তামিকি হারা'র গল্প :আমার ইচ্ছাপুর

  

ইংরেজি অনুবাদক : রিচার্ড এইচ মিনিয়র
বাংলা অনুবাদক : রঞ্জনা ব্যানার্জী

লেখক পরিচিতি:

তামিকি হারা’র জন্ম ১৯০৫ সনে। জাপানী সৈন্যদলের পাইকারী পোশাক সরবরাহকারী পিতার বারো সন্তানের মধ্যে অষ্টম তিনি। তাঁর জন্মের বছরেই নৌযুদ্ধে জাপানীরা রুশ সৈন্যদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। তামিকির পিতা তাঁর অষ্টম সন্তানের নামকরণে জাপানের শৌর্যের সেই ইতিহাস ধরে রাখতে চেয়েছিলেন যেন। জাপানি ভাষায় ‘তামি’ অর্থ জনগণ এবং ‘কি’ এর একটি অর্থ ‘আনন্দিত হওয়া’। তবে তামিকি হারার জীবনের আনন্দ স্থায়ী হয়নি। পৃথিবীর বিষণ্নতার আঁচ থেকে তিনি নিজেকে আলগা করতে পারেন নি। হিরোশিমার আনবিক বোমার বিপর্যয় থেকে বেঁচে গেলেও সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে অবিরাম। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যৌনকর্মীকে মালিকের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনে মুক্ত জীবনের স্বাদ দেওয়ার মতো সাহসিকতাও দেখিয়েছিলেন অথচ সেই তিনি পরিণত বয়সে নিজের জীবনের ভার বইতে পারেন নি।

ছেলেবেলা থেকেই তামিকি নিভৃতচারী ছিলেন; নিজস্ব এক দুনিয়ার ঘোরে বাস করতেন। কবিতা এবং রূপকথা দিয়ে তাঁর লেখকজীবনের শুরু। পরবর্তীতেও তাঁর লেখায় সেই অলীক দুনিয়াই ঘুরে ফিরে এসেছে নানা মোড়কে। পরিণত বয়সের লেখাগুলো তাঁর আত্মকথাই। তাঁর লেখায় একধরনের নিঃশব্দের চাদর থাকে। বাস্তব জীবনেও তিনি নীরবতা পছন্দ করতেন। শব্দে নৈঃশব্দ আঁকা সহজ নয়, তামিকি হারা এই কাজটি দারুণ দক্ষতায় করে গেছেন তাঁর কবিতায়, গদ্যে।

‘আমার ইচ্ছাপুর’ (Land of my heart’s desire) তাঁর সর্বশেষ রচনা। বিক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে এই লেখা যেন তাঁর নিজের সঙ্গে নিজেরই বৈঠক। অনেকটা জার্নালের মতোই বিন্যাস। অনুচ্ছেদ্গুলি ভাবনার পরিসরে আঁটসাঁট জুড়ে না রইলেও একাকিত্ব, অবসাদ এবং পীড়নের সুর এদের গা ছুঁয়ে বেঁধে রেখেছে। তাঁর জীবনী জেনে পড়লে এর শাঁস বোঝা যায় ভালো।

লেখাটি ১৯৫১ সনে তাঁর আত্মহত্যার (১৩ই মে ১৯৫১) প্রায় দুই মাস পরে প্রকাশিত হয়। ‘Land of my heart’s desire’, ‘আমার ইচ্ছাপুর’ - বলা যায় তাঁর শেষযাত্রার আগাম সংকেত।

গল্পপাঠের এই অনুবাদটি রিচার্ড এইচ মিনিয়রকৃত ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে করা হয়েছে। রিচার্ড ম্যাসাচ্যুসেটস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক। এই অনুবাদটি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ প্রোগ্রাম ইন অ্যাসিয়ান স্টাডিস অকেশ্যানাল পেপারস সিরিস নম্বর ১৪’ সংখ্যায় ১৯৮৯ সনে প্রকাশিত হয়।
 
 
আমার ইচ্ছাপুর (Land of My Heart’s Desire)
মাসাশিনা শহর: ১৯৫১

প্রায় ভোর হচ্ছে, আমি বিছানায় শুয়ে পাখিদের গান শুনছি। এই কক্ষের ঠিক উপরের ছাদে ওরা আমার জন্যে গাইছে। কখনো মন্দ্র, কখনো তীব্র-তারায় ওদের চাপাস্বর পূর্বানুমানের সঙ্গে দারুণ সংগতি রেখে উঠছে-নামছে। এমন হতে পারে কি যে আমার এই খুদে বন্ধুরা আসলে সকল-ক্ষণের কোমল ক্ষণটির গুঢ় অর্থ জেনে গেছে এবং সেটিই কোনো আড়াল ছাড়া একে অন্যকে জানাচ্ছে? বিছানায় শুয়ে আমি মনে মনে হাসি। যে কোনো মুহূর্তে আমি ওদের ভাষা জেনে যাব … একদম; এইতো আর কয়েকদিন, আর কটা দিন পরেই আমি সেই পর্যায়ে পৌঁছে যেতেও পারি … আচ্ছা পরেরবার এইসময় যদি আমার পাখিজন্ম হয় এবং আমি যদি এই গানের পাখিদের দেশেই ভ্রমণে যাই, ওরা আমায় কী ধরনের সংবর্ধনা দেবে? নাকি তখনও আমি প্রথমবার কিন্ডারগার্টেনে আসা সেই লাজুক শিশুটির মতো মুখে আঙুল পুরে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকব? কিংবা বিশ্ব-ক্লান্ত কবির মতো বিষণ্ণ চোখে আমার চারপাশ একাকী জরিপ করব? নাহ্‌: এসব কীভাবে করব? আমি তো পাখি হয়েই পুনর্জন্ম নিলাম । বনের ভেতর ঝিলের ধারে একদল মানুষের দেখা পেলাম যাদের আমি একসময় ভালোবাসতাম, ওরাও পাখি এখন।

“আরে বাহ্‌! তুমিও?”

“তুমি এখানে জানতাম না তো! “

যেন মন্ত্রবলে বিছানাতেই আমি সেই অন্য দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। মৃত্যুতেও আমার প্রিয়জনেরা আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না । মৃত্যু আমায় তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি এই গানের পাখিদের মতোই সহজ জীবন চাই …
 
আমি কি এই মুহূর্তেও মিহি কণায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অসীমে মিলিয়ে যাচ্ছি? এই ভাড়া বাড়িতে এরই মধ্যে আমার এক বছর কেটে গেছে, এবং যতদূর বুঝতে পারি নিঃসঙ্গতার চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি আমি। এই পৃথিবীতে আমার আঁকড়ে ধরার মতো কোথাও কোনো খড়কুটো নেই । সেই কারণেই রাতের আকাশের তারারা আমার মাথার উপর বিস্মৃতির চাঁদোয়া ধরে রাখে, এবং অদূরে জমিতে দাঁড়ানো বৃক্ষদের দেখে মনে হয় যেন ক্রমশ ওরা আমার দিকেই এগোচ্ছে, শেষকালে ওরা আমার সঙ্গেই জায়গা বদল করবে। আমি হয়তো বিলীন হয়ে যাব এবং আমার আত্মাও বরফশীতল হয়ে যাবে, কিন্তু এক অজানা অসীমের পূর্ণজ্ঞানে এই সুহৃদ তারকাপুঞ্জ এবং বৃক্ষরাজি নিঃশঙ্কে রয়ে যাবে একইভাবে, অন্তত আমার কাছে সেরকমই মনে হয়। … আমি একবার সত্যিই আমার নিজস্ব তারাটিকে আবিষ্কার করেছিলাম। এক রাতে কিচিজোজি স্টেশন থেকে ঘরে ফেরার সময় অন্ধকার রাস্তায় আমি যেইমাত্র তারাভরা আকাশের দিকে চোখ তুললাম অমনি অসংখ্য তারার ভিড় ছাড়িয়ে সেই একলা তারাটি আমার নজর কাড়ল এবং মাথা ঝুঁকিয়ে আমায় অভিবাদন জানাল। এর কি কোনো ব্যাখ্যা হয় ? অবশ্য ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবনা শুরু করবার আগেই অভাবনীয় আবেগে আমার চোখ জলে ভরে উঠেছিল।

এই বিচ্ছিন্নতা যেন এই বায়ুমণ্ডলেরই একটা অংশ। তুমি, আমার স্ত্রী, তোমার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু কারণ তোমার চোখের ভেতরে কিছু পড়েছে। …মা অতি সাবধানে সূচের আগা দিয়ে আমার নখকুনি তোলার চেষ্টা করছেন। … একা হলেই গুরুত্বহীন, এমনতরো তুচ্ছ ঘটনাগুলিই আমার মনে বুড়বুড়ি তোলে…। এক সকালে আমার খুব দাঁত ব্যথা করছিল, আমি তা নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। মৃত তুমি, আমার স্বপ্নে এলে। ‘কোন দাঁতে ব্যথা?’ , তুমি জানতে চাইলে এবং সেই দাঁতটির উপর আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দিলে। তোমার আঙুলের স্পর্শে আমি জেগে উঠলাম এবং আমার দাঁতের ব্যথাও ‘নেই’ হয়ে গেলো।
 
ঘুম আসছে, প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম, এবং আমার মাথা বিস্ফোরিত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে, খিঁচুনির ভাঙচুড়ে আমার শরীর নেতিয়ে পড়ল, চারপাশ নিস্তব্ধ যেন কিছুই হয়নি কোথাও। এখন আমি সম্পূর্ণ সজাগ, ইন্দ্রিয়গুলোর কার্যকারিতা পরখ করছি। কোনো অসামঞ্জস্য নেই কোনোটিতে। তাহলে খানিক আগে এটা কী ছিল, যা আমার সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে নিশ্চল করে দিলো এবং আমাকে অমন চৌচির করেছিল? এর উৎস কী? ভাবছি এমন প্রাবল্য এলো কোথা থেকে? আমার মাথা কাজ করছে না। … এই জীবনে আমার অগুন্তি ব্যর্থতা জমতে জমতে তার দুর্দমনীয় চাপেই কি অমন চুরমার হওয়া? না কি পরমাণু বোমার সেই ক্ষণের স্মৃতিময় সকাল আমাকে আঘাত করবার জন্যে এই বিশেষ মুহূর্তটিকে বেছে নিলো? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। হিরোশিমার শোকাবহ ঘটনা মনে হয় না আমার অবচেতনে কোনো প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তের ভীতিকর অনুভূতিই কি কোথাও ওঁৎ পেতে আমার কিংবা আমার মতো সেই ঘটনার শিকার যারা তাদের উপর আজীবন নজর রাখবে ঠিক করেছে যতক্ষণ না আমাদের সকলকে সে পাগল বানাতে পারে?

বিছানায় শুয়ে আছি ঠিক কিন্তু ঘুম আসছে না, মনে মনে নিজেকে পৃথিবী কল্পনা করি। অমনি রাতের হিম আমার বিছানার উপর হামলে পড়ে, আমি কাঁপতে থাকি। আমার শরীর, আমার সত্ত্বা, আমার মূল--- আমি কেন এমন বরফ-শীতল হয়ে গেলাম? আমি সেই পৃথিবীকে স্মরণ করবার চেষ্টা করি, যে আমাকে জীবনযাপনের সংগতি দেয়। ভাবতে ভাবতেই পৃথিবী আমার মনের গহীনে অস্পষ্ট ভাসতে থাকে! হায় পৃথিবী, আহা ধরিত্রী সেও হীমশীতল! কোনোভাবেই এ আমার চেনা পৃথিবী নয়, কয়েক লক্ষ বছর পরের কোনো এক আগামী-পৃথিবী হবে হয়তো। আমার চোখের সামনে আরও একটি কালো পিণ্ড ভেসে ওঠে; দ্বিতীয় পৃথিবী। এই নতুন গোলকের কেন্দ্রে গাঢ় লাল আগুনের তাল টগবগ করে ফুটছে। এই গনগনে চুল্লীর ভেতরে অন্য কিছুর অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে কি? যা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি অথবা যে সমস্ত রহস্যের কিনারা হয়নি তারাও কি এই পিণ্ডে জড়াজড়ি করে আছে? আচ্ছা যদি এই গনগনে আগুনের তাল ভূপৃষ্ঠে উগলে গড়ায় তবে এই দুনিয়ার কী হবে? সকলে কি ভূগর্ভের ধ্বংসাবশেষের গভীরে ধনাগারের স্বপ্ন দেখে? কিংবা মোক্ষের সন্ধান? অথবা আগাগোড়া আনকোড়া এক নতুন আগামী…

মনে হচ্ছে অনেককাল আগে আমি এমনই একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম যেখানে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে বসন্ত গুঞ্জন তুলবে এবং মানুষের জীবন-সংহারী কোনো ঘটনাই ঘটবে না কোনোখানে, কোনো এক দিন এমনই মধুক্ষণ আসবেই পৃথিবীতে।
 
এই রেলক্রসিং দিয়ে প্রায়ই আমি যাওয়া-আসা করি ; প্রায় সময় আমি এলেই রেলগেইটের আগল পড়ে এবং আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। নিসি-অগিঁকুবো কিংবা কিচিব্জির দিক থেকেই ট্রেন আসে। ট্রেনগুলি যতই কাছাতে থাকে রেললাইনের পাটাতনের উঠা-নামা ততই দৃশ্যমান হয়। এরপর ইঞ্জিনের গর্জন তুলে ওরা দ্রুতবেগে স্টেশন পেরিয়ে যায়। ট্রেনের এই গতি কীভাবে যেন আমার সকল উদ্বেগকে ধুয়েমুছে দেয়। জীবনে এমন পূর্ণোদ্দমে ছুটতে সক্ষম মানুষের প্রতি আমার অন্তর্দাহই হয়তো এর কারণ। অথচ আমার মনশ্চক্ষুতে যাদের মুখ ভাসে তারা কেউই রেললাইন অতিক্রম করে না বরং লাইনের পাটাতনে তাদের বিষণ্ণ দৃষ্টির উষ্ণতা পেতে রাখে। জীবন এদের চুরমার করে দিয়েছে, বাধা উজিয়ে চলার সমস্ত সংগ্রাম সত্ত্বেও জীবন তাদের এক অতল খাদে ঠেলে দিয়েছে , সেই খাদ থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই আর – তারাই রেললাইনকে তাড়া করে, হতে পারে এ আমারই একান্ত ভাবনা। রেলক্রসিং-এ দাঁড়ালে এইসব অদ্ভুত ভাবনা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খায় … আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে নিজের অজান্তে আমিও সেই মানুষগুলির মতোই রেললাইনকে ধাওয়া করছি ?

একদিন সূর্য ঢলার আগে আমি মহাসড়কের কাছে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ কোনো এক জাদুবলে যেন আকাশটা ঝকঝকে নীল হয়ে গেলো, কেবল একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঝিনুকের খোলের ভেতরের রুপোলি আভাসের মতো চিকচিক করছিল। আমার চোখজোড়া কি সচেতনভাবেই সেই বিশেষ জায়গাটিতেই আমাকে তাকাতে বাধ্য করল? আমার চোখ জানতো যে অদূরের পরিপাটি সারিবদ্ধ গাছগুলোর চুড়ো এই রুপোলি কিরণে সিক্ত হচ্ছে । গাছগুলো একহারা গড়নের এবং এখন মনে হচ্ছে সেই সময় ওদের ভেতরে কিছু একটা নিঃশব্দে ঘটে চলছিল। নিপুণভাবে ছাটা একটা গাছের মাথায় আমার দৃষ্টি স্থির হতেই বড়সড় খয়েরি মলিন পাতাটি ডাল থেকে খসে পড়ল। ডাল ছেড়ে মরা পাতাটা গাছের গা বেয়ে সোজা পিছলে নামছিল গুঁড়ির দিকে। এর পর গুঁড়ির পাশেই ঝরাপাতার স্তুপের উপরেই আসন গাড়ল । যে গতিতে পাতাটি পড়ছিল তা ছিলো অনুপম মসৃণ। গাছের ডাল থেকে ভূমি এই দূরত্ব অতিক্রমের মধ্যবর্তী সময়ে এই একলা পাতাটি নিশ্চিতভাবে সমগ্র পৃথিবীকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিল। … কত দিন আগে এমনই এক অন্তিম-দেখা নিয়ে ভেবেছিলাম আমি? একদিন কান্দ্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম। বছরখানেক আগে কান্দ্রাই ছিলো আমার ঠিকানা। বইপাড়ার সেই ব্যস্ত-সমস্ত পুরোনো রাস্তাটা যেন জেগে উঠল ফের। ভিড় ঠেলে যেতে যেতে আমি খুঁজছিলাম… তাই নয় কি? আমার ছায়াকেই খুঁজছিলাম। ঠিক তখনই কংক্রিটের দেয়ালে একটা মরা গাছ এবং তার ছায়াকে পরস্পরের মধ্যে আবছা বিলীন হতে দেখলাম। তবে কি এমনই বিবর্ণ এবং শান্ত চমকপ্রদ দৃশ্যরাই আমার দৃষ্টিকে সজাগ করে?

এভাবে চুপচাপ ঘরে বসে থাকলে নির্ঘাত জমে যাব; অতএব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। গতকালের তুষার এখনও মিলিয়ে যায়নি, যেভাবে পড়েছিল ঠিক সেভাবেই জমে আছে; পাড়াটা অচেনা লাগছে। তুষারের উপর পা ফেলতেই আমার মন ফুরফুরে এবং শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠে। ঠান্ডা হাওয়া আমার ফুস্ফুসকে আলতো ছুঁয়ে থাকে। ( হিরোশিমার ধ্বংসস্তুপে প্রথম তুষারপাতের দিনও এমন ঠান্ডা হাওয়ায় গভীর শ্বাস টেনেছিলাম আমি এবং সেই দিন আমার হৃৎপিণ্ড দ্রুত লাফাচ্ছিল।) ভেবে দেখলাম তুষারের স্তুতি করে আমি কোনো পদ্য লিখিনি আজও। কী চমৎকারই না হতো যদি এই তুষারমোড়া সুইস পাহাড়ি পথ ধরে ভাবনাহীন অবিরাম হাঁটতে পারতাম ! ঠান্ডায় জমে মৃত্যু নিয়ে অভিনব সব মৃত্যুভাবনা আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখে। একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ি এবং যুত করে বসে সিগারেট ধরাই, মন এখন একদম ফাঁকা। এক কোণ থেকে বাখের সুরের মূর্ছনা ভেসে আসছে এবং কাচের দেরাজের ভেতরে মিহি চিনির দানা ছড়ানো কেইক ঝিকমিক করছে। যেদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকব না, সেইদিনও আমারই মতো কোনো তরুণ ঠিক এই সময়ে এমনই নির্ভার মন নিয়ে পৃথিবীর কোনো এক কোণে বসবে। আমি চায়ের দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসি এবং তুষার বিছানো একটা পথ ধরে হাঁটতে থাকি। এই রাস্তায় খুব বেশি লোকের চলাচল নেই। উল্টোদিক থেকে এক পঙ্গু তরুণ খুঁড়িয়ে আসছে। আমি হয়তো স্বজ্ঞাবলেই জানি, ও কেন এমন তুষার ছাওয়া দিনে রাস্তায় বেরুনোর সিদ্ধান্ত নিলো। ওকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার হৃদয় হাঁক দেয়: মন চাঙা রাখো হে যুবক !
 
“দুঃখদূর্দশা আমাদের আত্মাকে ক্লিষ্ট এবং শ্বাসরুদ্ধ করা সত্ত্বেও, স্বভাবজাত অদম্য প্রবৃত্তির গুণেই আমরা আমাদের উত্তরণ ঘটাতে পারি।“(প্যাস্ক্যাল)

আমার ছয় বছর বয়সের ঠিক আগে আগেই এক গ্রীষ্মের দুপুরে এমনটি ঘটেছিল। আমাদের মাটির ভাঁড়ার ঘরটির পাথুরে সিঁড়ির ধাপে বসে আমি একা একা খেলছিলাম। সিঁড়ির বাঁ দিকের ফলন্ত চেরিগাছে সূর্যরশ্মির বিভা ঝলমল করছিল। সিঁড়ির ঠিক পাশে ক্লোভার ঝোঁপের হলুদ পাতায়ও সেই আলো ঠিঁকড়ে পড়েছিল। কিন্তু সিঁড়ির ধাপে যেখানে আমি হাঁটু মুড়ে বসেছিলাম তার ধার ঘেঁষেই মনোরম হাওয়াটি বইছিল। সেই শিলাপাথরের ধাপগুলির উপরে কিছু বালি ছড়ানো ছিলো; বালির গায়ে আমি আনমনে আঙুল চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ব্যস্তসমস্ত পিঁপড়ে আমার পাশ থেকে উদয় হলো।কিছু না ভেবেই আমি তাকে আঙুলে টিপে থেঁৎলে দিলাম। পিঁপড়েটা স্থির হয়ে গেল। খানিক বাদে আরেকটা পিঁপড়ে এলো। তাকেও আমি আঙুলে টিপে মারলাম। এরপর আমি যেখানে বসেছিলাম সেইখানে একের পর এক পিঁপড়ে আসতেই থাকল এবং আমিও ক্রমাগত তাদের থেঁৎলে মারতে থাকলাম। এই খেলায় এমনই বিভোর ছিলাম যে স্বপ্নের মতোই সময় বয়ে যাচ্ছিল। এক সময় আমার মনেই রইলো না আমি কী করছি। সূর্য পাটে গিয়ে সন্ধে ঘন হলো এবং হঠাৎ করেই এক উদ্ভট ঘোরে আমি ডুবে গেলাম। আমি যেন ঘরের ভেতরে। তবে ঠিক কোনখানে তা ঠাহর করতে পারছিলাম না । টকটকে লাল আগুনের শিখা চারপাশে ঘুর্ণী তুলে তলিয়ে গিয়েছিল। এবং সেই মৃদু আলোতে দেখেছিলাম অদ্ভুত কিছু প্রাণী যাদের আমি আগে কখনো দেখিনি, আমার দিকে তাকিয়েই শব্দহীন-গুঞ্জনে তাদের অসন্তোষ জানাচ্ছে। (নরকের সেই ঝাপ্সা দৃশ্য কি তবে হিরোশিমায় ঘটা নরকের আগাম হুঁশিয়ারি ছিল যা পরবর্তীতে আমাকে চুড়ান্ত স্পষ্টতায় প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করা হয়েছিল ?)

আমার ইচ্ছে ছিলো অসম্ভব কোমল এবং অনন্য অনুভূতিপ্রবণ একটা শিশুকে নিয়ে কোনো একদিন লেখার চেষ্টা করব এবং লিখব । সেই শিশুটি এক ঝলক হাওয়া যার পলকা স্নায়ুকে দু’টুকরো করে দিতে পারে; অথচ যার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে স্ববিরোধী এক অনন্য ব্রহ্মাণ্ড ।
 
আমি মনে করি কেবলমাত্র একটি জিনিসই প্রকৃত অর্থে আমার অন্তরকে প্রসন্ন করতে পারে। সেই কিশোরীকে নিয়ে লেখা ছোট্ট একটি গীতিকবিতাই হয়তো বা আমার জন্যে সান্ত্বনা বয়ে আনে। ‘ইউ’। … দুই বছর আগে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি কোনো এক সময় আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, এক অদ্ভুত অপার্থিব রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। এটা ছিলো আমার জন্যে একধরনের আগাম সংকেত: এই পৃথিবীকে বিদায় জানানোর ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে এবং ভালো করে বোঝার আগেই সেই চুড়ান্ত সময় আমাকে গ্রাস করে ফেলবে। আমি সবসময়ই সেই সুন্দরীতমাকে অনুরাগে স্মরণ করতে পারতাম , নিখাদ ছিলো সেই অনুভূতি। যতবারই তাকে ছেড়ে এসেছি ততবারই মনে হতো বৃষ্টির ভেতর যেন রঙধনু দেখছি । তখন আমি মনে মনে দুই-কর যুক্ত করে তার সুখের জন্যে একান্ত প্রার্থনা করতাম।
 
আমি আবার সেই গরম-ঠান্ডার রদবদল অনুভব করছি এবং আসন্ন বসন্তের চিহ্নসমূহ আমাকে বিভোর করছে। দেবদূতদের সজীব, হাল্কা, চতুর প্রলোভনের কাছে আমি হার মেনে, নিজেকে সমর্পণের জন্যে তৈরি হই । এমন কি একগুচ্ছ আলোকরশ্মিও সেই বর্ণিল উৎসবের আগাম আমেজ এনে দিতে পারে, যে উৎসবে ফুলেরা মাতে এবং পাখির সুরেলা কলরবে চারপাশ মুখর হয় । আমার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা, যা এতদিন নিশ্চল ছিল নিভৃতে তা যেন জেগে উঠতে তৎপর হয়, আমি তার কাঁপন অনুভব করছি। ধ্বংসস্তুপের নিচে মিশে যাওয়া আমার জন্মশহরের ‘পুষ্প- উৎসব’ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি মনের চোখে দেখি আমার স্বর্গবাসী মা, আমার বড়ো বোন দুজনেই তাদের সেরা পোশাকটি পরেছেন। চমৎকার দেখাচ্ছে তাদের , কিশোরীর মতোই উচ্ছল। “বসন্ত”, যার মহিমা অজস্র কবিতা, ছবি এবং সুরে গাঁথা, সে যেন মৃদুস্বরে কথা বলে আমার সঙ্গে, আমি বিহ্‌বল হই। তবুও আমি শীতল এবং বিষণ্নতা কাটে না আমার।
 
প্রিয়তমা, আমি নিশ্চিত সেই সময় বিছানায় শুয়ে তুমিও বসন্তের আগাম আহ্‌বানে এমনই শিহরিত হয়েছিলে। শেষ সময়ে যখন স্বর্গের সুবাতাস তোমাকে ছুয়ে বইছিল তখন সবকিছু কি এমনই স্ফটিকের মতো সচ্ছ্ব দেখাচ্ছিল? সেই সময়, রোগশয্যায় তুমি কী ধরনের স্বপ্ন দেখতে?

ইদানিং আমি সারাক্ষণ সেই ভরতপাখিটিকেই স্বপ্নে দেখি, ভরদুপুরে গমখেত থেকে হঠাৎ ডানা ঝাপ্টে সে নেচে নেচে উড়ে বেড়ায় তপ্তনীল অন্তরীক্ষের বুকে। পাখিটি (ও কি মৃত তুমি, নাকি আমি?) তীব্র বেগে সটান উর্দ্ধমুখি উড়তেই থাকে, ক্রমশ আরো উঁচুতে- একসময় সীমা পেরিয়ে অসীমের উচ্চতায় উঠে যায়। তখন সে আর ওঠে না, নামেও না। স্রেফ জ্বলে এবং এক ঝলক আলো ছুড়ে দেয়; জীবনের সকল বাঁধন ছিন্ন করে ভরতপাখিটি খসে-পড়া তারা বনে যায়।

(এ পাখিটি আমি নই। তবে সে নিশ্চিত আমার অন্তরের বাসনা। যদি জীবন এমন গৌরবময় দ্যুতি নিয়ে জ্বলে উঠত এবং যাপিত সব মুহূর্তের যদি এমনই অনুপম সমাপ্তি হতো …)

মূলগল্প: Land of my Heart's Desire by Hara Tamiki





অনুবাদক পরিচিতি
রঞ্জনা ব্যানার্জী
গল্পকার। অনুবাদক।
পিইআই
কানাডা। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. আমি অবাক হয়ে ভাবছি কী পড়লাম এখানে। এ তো শুধু একটা অনুবাদ নয়, এ যেন সাহিত্যের দরবারে এসে এক অভূতপূর্ব গদ্য-কবিতা পরিবেশন করা। বুঝলাম, আমি এই এক ধাক্কাতেই bowled out - আমাকে তামিকি হারার কাজ আরও পড়তে হবে। এ যে এক অসামান্য কাজ। আমার অনেক অভিনন্দন রইলো লেখিকা রঞ্জনা ব্যানার্জীর জন্যে - খুব ভালো হয়েছে এই কাজ।

    সৌমেন সেনগুপ্ত

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ সৌমেন দা’ । আপনার মতামত আমার জন্য আশিস।

      মুছুন
  2. এত নিটোল অনুবাদ। এত নিখাদ সুন্দর ভাষা। এ তো আমারই একান্ত অনুভব।

    উত্তরমুছুন