ওই শয়তান ইয়াঙ্কিটাকে ওদের ঘরে নিয়ে গেলে?”

“ওঁর কাছে আফিম ছিল। আমাদের কাছে ছিল না। উনি তোমার বোনদের বাঁচিয়ে তুললেন। স্যুয়েলেনের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। জানি না কেন, কিন্তু উনি খুবই দয়ালু মানুষ ছিলেন। তারপর উনি যখন ওদের বললেন অসুখের কথা – ওরা আর বাড়িতে আগুন লাগাল না। ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল – কয়েকজন জেনারাল আর তাদের কর্মচারীরা। অসুস্থদের ঘরটা ছাড়া আর সব ঘর ওরা দখল করে নিল। আর সৈন্যরা – ”

উনি আবার চুপ করে গেলেন। কথা বলতে পরিশ্রম হচ্ছিল। মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। খানিক চেষ্টা করে আবার বলা শুরু করলেন।

“বাড়ির আশেপাশে সব জায়গায় ওরা তল্পি বিছিয়ে ফেলল। তুলোর খেতে, শস্যের খেতে, চারণভূমিতে – যেদিকেই তাকাও শুধু নীল রঙের সমারোহ। সেই রাতে চারদিকে হাজার হাজার ক্যাম্প ফায়ার। বেড়াগুলো ভেঙে ফেলে সেগুলো জ্বালিয়ে উনুন ধরাল। শস্যের গোলা, আস্তাবল সব ভেঙে কাঠ জোগাড় করল। গরু, শুয়োর, মুরগি এমনকি আমার টার্কিগুলোও মেরে রান্না কররে ফেলল।” জেরাল্ডের সাধের টার্কি! তাহলে সেগুলোও গেছে। “ওরা সব জিনিস নিয়ে নিল, এমনকি ছবিগুলোও – অনেক ফার্নিচার – চিনেমাটির জিনিস – ”

“রুপোর বাসন?”

“পোর্ক আর ম্যামি রুপোর বাসন কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিল – বোধহয় কুঁয়োতে ফেলে দিয়েছিল – ঠিক মনে করত পারছি না,” খিটখিটে গলায় জেরাল্ড বললেন। “এরপর ওরা এখান থেকে – এই টারা থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেল – এত আওয়াজ – লোকে ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে চলে আচ্ছে আবার আসছে – পা ঠুকছে। আর তার ওপর জোনসবরো থেকে কামানের আওয়াজ – উফ যেন মেঘের গর্জন – মেয়েরাও শুনতে পাচ্ছিল – এত অসুস্থ ওরা – আমাকে বার বার বলছিলঃ ‘বাপী ওই বিদ্যুৎ পড়া বন্ধ কর’।”

“আর – আর মা? ইয়াঙ্কিরা যে বাড়িতে আছে উনি জানতে পেরেছিলেন?”

“ও – কিছুই জানতে পারেনি।”

“ঈশ্বর পরম করুণাময়,” স্কারলেট বলল। এই ব্যথা থেকে মাকে রেহাই দিয়েছেন। মা জানতেই পারেননি যে শত্রুরা নীচের তলার ঘরগুলো দখল করে আছে। জোনসবরো থেকে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পাননি। জানতে পারেননি, তাঁর প্রাণের থেকে প্রিয় মাটি ইয়াঙ্কিদের দ্বারা পদদলিত হয়েছে।

“ওপরে মেয়েদের আর তোমার মায়ের সঙ্গে থাকার সময় ওদের কয়েকজনকে আমি দেখেছিলাম। বেশির ভাগ সময় ওই কমবয়সী ডাক্তারের সাথে দেখা হত। উনি খুবই দয়ালু ছিলেন, স্কারলেট। সারাদিন আহত সৈন্যদের সেবা শুশ্রুষা করার পর উনি এসে ওদের কাছে বসতেন। উনি কিছু ওষুধও রেখে গেছিলেন। ওরা চলে যাবার আগে উনি আমাকে বলে গেলেন, মেয়েরা সুস্থ্ হয়ে গেলেও তোমার মা – উনি এতই রুগ্ন হয়ে পড়েছিলেন – যে দাঁড়াতেও পারতেন না – বলেছিলেন যে তোমার মা এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন না – দিন রাত পরিশ্রম করে সব শক্তি নিঃশেষিত করে ফেলেছেন – ”

জেরাল্ড চুপ করে যেতে স্কারলেট মায়ের শেষের দিকের রুগ্ন চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করল – রুগ্ন, কিন্তু সবার এক মাত্র সাহসের জায়গা – রাত জেগে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন যাতে আর সকলে বিশ্রাম নিতে পারে।

“তারপর ওরা চলে গেল। ওরা চলে গেল।”

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, এলোমেলো ভাবে স্কারলেটের হাতটা ধরলেন।

খুব সরল ভাবে বললেন, “তুমি বাড়ি ফিরে এসেছে – আমি – আমার খুব ভাল লাগছে।”

পেছনের উঠোনের দিকে থেকে পা ঘষটানোর শব্দ পাওয়া গেল। বেচারা পোর্ক – চল্লিশ বছর ধরে ওকে শেখানো হয়েছে বাড়িতে ঢোকার আগে ভাল করে পা ঝেড়ে ঢুকতে হবে – এই পরিস্থিতিতেও কথাটা ভোলেনি। দু’হাতে দুটো শুকনো লাউয়ের খোল সাবধানে ধরে ও ভেতরে এল। চুয়ে পড়া সুরার তীব্র গন্ধে ঘর ভরে গেল।

“একটু চলকে পড়ে গেল, মিজ় স্কারলেট। ওই গর্তের ফুটো থেকে এই লাউয়ের খোলে ঢালা বেশ ঝকমারির কাজ।”

“কী আর করা যাবে, পোর্ক, আর হ্যাঁ ধন্যবাদ,” এই বলে স্কারলেট সেই ভিজে খোলটা ওর হাত থেকে নিল। দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল।

হুইস্কির সেই আজব পাত্রটা জেরাল্ডের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা খেয়ে নাও বাপী।” তারপর পোর্কের হাত থেকে জল ভর্তি দু’নম্বর খোলটা নিল। জেরাল্ড বাধ্য ছেলের মত, অনেক শব্দ করে খানিকটা হুইস্কি গিলে ফেললেন। স্কারলেট জল এগিয়ে দিল। কিন্তু উনি মাথা নেড়ে জানালেন লাগবে না।

হুইস্কির পাত্রটা জেরাল্ডের হাত থেকে নিয়ে নিজের মুখের কাছে ধরতেই স্কারলেট ওঁর চোখে একটা অস্পষ্ট অসম্মতি লক্ষ্য করল।

“লেডিরা মদ্যপান করে না – আমি জানি,” ও ছোট করে বলল। “তবে আজ আমি লেডি নই, আর বাপী আজ রাত্রে যে অনেক কাজ করতে হবে।”

তারপর পাত্রটা মুখের কাছে ধরে এক নিঃশ্বাসে অনেকটা তরল গিলে ফেলল। গলা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নামল। বিষম খেয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। বড় করে শ্বাস নিয়ে পাত্রটা আবার তুলল।

“কেটি স্কারলেট,” জেরাল্ডের গলায় অসন্তোষ। “যথেষ্ট হয়েছে, এবার বন্ধ কর। মদ খাওয়ার অভ্যেস নেই তোমার। তুমি বেসামাল হয়ে পড়বে।”

“বেসামাল?” স্কারলেট বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। “বেসামাল? আমি তো মাতাল হতে চাই। মাতাল হয়ে সব কিছু ভুলে যেতে চাই।”

এই বলে ও আরও খানিকটা হুইস্কি খেয়ে ফেলল। শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শরীরটা গরম কর তুলল। আঙুলের ডগা অবধি ঝনঝন করে উঠল। কী এক অপার্থিব অনুভুতি! বুকে রক্ত চলাচল বেড়ে গেল! গায়ে যেন বল ফিরে এল। জেরাল্ডের আহত অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে ওঁর হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে ছোটবেলার মত প্রগলভ ভাবে হেসে উঠল। এই হাসি দেখলে জেরাল্ড গলে যেতেন।

“তুমিই বল বাপী বেসামাল হওয়া অতই কি সহজ? আমি তো তোমারই মেয়ে, তাই না? এই ক্লেটন কাউন্টির সুস্থির মাথার কিছুটা হলেও তো উত্তরাধিকার সুত্রে আমি পেয়েছি কিনা বল?”

জেরাল্ডের মুখে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল। ওঁর ওপরেও হুইস্কি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। স্কারলেট পাত্রটা ওঁর হাতে ধরিয়ে দিল।

“নাও তুমি আর একবার খাও। তারপর আমি তোমাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেব।”

তারপর নিজেকে সামলে নিল। আরে, ও যে ওয়েডের সাথে এভাবে কথা বলে – বাপীর সাথে এভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি – এটা ওঁর পক্ষে অসম্মানজনক। কিন্তু কথাটা উনি বিনা প্রতিবাদে শুনে গেলেন।

“ঠিক, আমি তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দেব,” খুব হাল্কাভাবে আবার বলল, “আর তখন তুমি আরও একটু খাবে – যাতে সহজেই তোমার ঘুম এসে যায়। তোমার ঘুমোনো দরকার। কেটি স্কারলেট তোমার পাশে আছে। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। নাও খাও।”

বাধ্য ছেলের মত উনি খেয়ে নিলেন। স্কারলেট ওঁর বাহু ধরে ওঁকে দাঁড় করালো।

“পোর্ক ......”

পোর্ক এক হাতে লাউয়ের খোলটা তুলে নিয়ে অন্য হাতে জেরাল্ডের বাহু ধরল। স্কারলেট জ্বলন্ত মোমবাতিটা নিল। তারপর তিনজনে অন্ধকার হলের ভেতর দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে জেরাল্ডের শোবার ঘরের দিকে চলল।

স্যুয়েলেন আর ক্যারীন যে ঘরে একই বিছানায় শুয়ে গোঙাচ্ছে আর ছটফট করছে সেই ঘর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। ছেঁড়া কম্বলের টুকরো দিয়ে সলতে পাকিয়ে একটা প্লেটে থাকা শুয়োরের চর্বি পুড়িয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরের সব কটা জানলা বন্ধ। ওষুধ, রুগী আর চর্বির গন্ধে বতাস ভারি। দরজা খুলতেই স্কারলেটের প্রায় মূর্ছা যাবার জোগাড়। ডাক্তারবাবুরা বলতেই পারেন বাইরের শীতল বাতাস লেগে রোগীদের লোকসান হতে পারে, তবে ওকে যদি এই ঘরে থাকতেই হয়, তাজা বাতাস আসাটা খুব জরুরি, নইলে ও মরেই যাবে। জানলা তিনটে খুলে দিল। ওকে পাতার গন্ধ মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে এক ঝলক হাওয়ার সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ল। তবে জমাট ভ্যাপসা ভাবটা থেকেই গেল।

চার কোণে ছত্রী লাগানো খাটটাতে স্যুয়েলেন আর ক্যারীন শুয়ে আছে। ভীষণ রোগা আর পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে, চমকে উঠছে থেকে থেকে। মাঝে মাঝে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলে যাচ্ছে। হাসিখুশি দিনগুলোতে ওরা পাশাপাশি শুয়ে কত আবোলতাবোল কথা বলে যেত। ঘরের এক কোণে খালি একটা পালঙ্ক। নক্সাকাটা বাজু আর পায়াওয়ালা ফরাসি শৈলীর এম্পায়ার বেড। স্যাভান্না থেকে এলেন সঙ্গে এনেছিলেন। পালঙ্কটা এলেনই ব্যবহার করতেন।

দু’বোনের পাশে বসে স্কারলেট ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। খালি পেটে হুইস্কি পড়ে মাথাটা একেবারে বেদখল হয়ে গেছে। মনে হল দুই বোন ওর থেকে অনেক দূরে শুয়ে আছে। ওদের বিড়বিড় করা শুনে মনে হচ্ছে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। আচমকা মনে হল ওরা দুজন ওর ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। কী ক্লান্ত! মজ্জায় মজ্জায় ক্লান্তি! ঘুমোতে হবে। পড়ে পড়ে ঘুমোতে হবে, বেশ কয়েকটা দিন। তবে যদি ক্লান্তি যায়!

যদি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়া যেত! এলেনের ডাকে জেগে উঠত। এলেন হাত নেড়ে যেন বলছেন, “অনেক দেরি হয়ে গেছে, স্কারলেট, এবার উঠে পড়!” আর কখনো এলেন ডাকবেন না! শুধু যদি এলেন থাকতেন – এমন কেউ যিনি বয়সে আর অভিজ্ঞতায় ওর চেয়ে অনেক ওপরে, কষ্টে অবিচল – তাহলে তাঁর কাছেই আশ্রয় নিতে পারত! যাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে পারত! যাঁর কাঁধের ওপর নিজের সব বোঝা উজাড় করে দেওয়া যেত!

দরজাটা সন্তর্পণে খুলে ডিলসি এল। মেলানির ছেলে বুকে জড়িয়ে ধরা, হাতে হুইস্কির খোলটা ধরা। কাঁপা কাঁপা আলোয় স্কারলেটের মনে হল ডিলসি অনেক রোগা হয়ে গেছে। রেড-ইণ্ডিয়ান রক্তের মিশেল চেহারায় ফুটে উঠেছে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গালের চওড়া হাড়, বাজপাখির মত খাড়া নাকটা তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে, গায়ের তামাটে বর্ণ জ্বলজ্বল করছে। ক্যালিকো কাপড়ের রঙ চটে যাওয়া পোশাক কোমর অবধি খোলা, ব্রোনজ় রঙের বিশাল অনাবৃত স্তন থেকে ছোট ছোট গোলাপি ঠোঁট লাগিয়ে মেলানির ছেলে দুধ শুষে নিচ্ছে, বেড়ালবাচ্চার মত ছোট্ট মুঠি দিয়ে অন্য স্তন আঁকড়ে ধরে।

টলোমলো পায়ে স্কারলেট উঠে দাঁড়িয়ে ডিলসির কাঁধে হাত রাখল।

“তুমি চলে গেলে যে কী করতাম!”

“ওই বেজন্মা নিগারদের সঙ্গে কোন মুখে পালিয়ে যেতাম, মিজ় স্কারলেট? আপনার বাপী আমার সাথে আমার ছোট্ট প্রিসিকেও কিনে নিয়েছিলেন! আর আপনার মা আমার সাথে এত সদয় ব্যবহার করেছেন!”

“বোসো ডিলসি। বাচ্চাটার খেতে অসুবিধে হবে না তো? আর মিজ় মেলানি কেমন আছে?”

“খুব খিদে পেয়েছিল বাচ্চাটার। এছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই। খিদে পেলে বাচ্চাদের খাওয়ানো যে কী ঝকমারি সে আমার খুব জানা। মিজ় মেলানি ভালই আছেন। উনি মরে যাবেন না, মিজ় স্কারলেট। একদম চিন্তা করবেন না। কালো সাদা এরকম অনেক মানুষকেই দেখেছি। আসলে উনি খুব ক্লান্ত, তার ওপর বাচ্চাটার জন্যও দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে ওঁকে শান্ত করতে পেরেছি। এই খোলের ভেতরে যা ছিল খাইয়ে দিয়েছি। এখন উনি ঘুমোচ্ছেন।

তার মানে শস্যদানা থেকে তৈরি এই হুইস্কি বাড়ির সবারই কাজে লেগেছে। উদ্ভ্রান্তের মত স্কারলেট ভাবল ওয়েডকে একটু খাইয়ে দিলে হয়, যদি তাতে ওর হেঁচকি তোলাটা বন্ধ করা যায় … মেলানির মরে যাবার সম্ভাবনা নেই তাহলে! মানে অ্যাশলে যখন ফিরে আসবে – যদি সত্যিই ফিরে আসে … নাহ্‌ এসব পরে ভাবা যাবে। এই মুহুর্তে কত কিছু ভাবতে হবে – অনেক হিসেব মেলাতে হবে – সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবে। ইস, সময়টা যদি চিরতরে পিছিয়ে দেওয়া যেত! এমন সময় একটা ঘটাং ঘটাং আওয়াজ শুনে স্কারলেট চমকে উঠল।

“ও কিছু নয়। ম্যামি স্পঞ্জ দিয়ে তোমার বোনদের গা মুছিয়ে দেবার জন্য জল ভরছে। সারাদিনে অনেকবার চান করিয়ে দিতে হয় ওদের,” লাউয়ের খোলটা টেবিলের ওপরে রাখা ওষুধের বোতল আর গেলাসের মাঝখানে রাখতে রাখতে ডিলসি স্কারলেটকে কৈফিয়ৎ দিল।

স্কারলেট হঠাৎ হেসে উঠল। মাথাটা ওর নিশ্চয়ই গেছে! কুয়ো থেকে জল তোলার আওয়াজ তো সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে! আর আজ কিনা ভয় পেয়ে গেল! ওকে হাসতে দেখে ডিলসি গম্ভীর মুখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তবে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছে বলেই মনে হল স্কারলেটের। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। বড় কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেযাচ্ছে। প্রণের পোসাকটা একেবারে সাদামাটা। স্লিপারের কত যে বালি ঢুকে আছে! পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে।

ঘটাং ঘটাং করে কপিকলের দড়ি ওপরে উঠছে। জলভরা বালতিটাও ওপরে উঠে আসছে। ম্যামি চলে আসবে এখুনি। ওর কাছে। এলেনের ম্যামি। ওর ম্যামি। উদাস হয়ে চুপ করে বসে থাকল। স্তনের বোঁটা মুখ থেকে সরে যাওয়ার বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে উঠল। ডিলসি নীরবে বোঁটাটা ওর মুখে গুঁজে দিল। আবার শান্তি। উঠোনের দিক থেকে ম্যামির পা টেনে টেনে হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পেল। রাতের বাতাস – কী নিস্তব্ধ! সামান্য শব্দ হলেই স্কারলেটের কানে তালা লেগে যাচ্ছে।

ম্যামির শরীরের ভারে ওপরতলার হলঘরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আওয়াজটা দরজার কাছে এগিয়ে এল। ঘরে ঢুকল ম্যামি। কাঠের বালতি দূটোর ভারে একদম কুঁজো হয়ে গেছে। স্নেহময় মুখে বিষাদের ছায়া।

স্কারলেটকে দেখে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বালতি দুটো নামিয়ে রাখতেই স্কারলেট ছুটে গিয়ে ম্যামিকে জড়িয়ে ধরে প্রশস্ত বুকে মাথা গুঁজে দিল। সাদা বা কালো কত মাথাই না ওই বুকে মুখ গুঁজে সান্ত্বনা পেয়েছে! স্কারলেটের মনে হল এখানে মাথা রাখলেই মনে জোর এসে যায়। এমন একটা অবলম্বন যা একটুও বদলায়নি। ম্যামির পরের কথাতেই স্বপ্নভঙ্গ হল।

“ম্যামির ছোট্ট মেয়েটা আবার ঘরে ফিরে এসেছে। ওহ মিজ় স্কারলেট, মিজ় এলেন তো কবরে শুয়ে পড়েছেন। এখন তুমিই বল আমরা কী করব? হে ভগবান! মিজ় এলেনের সঙ্গে আমাকেও কেন নিলে না! মিজ় এলেনকে ছাড়া আমি যে থাকতেই পারি না। কত কষ্ট – কত ক্লান্ত আমি!”

ম্যামির বুকে মুখ লুকিয়ে একটা কথা স্কারলেটের কানে বাজল। ‘ক্লান্ত’। এই কথাটাই তো সারা বিকেল ওর মনে ঘুরে ফিরে এসে ওকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। গানটার বাকি কথাগুলো মনে পড়ে যেতেই আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়ল।

“বাস্‌ কটা দিন, বয়ে যাব এই ভার,
ক্লান্তির বোঝা হালকা হবে কি আর?
শুধু ক’টা দিন পথ চলা বাকি আছে,
কেনটাকি – সেই স্বপ্ননীড়ের কাছে।”

“ক্লান্তির বোঝা হাল্কা হবে না আর,” – কথাটা ক্লান্ত মনে কেবলই ঘুরপাক ঘেতে লাগল। বোঝা কি সত্যিই হালকা হবে না কোনও দিন? টারা ফিরে আসা মানে কি এক নিশ্চিন্ত জীবনের হাতছানি নয়, বরং আরও বেশি করে বোঝা ঘাড়ে তুলে নেওয়া? বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্কারলেট ম্যামির বলিরেখাঙ্কিত গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

“তোমার হাতদুটো দেখি তো সোনা,” বলে ম্যামি স্কারলেটের ফোস্কা আর কালসিটে পড়া হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে অত্যন্ত অপ্রসন্ন স্বরে বলল, “মিজ় স্কারলেট, পইপই করে তোমাকে বলেছি, হাত দেখে লেডি চেনা যায় আর – এ কী! তোমার মুখও তো রোদে একেবারে ঝলসে গেছে দেখছি!”

বেচারি ম্যামি! চোখের ওপর দিয়ে যুদ্ধ আর মৃত্যুর ঝড় বয়ে যাবার পরেও কত অকিঞ্চিৎকর জিনিস নিয়ে খুঁতখুঁতানি! পাছে এখুনি আবার বলতে শুরু করে যে ফোস্কাপড়া হাতের মেয়েরা বর পাকড়াও করতে পারে না, স্কারলেট তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ম্যামি, তুমি মায়ের কথা শোনাও আমায়। বাপীর কাছে শুনতে চাইলে এত কষ্ট পাবেন যে আমারও মন খারাপ হয়ে যাবে।”

ম্যামির চোখ থেকে জল পড়ত শুরু করেছে। বালতি দুটো নিঃশব্দে তুলে নিয়ে বিছানার কাছে গেল। চাদর সরিয়ে স্যুয়েলেন আর ক্যারীনের রাতের পোশাক খুলে দিল। অনুজ্জ্বল আলোয় বোনেদের দিকে তাকিয়ে স্কারলেট দেখল ক্যারীন পরিস্কার হলেও একটা শতচ্ছিন্ন আলখাল্লা গোছের কিছু পরে আছে, আর স্যুয়েলেনকে একটা রাত্রিবাস দিয়ে কোনোক্রমে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ম্যামি ওদের গা মুছিয়ে দিতে লাগল। পুরোনো অ্যাপ্রনের থেকে ছিঁড়ে নেওয়া এক টুকরো কাপড় দিয়ে!

“মিজ় স্কারলেট, গরীব, বেজন্মা সাদা স্ল্যাটারিরাই তোমার মাকে মেরে ফেলেছে! কতবার ওঁকে বলেছি ওই বেজন্মাদের উপকার করতে যেও না! জানোই তো, কেমন জেদি মানুষ ছিলেন! মনটা বড়ই নরম ছিল। কাউকে মুখের ওপর না বলতে পারতেন না।”

“স্ল্যাটারিরা!” স্কারলেট একটু অবাক হল। “মা মারা যাবার সঙ্গে ওদের কী সম্পর্ক?”

“এই রোগই তো ওদেরও ধরেছিল,” বলে হাতে ধরা ন্যাকড়া দিয়ে ম্যামি আদুড় গায়ে শুয়ে থাকা মেয়েদের দেখাল। ওদের গা থেকে জল পড়ে চাদরটা ভিজে উঠেছে। “এমি – স্ল্যাটারিদের ছুঁড়িটা – হন্তদন্ত হয়ে এসে মিজ় এলেনকে ডেকে নিয়ে গেল। বিপদে পড়লে হামেশাই যা করত! নিজেই কি একটু শুশ্রূষা করে উঠতে পারত না? একেই তো মিজ় এলেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন, নিজের শরীরটাও অনেক দিন ধরে সুবিধের চলছিল না। খাওয়াদাওয়াও তো ঠিক মত জুটতো না। এমনিতেই পাখির মত খেতেন। তার ওপর কমিসারির লোকেরা আমাদের ক্ষেতের আনাজপাতি সব লুটে নিয়ে গেছিল। তবুও কথা শুনলেন না। ওদের সেবাযত্নও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।

“দিনভর রাস্তায় রাস্তায় লড়াই চলছে, ইয়াঙ্কিরা নদী পার হয়ে একেবারে ঘাড়ের ওপরে, কাল কী হবে কেউ জানে না! কোনও না কোনও খেতমজুর প্রত্যেক রাতেই পালিয়ে যাচ্ছে! সে এক পাগল করা অবস্থা! মিজ় এলেন কিন্তু একদম শান্ত। মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তা নিশ্চয়ই ছিল – ওষুধপত্তর যদি না পাওয়া যায়! বার দশেক ওদের গা মুছিয়ে দেবার পরে একদিন রাতে আমাকে বললেন, ‘ম্যামি আমার প্রাণের বিনিময়েও যদি মেয়েদের মাথায় লাগানোর মত একটু বরফ পাওয়া যেত!’

“মিস্টার জেরাল্ডকে তো উনি এঘরে ঢুকতেই দিতেন না – রোজ়া আর টিনাকেও না। শুধু আমাকে। আমাকেও টাইফয়েডে ধরেছিল! তারপর ওঁকেও ধরল, মিজ় স্কারলেট। কত যত্নআত্তি করলাম, বাঁচাতে পারলাম না।”

ম্যামি সোজা হয়ে বসে অ্যাপ্রন দিয়ে চোখের জল মুছল।

“খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন উনি, মিজ় স্কারলেট, ওই ইয়াঙ্কি ডাক্তারও কিছু করতে পারল না ওঁর জন্য। উনি কিছুই বুঝতে পারেননি। কতবার ওঁর নাম ধরে ডেকেছি, কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু – উনি ওঁর নিজের ম্যামিকে চিনতেই পারেননি!”

“উনি – আমার কথা বলেছেন কখনও – আমার নাম ধরে ডেকেছেন কখনও?”

“নাহ্‌ সোনা! উনি আবার সেই ছোট্ট মেয়ে হয়ে গেছিলেন – যেন সেই স্যাভান্নায় ফিরে গেছেন! নাম ধরে ডাকেননি কারুকে।”

ডিলসি একটু নড়েচড়ে উঠল। ঘুমন্ত বাচ্চাকে হাঁটুর ওপর শুইয়ে দিল।

“হ্যাঁ ম্যাম, ডেকেছিলেন। কারও নাম করে উনি ডেকেছিলেন।”

“তুই থাম, রেড-ইণ্ডিয়ান নিগার! চুপ কর!” ম্যামি ডিলসির দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠল।

“এই ম্যামি! চুপ কর না! কার নাম করে ডেকেছিলেন ডিলসি? বাপীর?”

“না ম্যাম, আপনার বাপী নন। যেদিন রাতে ওরা তুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দিল __”

“তুলো বরবাদ হয়ে গেছে – তাড়াতাড়ি বল?”

“হ্যাঁ ম্যাম, সব পুড়ে গেছে! গুদাম থেকে পেছনের উঠোনে সৈন্যরা তুলোর গাঁঠরি বের করে চেঁচিয়ে ‘আজ জর্জিয়ার সব থেকে বড় বহ্ন্যুৎসব হবে’ বলে আগুন ধরিয়ে দিল।”

তিন বছর ধরে সঞ্চয় করা তুলো – এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার – একটা কাঠিতে সব ছাই!

“আগুনের শিখায় চারদিকে এত আলো হয়েছিল – দিনের বেলা বলে মনে হচ্ছিল – আমরা ভয় পাচ্ছিলাম – বাড়িটা পুড়ে না যায়! এত আলো – এই ঘরে একটা ছুঁচ পড়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া যেত! জানলায় আগুনের ঝলকানি দেখেই মনে হয় মিজ় এলেনের ঘুম চটে গেছিল – উনি বিছানার ওপর উঠে কেঁদে উঠলেন, ‘ফি – লি – ই – ই – প! ‘ফি – লি – ই – ই – প!’ ওই নামটা কখনও ওঁর মুখে শুনিনি, কিন্তু ওই নাম ধরেই উনি ডাকছিলেন!”

ম্যামি একেবারে পাথর। চোখে আগুন – যেন ডিলসিকে ভস্ম করে ফেলবে। স্কারলেট হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। ফিলিপ – কে তিনি – মার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কই বা কী – যে তাঁর নাম করতে করতে মা মারা গেলেন?

আটলান্টা থেকে টারার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যেন এক নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে পরিসমাপ্তি। বাপীর নিরাপদ আশ্রয়, এলেনের স্নেহভরা কোল আজ মরীচিকা! ভরসা করার জায়গাগুলো হারিয়ে গেছে। কী গভীর শূন্যতাবোধ! অবসাদের বোঝা হাল্কা করার উপায় নেই! বাপীর বয়স হয়ে গেছে – শোকে কেমন যেন জবুথবু হয়ে পড়েছেন – বোনেরা অসুখ বাধিয়ে বসে আছে – মেলানি দুর্বল – বাচ্চারা অসহায়। নীগ্রোরা পরম বিশ্বাস নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরেই নিয়েছে এলেনের মত ওঁর মেয়েও ওদের ভরসা করার জায়গা হবে।

জানলার বাইরে চাঁদ উঠছে। স্পষ্ট জ্যোৎস্নায় টারার বিস্তীর্ণ প্রান্তর খাঁ খাঁ করছে – নীগ্রোরা সব পালিয়ে গেছে – একরের পর একর জমি ফাঁকা পড়ে আছে – ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। স্কারলেটের মনে একের পর এক ছবি ভেসে উঠতে থাকল। চোখ জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে এক অন্ধকার গলিতে এসে ও পথ হারিয়ে ফেলেছে। জরা, বার্ধক্য, অসুখ, ক্ষুধার্ত অসহায় কিছু মানুষ অসহায় ভাবে ওর কাছে ভরসা খুঁজছে। এই অন্ধগলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও নিজে – স্কারলেট ও’হারা হ্যামিলটন – উনিশ বছরের এক বিধবা, এক শিশুকে নিয়ে!

কীভাবে সব সামলে উঠবে ও? মেলানি আর ওর বাচ্চাকে আন্ট পিটি আর ম্যাকনের বার’দের কাছে পাঠিয়ে দেবে? বোনেরা সেরে উঠলে ওরা গিয়ে স্যাভান্নাতে মাসীদের কাছে গিয়ে থাকতে পারে! জেরাল্ডকে নিয়ে ও কি আঙ্কল জেমস আর অ্যান্ড্রু’র কাছে চলে যাবে?

অস্পষ্ট আলোয় বোনেদের নেতিয়ে পড়া চেহারার দিকে চোখ পড়ল। চাদর ভিজে উঠে জল চুঁইয়ে পড়ছে। স্যুয়েলেনকে ও কোনোদিনই পছন্দ করতে পারেনি। ব্যাপারটা হঠাৎ যেন ওর কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠল। ওকে কখনওই ওর ভাল লাগেনি। ভালবাসা অবশ্য ক্যারীনের প্রতিও ওর বিশেষ নেই – দুর্বল মানুষ ওর পছন্দ নয়। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক কী করে অস্বীকার করবে? টারাতে ওদেরও সমান অধিকার! নাহ্‌, ওদের মাসীর বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে থাকতে হোক – এ ভাবনা মনেও আনা যায় না! অন্যের দয়ায় কোনও ও’হারা গরীবের মত বেঁচে আছে – অসম্ভব!

কী করে এই অন্ধকার গলি থেকে বের হবে? নাহ্‌ মাথাটা একদম কাজ করতে চাইছে না! দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল। কী ক্লান্তি! খোলটা তুলে ধরল। অন্ধকারে নেড়েচেড়ে মনে হল এখনও একটু তলানি পড়ে আছে। ঠিক কতটা বুঝতে পারল না। গলার মধ্যে ঢেলে দিল। আগের বারের মত গলায় জ্বালা করল না, একটা উষ্ণ স্রোত নীচে নেমে গেল শুধু। হুইস্কির গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল না।

শেষ হয়ে গেলে খোলাটা নামিয়ে রাখল। নিজেকে বোঝবার চেষ্টা করল। কেমন একটা ঘোর লাগছে! দু’জন চর্মসার মেয়ে – ম্যামির বিশাল বেঢপ শরীর বিছানার পাশে গুঁড়ি মেরে রয়েছে – ডিলসি যেন একটা ব্রোঞ্জের নিথর মূর্তি – কালো বুকের ওপর গোলাপি আভাস – একরত্তি একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে। সব কিছুই যেন একটা স্বপ্নের মত! যেন জেগে উঠলেই রান্নাঘর থেকে হ্যাম ভাজার গন্ধ পাবে – নীগ্রোদের চাপা হাসি – মাঠের দিকে ওয়াগন চলে যাবার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ – এলেনের হাতের স্নিগ্ধ স্পর্শ!

কী আবোল তাবোল দেখছিল? ও তো নিজের ঘরেই রয়েছে! নিজের বিছানায়! জানলা দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে। ম্যামি আর ডিলসি মিলে ওর পোশাক খুলে দিচ্ছে। আঁট হয়ে থাকা কোমরের বাঁধনটা ঢিলে করে দিয়েছে। কী স্বস্তি! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। পা থেকে খুব সন্তর্পণে মোজাগুলো কেউ খুলে নিল। মুখে প্রবোধ দেবার মত কিছু বিড়বিড় করতে করতে ম্যামি ওর ফোস্কাপড়া পা’দুটো জল দিয়ে ধুইয়ে দিচ্ছে। কী ঠাণ্ডা জলটা! আহ, কী আরাম! আগের মতই নিজের নরম বিছানাতে গা ছেড়ে দিয়ে কী ভালই না লাগছে! আহ! জোরে নিঃশ্বাস নিল আবার। তারপর কত সময় কেটে গেল, হিসেবই নেই! এক বছর? না, না এই তো এক সেকেন্ডও হয়নি মনে হয়! ঘরে একাই রয়েছে। চাঁদটা কী উজ্জ্বল লাগছে! জানলা দিয়ে আলো এসে বিছানাটা ধুইয়ে দিচ্ছে।

মাতাল হয়ে গেলাম নাকি? এতটা হুইস্কি – এত ক্লান্তি! বুঝতে পারছি না! যেন হাওয়ায় ভেসে আছি! ওই তো আমার শরীরটা বিছানাতেই পড়ে আছে! কী মায়াময় লাগছে চারপাশটা! পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি সব কিছু!

টারার ওই পথটা – অনেক দূরে গিয়ে যেটা মিলিয়ে গেছে –যেন সেই পথ বেয়েই চলেছে! কী একটা খুঁজছে – ওই পথেরই কোথাও ওর ছেলেবেলাটা হারিয়ে গেছে! এখন আর ও কাদামাটির একটা তাল নয় যে যেমন খুশি কেউ গড়ে নিতে পারবে! বালিকা থেকে নারীরূপে উত্তরণের রাত আজ!

জেরাল্ড বা এলেনের পরিবারের ওপর কিছুতেই নির্ভরশীল হতে পারবে না। ও’হারারা কোনও দিন কারুর দয়ার ওপরে থাকেনি। ও’হারারা নিজেদের বোঝা নিজেরাই বয়ে গেছে। ওর বোঝা ওর নিজেরই। আর সেই বোঝা বইবার জন্য শক্ত কাঁধের দরকার। শূন্যে ভাসতে ভাসতে খুব আশ্চর্যজনকভাবে মনে হল সেই বোঝা বইবার মত শক্ত কাঁধ ওর আছে। আর থাকবেই না বা কেন? কত দুর্দশা পেরিয়ে আসতে হয়েছে ওকে! টারাকে ছেড়ে যেতেই পারবে না। টারার এই লালমাটি ওকে যতটা আপন করে নিতে পেরেছে, তার থেকেও অনেক বেশি ও টারাকে আপন করে নিয়েছে। ঠিক তুলোর মতই ওর শেকড়ও এই লাল মাটির অনেক ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। ওকে এখানেই থাকতে হবে, জেরাল্ড আর বোনদের, আর মেলানির আর ওর বাচ্চার আর নীগ্রোদের দেখাশোনা করতে হবে। কাল থেকে – হ্যাঁ কাল থেকেই – এই জোয়াল নিজের কাঁধে পরিয়ে নিতে হবে! কাল অনেক কিছু করবার আছে। টুয়েলভ ওকসে যেতে হবে – ম্যাকিন্টশদের ওখানে যেতে হবে – ওদের ছেড়ে যাওয়া বাগানে কুড়িয়ে বাড়িয়ে যদি কিছু পাওয়া যায়। জলার ধারে গিয়ে শুয়োর আর মুর্গি চরানোর জন্য জায়গাটা পরিস্কার করতে হবে। জোন্সবোরো যেতে হবে – আর লাভজয় – এলেনের গয়না নিয়ে – কেউ তো থাকবেই খাবারদাবার বিক্রি করার জন্য। কাল – আগামীকাল – কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল – কিন্তু ক্রমশ গতি হারিয়ে ফেলছে – ঘড়ির দম ফুরিয়ে গেছে যেন –তবুও সবই পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে।

শৈশব থেকে বার বার শোনা কথাগুলো – যেগুলো শুনতে শুনতে ওর হাই উঠে যেত – অধৈর্য হয়ে পড়ত – কিছু বুঝত – কিছু মাথায় ঢুকতই না – সেই সব ঘটনাগুলো কত স্পষ্ট করে মনে পড়ছে। জেরাল্ড, কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে টারাকে গড়ে তুলেছিলেন; কী যেন এক রহস্যময় বেদনায় মা’কে উদাস হয়ে যেতে দেখেছে, রোবিল্যার দাদু, নেপোলিয়নের পরাজয়ের ধাক্কা সামলে উঠে জর্জিয়ার উর্বর উপকূলে নিজের ভাগ্য তৈরি করে নিয়েছেন; ওর বুড়োদাদু – প্রুডহোম – হাইতির জঙ্গল কেটে একটা ছোট্ট সাম্রাজ্য তৈরি করেও আবার সব কিছু হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে স্যাভান্নার মানুষের সম্মান আর শ্রদ্ধা আদায় করে যেতে পেরেছিলেন। আবার বয়েনের যুদ্ধে আয়ার্ল্যান্ডকে স্বাধীন করবার জন্য ও’হারাদের পরিবারও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কারো কারো ফাঁসি হয়েছিল, কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রাণ দিয়েছেন। নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করবার জন্য।

দুঃসময় এঁদের সকলের জীবনেই এসে হানা দিয়েছে। তবু এঁরা কেউ ভেঙ্গে পড়েননি। সাম্রাজ্য লোপাট হয়ে গিয়েছে, ক্রীতদাসেরা বিদ্রোহ করেছে, যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা, নির্বাসন – কোনও কিছুই এঁদের দমিয়ে দিতে পারেনি – হয়ত সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কেউ রণে ভঙ্গ দেননি, শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু হার স্বীকার করেননি। আচ্ছা ওর শরীরে তো এঁদেরই রক্ত বইছে! চাঁদের আলোয় স্কারলেট যেন দেখতে পেল ওর পূর্বপুরুষেরা ছায়া শরীর নিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যাঁরা সব রকম বিপদ, বাধা অগ্রাহ্য করে ভাগ্যকে নিজেদের সহায় করে তুলতে পেরেছিলেন। টারার ভাগ্যের সাথেও ওর ভাগ্য তো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে! যে করেই হোকে টারার সুদিন ফিরিয়ে আনতেই হবে।

তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে স্কারলেট পাশ ফিরে শুল। চোখ জড়িয়ে আসছে। আচ্ছা ওঁরা কি সত্যিই এসেছিলেন? ওকে সাহস দিতে? নাকি সবটাই স্বপ্ন?

“আপনারা আমার কাছে এসেছিলেন কিনা বুঝতে পারছি না – তবুও আপনাদের অনেক – অনেক ধন্যবাদ – আর শুভরাত্রি!”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ