ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর – উৎপল দাশগুপ্ত
আমার পুত্র যখন মাথার পেছনে দ্বিতীয় একটা মাথার সমান উজ্জ্বল লাল রঙের আব নিয়ে জন্মাল, কথাটা আমার স্ত্রী অথবা মাকে জানাবার সাহস পেলাম না। বাচ্চাটিকে এন ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করিয়ে দিয়ে মন মরা হয়ে চক্কর কাটতে লাগলাম। আড়াই মাস পরে, ডঃ ম – যিনি আমার পুত্রের দেখাশোনা করছিলেন – এবং আমাকে ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছিলেন - তাঁকে অনুরোধ করলাম অস্ত্রোপচার করবার জন্য।
অস্ত্রোপচারের একদিন আগে আমার আতঙ্কতাড়িত মা টোকিও এসে পৌঁছলেন, আমার স্ত্রী সারা সন্ধ্যে ধরে তাঁকে সাহস জোগাতে লাগল। মধ্য-কুড়ি বয়সী আমার বউ তখনও সন্তান জন্মের পরবর্তী দৈহিক এবং মানসিক অসুবিধে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ওকে দেখাচ্ছিল ঝোড়ো হাওয়ায় অবিন্যস্ত একটি মুরগির ছানার মত। যে স্থানটি একাধারে আমাদের লিভিং-কাম-ডাইনিং রুম, সেখানে বসে আমি দুজন মহিলার জল্পনা দেখছি আর বেতের দোলনা চেয়ারটা কাচের কাবার্ডে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছি; বড়ই বেখাপ্পা লাগছে নিজেকে। পাশের ঘরে কাঠের মেঝের ওপর একটি সিন্থেটিক মাদুর পেতে ওরা বসেছে, একটি ট্রাঙ্কের দু’পাশে মুখোমুখি ওরা, দুজনের মাথা প্রায় একে অন্যকে ছুঁয়ে ফেলেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দুজনের বয়সের মধ্যে এত ফারাক, একজনের সঙ্গে অন্যজনের রক্তের সম্পর্কও নেই, তবু অদ্ভুত মিল দুজনের চেহারায়।
খুব আনমনাভাবে আমার স্ত্রী কথা বলছে, কাহিল আর দুর্বল স্বর। “ঈয়ো’* স্বাভাবিক বাচ্চার মত নয়, ওর বাবা-মা’র গলার আওয়াজেও সাড়া দেয় না,” আমার দেওয়া বাচ্চাটার ডাকনাম ধরেই ও বলল। “অপারেশন চলার সময় পরিস্থিতি যদি জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমরা ওকে ডাক দিয়ে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারব না। খুব দুশ্চিন্তায় আছি আমি।” এই একই কথা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে চলেছে ও, আর আমি বলে চলেছি যদি সেরকম পরিস্থিতি এসেই পড়ে, তাহলে সেটা স্বাভাবিক বাচ্চার ক্ষেত্রেও চিন্তার ব্যাপার, তাই আমাদের করণীয় হল পুরো ব্যাপারটা সার্জনের হাতে ছেড়ে দিয়ে মনের জোর বজায় রাখা। কিন্তু বউয়ের সাথে মায়ের উৎকণ্ঠা জুড়ে গিয়ে, আতঙ্ক শতগুণে বেড়ে গেল। চর্মসার ঘাড় জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে মা বললেন, “ঠিক এটাই হওয়ার কথা! আমাদের ওখানে আত্মীয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে কত মরতে বসা লোকই না আবার জীবনের দিকে ফিরে এসে – ” বলে খুব জোরে নিঃশ্বাস নিলেন, মনে হল যেন জিভ কামড়ে ফেলেছেন।
কথাটা ভাবলে এখন নিজেকে স্বার্থপর বলেই মনে হয়, আমার পুত্রের জন্মের অস্বাভাবিকতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য তখন আমার পরামর্শদাতা প্রোফেসর ব-এর সঙ্গে কথা বলতে গেছিলাম। ওঁর মুখ থেকে ঘাড় পর্যন্ত টকটকে লাল হয়ে উঠল। “এই রকম সময়ে এটা সব সময় স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয় জন্ম নেওয়াটা জন্ম না নেওয়ার থেকে শ্রেয়তর কিনা,” মৃদুকণ্ঠে এমন সুরে কথাটি বললেন যেন এই একই সুরে একটি করুণ এবং বেদনাদায়ক বিষয় নিয়ে উনি রসিকতাও করে ফেলতে পারেন।
“যদি শরীরে এমন গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে যা তাকে হয় জীবন অথবা মৃত্যু – যে কোনও একটি দিকে চালিত করতে পারে, এবং যদি বাচ্চাটি এরকম একটি পরিস্থিতির সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায়, তাহলে বাচ্চাটির বেছে নেবার অধিকারকে আমাদের সম্মান জানানো উচিৎ,” আমার মা আর বউকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম। “এই রকম সময়ে এটা সব সময় স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয় জন্ম নেওয়াটা জন্ম না নেওয়ার থেকে শ্রেয়তর কিনা!” ঘরের আবদ্ধতার মধ্যে চেয়ার দিয়ে দেওয়ালে সজোরে ধাক্কা দিতে দিতে কুণ্ঠিতভাবে বলা কথাটি ওঁরা দুজনেই উপেক্ষা করলেন।
ডঃ ম এবং তাঁর সহকারীবৃন্দকে অশেষ কৃতজ্ঞতা, সুদীর্ঘ অস্ত্রোপচার সাফল্যমণ্ডিত, আমার পুত্র ওই চকচকে আব থেকে মুক্ত, বলাই বাহুল্য, আমার বউ এবং মা আনন্দে আত্মহারা। তরুণ এক পিতা হিসেবে আমিও খুবই খুশি, তবে অস্ত্রোপচারের আগের রাতের কথাগুলো মনে পড়তেই খোলাখুলি আনন্দ প্রদর্শন করতে সঙ্কোচ হল।
ঈয়ো’ যখন খুবই শিশু, বউ আর আমি নিজেদের মধ্যে ওর স্বপ্ন দেখার আপাত অক্ষমতা নিয়ে প্রায়ই জল্পনা করি। ও যত বড় হয়ে উঠতে লাগল, আমি ঘন ঘন এই প্রসঙ্গে ওকে কথা বলাই।
“তুমি কি সত্যিই স্বপ্ন দেখ না, ঈয়ো’? রাতে তুমি ঘুমোতে যাও আবার সকালে জেগে ওঠো; এই সময়টুকুতে তোমার কখনও এরকম মনে হয়েছে কি … এই ধর তুমি একটা কনসার্টে রয়েছ? ঘুম থেকে ওঠার পরে এরকম কিছুই কি তোমার মনে পড়ে না?”
“হে ভগবান! বলা খুব মুশকিল! আমি ভুলে গেছি!”
“ঘটনাটা ঘটেছে কিন্তু তুমি মনে করতে পারছ না? নাকি তোমার মনে পড়ছে না কারণ সেরকম কিছুই কখনও ঘটেনি? ওষুধ খেয়ে তুমি রাত্রে ঘুমোতে যাও আর কিছুই ঘটে না? কিংবা ধর ঘুমের মধ্যে তোমার মনে হল তুমি গান শুনতে পাচ্ছ, বা ওই রকম কিছু? এই ব্যাপারটাকেই স্বপ্ন দেখা বলে, ঈয়ো’।”
“গান শোনা – মোৎজ়ার্ত একটা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন, নাম ছিল ‘স্বপ্নের ছবি’, কে.৫৫২। হে ঈশ্বর! আমি শুনিনি। দুঃখিত!”
তেমন ফলপ্রসূ না হলেও, আমার ছেলে এই সব কথোপকথনে ইচ্ছে সহকারেই অংশগ্রহণ করত। স্বপ্ন নিয়ে আমি যখন বারংবার ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম, তখন ও কঠোর কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করতঃ “অনেক হয়েছে। এবার আমি থামতে চাই!”
আমার বউ ছিল নীরব শ্রোতা। এই অনড় মনোভাবে ওর আতঙ্ক হত। হয়ত ওর ভয় ছিল, এমন একদিন আসবে যেদিন ঈয়ো’ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বিষয় থেকে মনের জানলা বন্ধ করে দেবে – বিশেষ করে আমাদের এই পরিবারের ব্যাপারেও! হয়ত বলেই দেবে, “অনেক হয়েছে। এবার আমি থামতে চাই!” স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমি নিজেও কি কম অস্থির ছিলাম? স্বপ্নের আর পিতা-পুত্রের সম্পর্কের অন্য একটি প্রতিরুপ আমার মনে অস্বস্তি সৃষ্টি করত। সেই প্রতিরুপ আমি সৃষ্টি করিনি – এই প্রতিরুপ আব্রাহাম এবং তাঁর পুত্র আইজ়্যাকের – কিন্তু সেটি শব্দময় রূপে আমার মনে গেঁথে গেছিলঃ
“হে মদীয় পুত্রহ্! আমি একটি স্বপ্নাদেশ লাভ করিয়াছি, যাহাতে আমি তোমাকে বলি প্রদানের নিমিত্ত উৎসর্গ করিয়াছি।”
“হে মদীয় পিতহ্! আপনি যেরূপ আদিষ্ট হইয়াছেন সেই রূপ সাধন করুনঃ এমতই যদি ঈশ্বরের অভিপ্রায় হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনি আমাকে সহিষ্ণু এবং স্থিতপ্রজ্ঞ পাইবেন।”
মাঝে মধ্যে এই মহিমান্বিত কথোপকথন আমার স্মরণে নিয়ে আসতাম; মাঝরাতে আমার নিঃসঙ্গ এবং কিঞ্চিত সুরাসক্ত অবস্থায় একটি ভাবনা আমার মনে ঝঞ্ঝাবাতাসের মত আলোড়ন সৃষ্টি করে চলে যেত; আমি অত্যন্ত বিচলিত এবং নতমস্তক হয়ে পড়তাম; মনে করতাম এই ভাবনা সারা জীবন ধরে বৃত্তাকারে আমাকে আবর্তন করে চলবে। আমার পুত্রের অস্বাভাবিক জন্মের প্রথম সপ্তাহ পাঁচেক পর্যন্ত আমি কায়মনোবাক্যে ওর মৃত্যু কামনা করেছি। আমার এই তীব্র আকাঙ্খার সঙ্গে আব্রাহাম প্রাপ্ত স্বপ্নাদেশ কিংবা আমার পুত্রের সম্মতিদানের কোনও সম্পর্ক ছিল না; এটা কেবলই নিজের এবং স্ত্রীর ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করে নেওয়ার অহংবাদী বাসনা; একটি তীব্র আকাঙ্খা যা পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়া রোধ করার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছিল।
যদি সেই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে আমার দুষ্কর্মের সহযোগী হিসেবে হাসপাতালে আমি যার অনুসন্ধানে ছিলাম, তাকে পাওয়া যেত, তাহলে কি আমার পুত্রের বিনাশ ঘটাতে এবং ওর স্বল্পমেয়াদী জীবনের স্মৃতিতে দাড়ি টেনে দিতে সফল হতাম?
যে কোনও ভাবেই হোক, সেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। সেই থেকে আমরা টিকেই আছি, আর আমার পুত্র তার ঊনিশতম জন্মদিন অতিক্রম করেছে। তা সত্ত্বেও, খুব শক্তিশালী সাবান ঘষেও, আমার জীবনের লজ্জাকর সেই কয়েক সপ্তাহের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারিনি, মুছে ফেলতে পারব এমন প্রত্যাশাও অবশ্য ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে, আমার পুত্রের বৌদ্ধিক ক্ষমতা যখন সতর্ক প্রহরায় ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে, আমি এমন একটি দিনের সশঙ্ক প্রতীক্ষায় ছিলাম যখন ও আমাকে এই রকম কিছু বলবে (ওর পাঁচ ছয় বছরের কচিস্বরেই কথাটা বলবে বলে কল্পনা করেছিলাম – যে বয়সে ও শতাধিক ভিন্ন পাখির ডাক চিনতে শিখে গেছিল, যেমন বিড়বিড় করে বলত, “কিংফিশার, লাল রঙের কিংফিশার”), “বাবা, সত্যি করে বলতে গেলে, যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, আমিও একই স্বপ্ন দেখতাম। আমার তখন সবে জন্ম হয়েছে, আর তুমি আমাকে মেরে ফেলার সুযোগ খুঁজছ।”
দু’বছর আগে, ঈয়ো’র প্রথম বড়সড় মৃগীরোগের আক্রমণের সময়, আমার স্ত্রী বাড়ি ছিল না। শুরুতে আর্তনাদ বা খিঁচুনি কিছুই হল না, বরং শুরুটা এমনভাবে হল যেটা, সঠিকভাবে বোঝাতে গেলে বলতে হয়, যেসব লক্ষণের সঙ্গে আমরা পূর্ব পরিচিত, ঠিক তার বিপরীত। বসার ঘরে ছিলাম আমরা; চিরাচরিত অভ্যেসে একটা কৌচে শুয়ে আমি কিছু পড়ছিলাম, আমার পুত্র কার্পেটে হামাগুড়ি খেয়ে মোৎজ়ার্ত শুনছে। খানিক পরে, নতুন একটা রেকর্ড না লাগিয়ে পছন্দ করে রাখা রেকর্ডের স্তুপ দুটো কনুই দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল, খিদে না থাকা শিশু যেমন দুর্বল হাতে মুখের কাছ থেকে খাবার সরিয়ে দেয়। ব্যাপারটা আমার চেতনায় ছোট একটি কাঁটার মত বিঁধল। আমি পড়া চালিয়ে যেতে লাগলাম। অল্প একটু সময় কাটতে না কাটতেই আমার মনযোগে বিঘ্ন ঘটল। চোখ তুলে তাকালাম। আমার পুত্র শুয়ে আছে, ওর মুখ চোখ থেকে সমস্ত অভিব্যক্তি অন্তর্হিত। চোখ খোলা, পাথরের মত স্থির। অল্প খুলে থাকা ঠোঁটের পাশ থকে লালা গড়াচ্ছে।
“ঈয়ো’! ঈয়ো’! কী হয়েছে তোমার?” আমি ডাকলাম ওকে। কিন্তু শরীরের ভেতরে চলা কোনও এক অস্থিরতার সামাল দিতেই ও ব্যস্ত থাকল। যেন এখন বাহ্যিক কোনও ডাকে, এমনকি নিজের পিতার ডাকেও, সাড়া দেওয়ার উপযুক্ত সময় নয়, সেই ভাবেই নিস্পন্দ হয়ে রইল, মাথা দু’হাতের ওপর ধরা, মুখে চোখ জুড়ে অসীম শূন্যতা।
ওকে ডাকতে ডাকতেই এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম; ওর পাশে চলে আসতে না আসতেই, বাঁ হাত এবং বাহু দিয়ে মেঝেতে চাপড় মারতে শুরু করল ও, খুব উদ্দামভাবে নয়, কিন্তু যথেষ্ট জোরের সঙ্গে। মেঝেতে চাপড় মেরে যেতে থাকল, চাপড় মেরে যেতেই থাকল, আর তারপরেই ওর চোখ উলটে গিয়ে সাদা অংশ বেরিয়ে পড়ল।
“ঈয়ো’! ঈয়ো’! তুমি ঠিক আছ তো? ব্যথা লাগছে?” অর্থহীন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দিতে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলে জড়িয়ে আমার পুত্রের দাঁতের ফাঁকে জোর করে ঢুকিয়ে দিলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে আঙুলের গাঁটের ওপর খুব জোরে কামড়ে ধরল। আমি ককিয়ে উঠলাম, যেন ওর শব্দহীন বেদনার আর্তিতেই। মিনিট দুয়েক বাদে মেঝের ওপর চাপড় মারা বন্ধ করল আর দাঁতে দাঁত চেপে ধরাটাও শিথিল হয়ে এল। চিৎ হয়ে শুতেই আমি ওকে গড়িয়ে নিয়ে কৌচের ওপর শুইয়ে দিলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল; ভয়ঙ্কর শব্দে ওর নাক ডাকতে লাগল।
মৃগীর আক্রমণের পর বেশ কয়েকদিন, আমার পুত্র নিজেকে গুটিয়ে নিল, মনমরা ভাব, চুপচাপ, যেন শরীরের ভেতর যে গিঁট লেগেছে, সেটি এখনও খোলেনি। কৌচে শুয়ে একদিন সন্ধ্যেবেলা যখন টিভিতে খবর দেখছে, তখন সংবাদপাঠক একজন জাপানী ধ্রুপদী সঙ্গীতগুরুর মৃত্যুর খবরের উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত দ্রুততার সঙ্গে উঠে বসে, পাগলের মত বিলাপ করতে শুরু করল, “ওহ্! উনি চলে গেলেন! উনি আর নেই! চিরদিনের জন্য উনি চলে গেলেন!”
আমার পুত্রের মর্মভেদী বিলাপে – বেদনায় পরিপূর্ণ – এমন কিছু ছিল যা আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল। আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম; বেশ হাস্যকরভাবেই।
“এমন করছ কেন, ঈয়ো’? তুমি ওঁকে এত পছন্দ করতে?” ওকে প্রশ্ন করতে করতে মনে হচ্ছিল যে আমি হয়ত হাসিতে ফেটে পড়ব। মুখটা যে হাসি হাসি ছিল, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু আমার পুত্র কোনও জবাব দিল না; কৌচে শুয়ে পড়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল আর শরীর শক্ত করে ফেলল। কথাটি ফিরিয়ে নেবার জন্য তখন বড়ই দেরি হয়ে গেছিল, তবে আমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। কৌচের কাছে যেতে যেতে আমি বলতে লাগলাম, “বোঝার চেষ্টা কর, ঈয়ো’, ওঁর চলে যাওয়াটা কি এতই আশ্চর্যের ব্যাপার?” হাঁটু মুড়ে পাশে বসে ছেলের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলাম, কিন্তু ও শরীরটা আরও শক্ত করে ফেলল। আমি ওর দু’হাত ধরে টানতে চাইলাম, কিন্তু হাত দিয়ে মুখ এত দৃঢ়ভাবে চাপা দেওয়া যে মনে হল স্টীলের একটা ঢাকা যেন ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে। আমার শুধু হাঁটু মুড়ে ওখানে বসে ওর দশটি আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করবার রইল না; সংবেদী এক সুক্ষ্মতা প্রতিভাত হয়ে আঙ্গুলগুলি শরীরের অপর অংশের থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আমার পুত্রের ভাবগতিকের নাগাল পাওয়া পুরোপুরি দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। নিজেকে নিজের মধ্যেই বন্দী করে নিল, আমার জিজ্ঞাসাবাদে সাড়াও দিল না। ওর বেদনাতুর হৃদয়ের মর্মভেদী কান্নার কারণ বোঝবার কোনও উপায়ই আমার মাথায় এল না। মৃত্যু সম্পর্কে এই তীব্র ভাবাবেগ কী ভাবে ও সৃষ্টি করতে সক্ষম হল?
আমার জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে অবশ্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। সেই সপ্তাহেই – ছেলে তখনও মৃগীরোগের আক্রমণ পরবর্তী গভীর অবসন্নতাবোধ কাটিয়ে উঠতে পারেনি – এফ এম সম্প্রচার শুনছিল, রেডিওর ভল্যুম যথেষ্ট উচ্চগ্রামে রেখে। ঘন্টার পর ঘন্টা এরকমই চলছিল, শেষে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা অধৈর্য হয়ে পড়ল। “ঈয়ো’, ভল্যুমটা দয়া করে একটু কম করবে?” শেষমেশ ওর ছোট বোন এসে বলতে বাধ্য হল। ঈয়ো’র বোন চেহারায় ওর অর্ধেক, ঈয়ো’ আকারে ইঙ্গিতে এমন শাসানি দিল যে ও ভয় পেয়ে পালাল।
“তোমার একটু বোঝা উচিৎ, ঈয়ো’!” আমার স্ত্রী বলল। “বাবা আর আমি মারা যাবার পর, তোমার ভাই আর বোনই তোমার দেখাশোনা করবে। তুমি যদি এরকম ব্যবহার কর, তোমাকে কেউ ভালবাসবে না, তাই আমরা মরে গেলে তুমি কী করবে?”
একেবারে বাস্তব সত্য, দুঃখিত মনে কথাটা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলাম। এই রকমভাবে, বারে বারে আমরা পুত্রের নিকট মৃত্যুর প্রসঙ্গ নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে গেছি। কিন্তু এবার আমাদের সতর্কবার্তার প্রতিক্রিয়া একেবারে অন্য রকম হল।
“ঠিক আছে! আমি তো মরে যাব। খুব তাড়াতাড়িই আমি মরে যাব। সেটাই ভাল!”
এক পলকের বিরতি, ঠিক একবার নিঃশ্বাস নেওয়ার মত – যার মানে দাঁড়াচ্ছে, ম্রিয়মাণ স্বর ধরে রাখলেও, আমার পুত্রের এই প্রত্যয়ী ঘোষণায় – আমার মতই আমার স্ত্রীও হতচকিত হয়ে পড়েছে। তারপর আবার বলতে শুরু করল, তবে এবারের কণ্ঠস্বর অনেকটাই বন্ধুত্বপূর্ণ।
“তুমি মোটেই মরে যাচ্ছ না, ঈয়ো’। হঠাৎ ভাবতে গেলে কেন যে মরে যাচ্ছ? কে বলেছে তোমাকে এই কথা?”
“খুব শিগগিরই আমি মরে যাব! আমাকে যে মৃগী রোগে ধরল! ঠিকই আছে! আমি মরেই যাচ্ছি!”
কৌচের যেখানে আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিল, আমি সেদিকে সরে এসে ছেলের দিকে তাকালাম; দু’হাত দিয়ে দৃঢ়ভাবে মুখ ঢাকা, আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ওর ভুরু আর নাকের হাড় দেখা যাচ্ছে – যেগুলোর সঙ্গে ওর চিত্রাভিনেতা কাকার সঙ্গে খুব মিল। নতুন কিছু বলতে গিয়েও আমাদের কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল, কিছু বলা বৃথা হবে বলেই মনে হল আমাদের দুজনের। এতটা দৃঢ়তা নিয়ে কথাটি বলে ফেলল, অথচ শরীর একেবারে স্থির, একটি পেশিও নড়ল না।
তিরিশ মিনিট বাদে, তখনও আমার স্ত্রী এবং আমি আমাদের ডাইনিং রুমের টেবিলে মুখোমুখি চুপচাপ বসে আছি, ছেলে আমাদের পাশ কাটিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। দুহাত দিয়ে তখনও মুখ ঢেকে রেখেছে। ওর বোন, নিজেকে একটু আগের ঘটনার জন্য দায়ী মেনে, কথা বলতে বলতে ওর সঙ্গে চলল।
“সাবধানে, ঈয়ো’! হাঁটার সময় মুখ ঢেকে রাখলে, তুমি হোঁচট খাবে। পড়ে যেতে পার, মাথায় চোট লাগতে পারে!” ঈয়ো’র ছোট ভাইও ওর পেছন পেছন বাথরুমে গেল। ভেজানো দরজা দিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে পর্যাপ্ত মূত্রত্যাগের শব্দ ভেসে এল। শেষ হওয়ার পর, আমার পুত্র হল পেরিয়ে সোজাসুজি ওর মায়ের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করল।
“এভাবে বলাটা আমার উচিৎ হয়নি,” মেয়ে ফিরে এসে বলল। “ভবিষ্যতের কথা ভাবলে, ঈয়ো’ খুব নিঃসঙ্গবোধ করে।” ওর মুখটা, মনে হল যেন ছোট ছোট ফুস্কুড়িতে ভরা, আর শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।
আমার স্ত্রী এবং আমি, নিরুপায়ভাবে – যেকথাটা ঈয়ো’কে অন্তহীন বার বলে গেছি, ‘আমরা মরে গেলে তোমার কী হবে ঈয়ো’? তুমি কী করবে?’ – স্মরণ করতে করতে অপ্রস্তুতের একশেষ হলাম। সত্যি বলতে কি, এইসব কঠোর কথায় আমার পুত্রের মনে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া হত সেটা আমি নিজে কখনও ভেবে দেখার চেষ্টা করিনি। তাছাড়া, মৃত্যু বলতে আমি ঠিক কী বুঝি, সেটাও কখনো ভেবে দেখিনি, তো সেটা নিয়ে ওর ভাবনাটা কী করে বুঝতে পারব?
মৃগীর আক্রমণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মিডল স্কুলে বিশেষভাবে প্রস্তুত পাঠক্রমে যখন আবার যাতায়াত শুরু করল, তখন মনে হল আমার পুত্র মানসিক সুস্থতা ফিরে পেয়েছে। তা সত্ত্বেও, এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে মৃত্যু সম্বন্ধে একটি ধারণা, সেটি যেমনই হোক না কেন, ওর মনে গেঁথে গেছে। প্রতিদিন সকালে, স্কুলে যাবার জন্য সাজগোজ শেষ হলে বসার ঘরে চলে আসত। পুরুষ্টু ঊরু ছড়িয়ে, মেঝেতে মাদুরের ওপর ল্যাট খেয়ে বসে, খবরের কাগজ খুলে শোকসংবাদগুলি পাঠ করত। নতুন কোনও অসুখের নাম নজরে আসলে, দম চেপে রেখে আমার স্ত্রী আর আমার কাছ থেকে শেখা চিনে অক্ষরগুলির মর্মোদ্ধার করে খুব আবেগপ্রবণভাবে পড়ত, “ইশ্, অনেকগুলো মৃত্যুর খবর আজ সকালে! খারাপ ধরণের নিউমোনিয়ার বলি! একাশি বছর। হার্ট অ্যাটাক। বয়স উনসত্তর। ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়া। বয়স তিরাশি। ওহো! এই ভদ্রলোক ফুগু ফিশ পয়জ়নিং রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ফুসফুসের ক্যান্সার। বয়স ছিয়াশি। ওহ্! আবার করে অনেক মৃত্যু!”
সান্ধ্যবার্তায় খাদ্যে বিষক্রিয়ার ঘটনাগুলি নিয়েও ও খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়ল। জুন মাসে বর্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে গ্রীষ্ম অবধি বেশ কয়েকটি ঘটনা খবরে এসেছিল। প্রতিবারই ও টিভি’র সামনে ছুটে যাবে আর গলা ফাটিয়ে বারংবার সেটি নিয়ে বলতে থাকবে, যেমন, “ওহ্! নিপ্পোরি আউটডোর মার্কেটে পুরো একটা দল বেন্টো১ লাঞ্চ খেয়ে খাদ্যে বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছে। সবকটা বেন্টোই চায়ের দোকান মার্কা!”
এক কি দু’সপ্তাহ পরে আমরা যখন বেড়াতে বেরোলাম, তখন রেলস্টেশনের লাঞ্চবক্স ছুঁয়েও দেখল না, অথচ আগে কত আগ্রহ নিয়ে এর প্রতীক্ষা করত। ওকে আমরা বারবার খেতে বলতে লাগলাম। একটু পরেই ওর চোখ থেকে রাগ ফুটে বেরোলো, এক হাত মুখে চাপা দিয়ে অন্য হাতটা আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে সামনে বাড়িয়ে ধরল। প্রত্যাখ্যানটা এতই দৃষ্টিগোচরভাবে করছিল যে অচেনা সহাযাত্রীরা একটু সন্দেহের চোখেই আমাদের দিকে তাকালেন, যেন আমরা সন্তানের ওপর কোনও নিষ্ঠুর সাজা চাপিয়ে দিতে চাইছি। সেই গ্রীষ্মে, আমার পুত্র সুশি২ খাওয়াও বন্ধ করে দিল, এতদিন যেটি ওর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় পড়ত। আরও একটি ডিশ – শুয়োরের পায়া – যেটি এতদিন খুবই ভালবাসত, সেটিও স্পর্শ করায় অনীহা দেখা দিল – বেশি বেশি খেয়ে পেট খারাপ হওয়ার পর থেকেই। এর ফলে এক বছরেরও কম সময়ে বাইশ পাউন্ড ওজন কমে গেল।
নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকত বলেই, রোগের বড়সড় আক্রমণের হাত থেকে ও রেহাই পেল। কিন্তু পরের বছর জুড়ে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটল, যাকে রোগের আক্রমণের পূর্বাভাস বলা যেতে পারে। যখনই এরকম কিছু ঘটনা ঘটত, স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে কৌচে শুয়ে ছেলে নতুন কোনও দৈহিক উপসর্গ ঘোষণা করবেঃ
“দেখ, আমার বুক থেকে কোনও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না! মরে যাচ্ছি মনে হয়!”
আমার স্ত্রী আর আমি রবারের একটা নল দিয়ে স্টেথোস্কোপ তৈরি করে একটি প্রান্ত পুত্রের বুকে লাগিয়ে অন্য প্রান্ত ওর একটা কানে লাগিয়ে দিতাম। অথবা হার্ট অ্যাটাক নিয়ে কিছু প্রাথমিক তথ্য ওকে দিতাম – শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতাম যাতে ওর নিতে অসুবিধে না হয় – যাতে মৃত্যুচিন্তা নিয়ে ওর উদ্বেগের ভার কোনও ভাবে লাঘব করা যায়।
গত বছর শরতকালে, আমার স্ত্রী আর আমি মিলে ঠিক করলাম ছেলেমেয়েদের ইজ়ু পাহাড়ে আমাদের ক্যাবিনে নিয়ে যাব। ঠিক হল শনিবার আমরা রওনা দেব, কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে জানা গেল শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসছে, আর এর পূর্বাভিমুখ গতিপথ পরের দিন সকালে ইজ়ু উপদ্বীপের ওপর আছড়ে পড়বে – ঠিক যখন ক্যাবিনে আমাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। অতএব বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে ছেলেমেয়েদের জানিয়েও দিলাম। ঈয়ো’ও শুনল, তবে প্রতিক্রিয়া দিল না। তাই আমি ধরেই নিলাম যে এই ভ্রমণটিকে তেমন গুরুত্ব ও দেয়নি।
কিন্তু সেই শনিবার, ঠিক যে সময় আমাদের বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার কথা, ঈয়ো’ সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, পায়ে চামড়ার শক্ত জুতো – যেটি সাধারণত ও পরতেই চাইত না – পিঠে বড়সড় একটি ব্যাকপ্যাক, মাথায় পাহাড়ে চড়বার টুপি। যেন নিজেকেই আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করছে, এই রকম এক সুরে বলল, “তাহলে কি আমরা রওনা হতে পারি? এখন আমি ইজ়ু’র বাড়িতে যাওয়ার পথে!” আমরা বাকিরা যখন নিজেদের মালপত্র নিয়ে হাজির হলাম না, তখনও ও অপেক্ষা করতেই লাগল, মতিগতি কিছুটা রহস্যজনক! আমার স্ত্রী আর ওর বোন আর ভাই ঈয়ো’কে বোঝাতে শুরু করল যে পাহাড় ভ্রমণে যাওয়ার প্ল্যানটা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। টিভির আবহাওয়া মানচিত্র নিয়ে ঈয়ো’র আগ্রহ আমার মেয়ে কাজে লাগাল। “একটা ঘূর্ণিঝড় আসছে, ঈয়ো’! কে জানে তাপমাত্রা কত নেমে যাবে – খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস!” ইজ়ু উপদ্বীপ যে প্রশান্ত মহাসগরে ভাসতে ভাসতে বর্তমান জায়গায় এসে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেছে – খুব সম্ভব ম্যাগাজ়িনের কোনও লেখা থেকে ওর ভাই জানতে পেরেছে – সেটা ও ঈয়ো’কে জানিয়ে বলল, “যদি এটাই হয়ে থাকে, তাহলে উপদ্বীপটা একদিন আবার ভাসতে ভাসতে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়বে। তখন হয়ত আমরা আর ফিরেই আসতে পারব না।”
এই সব যুক্তি পরামর্শ সত্ত্বেও আমার পুত্র নির্বিকার, যেন গুরুত্ব দেওয়ার মত নয়ই বিষয়টা। ওর সহজ সরল যুক্তিটা অবশ্য ভয় পাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। “ঠাণ্ডায় পরবার মত একটা সোয়েটার আমার তো আছেই। ইজ়ু উপদ্বীপ ভেসে চলে যাওয়ার আগেই আমাদের পৌঁছে যাওয়া দরকার। শুনতে পাচ্ছি, একটা ঘূর্ণিঝড় আসতে চলেছে!”
শেষমেশ, আমার স্ত্রী ওকে ভয় দেখাল, ওর গোয়ার্তুমির কথা জানতে পারলে ওকে আমার কাছে ধমক খেতে হবে। সেই সময় স্টাডিতে বসে আমি কিছু কাজ করবার চেষ্টা করছিলাম। ভয় পাওয়া দূরের কথা, উলটে প্রচণ্ড একগুঁয়েমির সঙ্গে আমার স্ত্রী আর ওর ব্যাকুল ভাই আর বোনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। দেখছে না কিছুই, দৃষ্টিতে শূন্যতা। তারপর বলে উঠল, “না, পাপা মরে গেছেন। তোমরা জান যে উনি মারা গেছেন। আমি নিজেই ইজ়ু যাচ্ছি, কারণ পাপা বেঁচে নেই। বিদায় জানাই সবাইকে। বিদায়!”
একটু বাদে স্ত্রী যখন ঘটনাটি আমাকে জানাল, জানলার বাইরে তাকালাম। কয়েকটি গাছ আছে বাগানে, তাদের মধ্যে ডগউড আর বার্চ বাতাসে দুলছে। মোটা ডালপালা ছড়িয়ে আর ঘন পর্ণরাজি নিয়ে ক্যামেলিয়াই একমাত্র অনড়। অবশ্য খুব ভাল করলে ক্যামেলিয়াতেও মৃদু হিল্লোলের আভাস পাওয়া যাবে। কম্পনের মাত্রা নবমুকুলিত বৃক্ষের থেকে আলাদা। সকাল থেকেই ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে, মাঝে মাঝে দু’এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে যাচ্ছে; শিশির যেন বড় বড় ফোঁটায় বাতাসে ভারি হয়ে ঝুলে রয়েছে। দূর থেকে আকাশটা কুচকুচে কালো আর অশুভ লাগছে; ঘন মেঘের আড়ালে ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে গর্জন করছে। ঈয়ো’ ঠিক বলবে, কী এমন হাওয়ার বেগ যে ওর প্রতিকূলে হাঁটা যাবে না, আর বৃষ্টিও তেমন জোরে হচ্ছে না যে ছাতা নিয়ে বেরোতে হবে। সত্যি বলতে কি, সেদিন সকালেই ও বাস স্টপ পর্যন্ত হেঁটে গেছে আর স্কুলে গিয়ে ফিরেও এসেছে।
যে প্রবন্ধটি লিখছিলাম, সেটি পাশে সরিয়ে রেখে উঠলাম। আমার স্ত্রীকে যেন শিউরে উঠতে দেখলাম – যদিও আমার দিকে পেছন ফিরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, চুপচাপ –তখনও আমি ঈয়ো’র ওপর রেগে উঠিনি। বরং নিজেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেও ভাবছি ঘূর্ণিঝড় চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা যে টোকিওতেই থাকব, ঈয়ো’কে এটা সহজেই বোঝানো যাবে। আমি ওর প্রকাণ্ড মাথার দিকে তাকালাম। যে ব্যাকপ্যাকটি পেছনে বাধা, সেটি বড়দের ব্যাকপ্যাকের মতই লম্বা আর চওড়া। মান্ধাতার আমলের একটি পুতুল একপাশে বেঁধে রাখা। বেশ রাগী মুখ করে ও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেল। দুর্ভাবনায় হাল ছেড়ে দিলাম, আর ঈয়ো’র সঙ্গে, যে ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত ইজ়ু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেখানে যাবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম।
খুদে চিয়ো৩ নামের বড়সড় সেই পুতুলটি যেটি ঈয়ো’ নিজের শরীরে বেঁধে নিয়েছে – একরাশ কালো চুল আর চকচকে চোখ তার – সেটি আসলে একটি বাতিল করে দেওয়া ময়লা পুতুল; চার পাঁচ বছর আগেই সেটি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সন্তানকে পাশে নিয়ে জীবনের শেষ মরণপণ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত লাগছে ঈয়ো’কে।
“ওকে যখন বললাম আমরা কেউই ইজ়ু যাচ্ছি না, তখন ও খুদে চিয়োকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল,” আমার কন্যা জানাল, কণ্ঠস্বরে খানিক থতমত ভাব। ওর ছোট ভাইও পুতুলটির ঝাঁপ খুলে যাওয়া চোখ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“আমি যাচ্ছি ওর সঙ্গে,” বললাম আমি।
বসার ঘরে নিজের স্যুটকেস গুছিয়ে নিচ্ছি, ঈয়ো’র ভাই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। ওর চেহারা-ছবিতে স্পষ্টতই আমার স্ত্রীর উৎকণ্ঠার প্রতিফলন। এবার মুখ ফুটে বউ বলেই ফেলল, “এটাই বরং ভাল হল – কেবল তোমার পাপা আর ঈয়ো’র যাওয়ার থেকে তোমরা তিনজনেই যাও!”
“না, কেবলমাত্র ঈয়ো’ আর আমিই যাচ্ছি!” বললাম। বুঝতে পারলাম চড়া গলায় কথাটা বলায় ঈয়ো’র ভাই কষ্ট পেল মনে মনে। নিজের মতামত একটু জোর করেই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পরিবারের বাকি সকলে, যারা এই পৃথিবীতে নিজের নিজের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে চায়, তারা সবাই বাদ। শুধু ঈয়ো’র আর আমারই আছে যা নয় তাই করবার স্বাধীনতা!
ঈয়ো’র ভাই বোন অপ্রস্তুত মুখ করে নিজের নিজের ঘরে চলে গেল; অবশ্য ওদের অপ্রস্তুত হবার কোনও কারণ ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে, ঈয়ো’ আর আমি বাড়ি থেকে রওনা হয়ে গেলাম; ধর্মযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নাইটের মত; সবাই ঈয়ো’র দিকেই তাকিয়ে; পুতুলটি তখনও ওর শরীরে সঙ্গে বাঁধা।
সেইজো গাকুয়েন থেকে ওদাওয়ারা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই যেতে হল আমাদের, ট্রেন ভর্তি যাত্রীর চাপে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে। লোকজনের জ্বলন্ত দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ঈয়ো’ খুদে চিয়ো বা ব্যাকপ্যাক সরাতে রাজি হল না। গোঁয়ারের মত মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল, মাথা নোয়ানো; ভাবখানা এমন যে ওই একমাত্র যাত্রী; ওর জিনিসপত্র ওপরের মাল রাখার জালের ওপর তুলে দেবার সাহস হল না আমার। পিঠে পিঠ লাগিয়ে দুজনে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যেন কেউ কাউকে চিনি না। ঈয়ো’র ঘামের গন্ধ অস্বাভাবিকভাবে চড়া; মুখোমুখি দাঁড়িয়ে না থাকলেও, ও যে কোনও স্টেশনে নামেনি আর ঠায় আমার পাশটিতেই দাঁড়িয়ে আছে, সেটি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না।
ওদাওয়ারা থেকে আমরা ন্যাশনাল রেলরোডের গাড়িতে উঠলাম; দিনের সেই সময়ে, আতামি পর্যন্ত ট্রেনে যতটা ভিড় হওয়া উচিত, সেই অনুযায়ী ভিড়টা কমই মনে হল। সাপারের জন্য লাঞ্চবক্স কিনে যখন আমরা ইতো লাইনের জন্য গাড়ি বদল করলাম, কামরায় যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। সমুদ্রকে তখনই অন্ধকার লাগছে, পাহাড়ের দিকটিও ঘন কুয়াশায় ঢাকা, তবে কখনো কখনো গাছের ওপর দিয়ে আলোর ঝলকানির দেখা মিলছে, হাওয়ার দাপটে ডালপালা যখন নুয়ে পড়ছে। লোহার সেতু পেরোতে পেরোতে একটি উদ্বেল অশান্ত নদী নজরে পড়ল।
ইতো পৌঁছে জানতে পারলাম সামনের রেলপথ ধরে আরও এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ঈয়ো’ এখনও এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন ও একা একাই যাচ্ছে, ফলে ওকে সমস্ত ঘোষণাই মন দিয়ে শুনতে হচ্ছে, আলাদা করে ওকে কিছু বুঝিয়ে বলার দরকার হচ্ছে না। স্টেশন থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। ঈয়ো’ আমার থেকে কয়েক পা পেছন পেছন। পাহাড়ের সেই ক্যাবিনে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য – অঝোর ধারে বৃষ্টিতে মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির মধ্য থেকে – একটি ট্যাক্সির সঙ্গে আমি কথা বলে নিলাম।
“আপনাদের বাড়ির হাল-হকিকৎ দেখতে চললেন? ফ্ল্যাশলাইটে ব্যাটারি ভরে নেওয়ার জন্য একটু সময় দেবেন?” ঈয়ো’র দিকে না তাকানোর চেষ্টা করতে করতে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল। “অবস্থা যদি সঙ্গীন হয়ে ওঠে, তাহলে কিন্তু ফিরে আসব। আপনাদের ওর মধ্যে ছেড়ে আসতে পারব না, আর নিজেও যদি ফিরতে না পারি! শুনতে পাচ্ছি ঘূর্ণিঝড় ইজ়ুতে সরাসরি আছড়ে পড়বে।”
যত আমরা এগোতে থাকলাম, ঝড় ততই বেসামাল হয়ে উঠতে লাগল। তবে ড্রাইভার কোনোক্রমে আমাদের ক্যাবিন অবধি পৌঁছে দিল। এমনকি হাঁটা পথ ধরে যাওয়ার সময় হেডলাইট জ্বালিয়ে পথ দেখাল। তিরিশ ফুট দূরে সদর দরজার সামনে যখন পৌঁছলাম, ভিজে একেবারে চুবচুবে হয়ে গেছি। পায়ের কাছে পথটিতে অন্ধকারই রয়ে গেল; ড্রাইভারের দেখানো আলো – এতটাই উজ্জ্বল যে চোখ ঝলসে দিচ্ছিল – পড়েছে পাহাড়ি পীচ গাছের পাতার সমুদ্রে ঢেকে থাকা প্রমত্ত ডালপালার ওপর – মনে হচ্ছিল এখুনি বোধহয় আগুন জ্বলে উঠবে - ঝড়ের দাপটে আথালপাথাল হয়ে সাইপ্রেস গাছের গুঁড়িতে চাবুকের মত আছড়ে পড়ছে। দমকা হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে দরজা খুলে কোনও মতে ঈয়ো’কে ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম, তারপর বাড়ির পেছনে গেলাম কিছু জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য। ফেরার পথে, হাতে ধরা কাঠ গাছের ডালে আটকে গিয়ে ছিটকে আমার মুখে এসে পড়ল। চশমাটা পড়ে গেল, নাক দিয়েও রক্ত পড়তে লাগল।
অবশ্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবার পর নিবিড় এক প্রশান্তি অনুভব করলাম – এতক্ষণ যে যন্ত্রণাদায়ক মানসিক অবস্থার মধ্যে ছিলাম, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, ঘরে প্রবেশ করার পর থেকে ঈয়ো’র মধ্যে বেশ এক সতর্ক ভাব। বিজলি নেই, ওপরতলায় যেতে, ডাইনিং রুম বা বসার ঘরে ঘোরাঘুরি করার সময় ফ্ল্যাশলাইটটি ব্যবহার করেছে বলে মনে হল। বাথরুম থেকে কয়েকটা তোয়ালে আর আমার শোবার ঘর থেকে তোশক নিয়ে এলাম। তোশকটা আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্টই বড়। ঈয়ো’কে জামাকাপড় ছেড়ে গা মুছে নিতে বলে বেডিংটি আনার জন্য নীচে গেলাম; ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে, সেটির পাশে শোবার বন্দোবস্ত করছি বুঝতে পেরে, তোশকটি নিয়ে এসে যত্ন করে পেতে দিল, খুদে চিয়োকে সেটির ধার ঘেঁষে মেঝের ওপর বসিয়ে দিল।
এক আঁটি ভিজে ডালপালা ফায়ারপ্লেসে রেখে, কয়েকটি ছেঁড়া ম্যাগাজ়িনে আগুন ধরিয়ে কাঠের ওপর রাখলাম। বাড়ির জমির সীমানায় থাকা প্রোপেন গ্যাসের শেডের ভাল্ভ খুলিনি বলে জল ফোটাতে পারিনি। ঈয়ো’র হাতে স্টেশন থেকে কেনা লাঞ্চবক্স আর এক কাপ জল ধরিয়ে, রান্নাঘরে রাখা সাকে’র৪ পাঁচ লিটারের বোতল থেকে খানিকটা আমার কাপে ঢেলে পান করতে করতে আগুনের তদারক করতে লাগলাম। বড়সড় শরীর নিয়ে ঈয়ো’ অন্ধকারে কুঁজো হয়ে বসে, লাঞ্চবক্সের ভেতর তেরছাভাবে তাকিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে খাবার মুখে তুলছে। নীরবে, অনেকটা সময় নিয়ে, খাওয়া শেষ করল। তারপর তোষকের ওপরে রাখা লেপটির ঠিক মাঝখানে গিয়ে শুয়ে পড়ল, খুদে চিয়োকে পাশে নিয়ে। নাক ডাকতে লাগল খুব জোরে জোরে, মৃগীর আক্রমণের সময় যেমন ডাকে। নিভু নিভু আগুনের পাশে একা একা জেগে আমি।
ঝোড়ো হাওয়া আর প্রবল বৃষ্টির দাপটে, কাঠের পাল্লাগুলি থেকে খড়খড় আওয়াজ উঠতে লাগল। এক সময় মড়মড় একটি শব্দ শুনতে পেলাম, যেন বড় একটা গাছ গুঁড়ির কাছ থেকে ভেঙে পড়েছে। ঘুমের মধ্যেই ঈয়ো’র নাসিকা গর্জন গোঙানির শব্দে বদলে গেল। লেপের ওপরে চিৎ হয়ে, পা দুটো লম্বা করে শুয়ে, ওকে ঠিক কবরে শুয়ে থাকা মমির মত লাগছিল। ওর পাশে খুদে চিয়ো – স্প্রিং দেওয়া চোখের পাতা বন্ধ – ওটিকেও ছোট একটি মমির মত লাগছিল – যেন প্রভুর সঙ্গে ওটিকেও কবর দেওয়া হয়েছে।
ফায়ারপ্লেসের আলোয়, চশমা ছাড়াই, একটি বই পড়ছিলাম। চোখ জুড়িয়ে এল। লেখক হিসেবে নিজের রচনাগুলি অগভীর এবং অতি সরল মনে হতে লাগল। তার ওপর, মনে হল, সময় চলে যাচ্ছে, অথচ যা সত্যি সত্যিই আমার করার কথা ছিল, তার কিছুই আমি করে উঠতে পারিনি। বলেছিলাম, বিশ্বের এবং বিশ্বকে নিয়ে যাবতীয় বস্তু আমার পুত্রের জন্য সঠিকভাবে বর্ণনা করে ফেলব, কিন্তু পেরে উঠিনি। ধরা যাক, ঈয়ো’ যদি আজ কলেজ পড়ুয়া হত, বুদ্ধিবৃত্তি স্বাভাবিক হত, আর আমাকে এসে জিজ্ঞেস করত, “পাপা, যতটা সম্ভব পক্ষপাতশূন্য হয়ে আমাকে বোঝাও তো, তোমার জীবনের এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে, মৃত্যু বলতে সঠিকভাবে তুমি কী বুঝতে পেরেছ?” স্বভাবতই, আমার পুত্র যদি সুস্থ মনের হত আর এই প্রশ্ন করত, তাহলে ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে আমাকে চিন্তার গভীরে ডুবে যেতে হত না।
উইলিয়াম ব্লেকের কথা মনে এল, ‘দ্য ফোর জ়োয়াজ়’৫-এর থার্মাস নামক এক দেবতার কথা। মহাকাব্যিক এই গাথার শুরুতে, যেখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিশৃঙ্খলা প্রতিভাসিত হয়েছে, থার্মাস এবং তাঁর প্রেমিকা এনিয়নের মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়া অনিবার্য ছিল। বিচ্ছেদের মুহুর্তে ওঁদের করুণ সঙ্গীত আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে। মেঘের আড়ালে বসে কম্পিত কণ্ঠে পাণ্ডুর থার্মাসের গাওয়া কলিগুলি সুতীব্ররূপে মর্মভেদী – “আমি পরমাণুসম/ অন্ধকারে পরিত্যক্ত একটি অনস্তিত্ব, অথচ আমি অভিন্নতা;/ আমার কামনা এবং অনুভূতি আছে, আমি কাঁদি, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করি। হায়, নিদারুণ! অতি নিদারুণ!”
আমার পুত্রটি স্বাস্থ্যবান, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পাঠরত, একটি প্রশ্ন করেছে আমাকে, এমন একটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আমি বলে উঠলাম, “ঈয়ো’! মৃত্যুর মুহুর্তে আমরা শুধুই থার্মাসের বিলাপটিরই পুনরাবৃত্তি করতে পারি! পাণ্ডুর মুখে, কম্পিত কণ্ঠে, হাসপাতালের উঁচু শয্যাকে যদি মেঘ বলে মেনে নিই।”
মনে হল, ঝঞ্ঝার আওয়াজ – যা থেমে যাওয়ার কোনও লক্ষণই নেই – চারদিক থেকে আমাকে যা বেষ্টন করে রেখেছে – তবুও এই কথাগুলি যে বলে উঠতে পারলাম, তার অর্থ এই যে আমি সুরাসক্ত হয়ে পড়েছি। ঘুমঘোরে রয়েছি বলেও মনে হল। হঠাৎ শান্ত, মৃদু একটি হাতের স্পর্শে – আমার কাঁধে, আমার বাহুতে, আমার বুকের আশেপাশে – আমি জেগে উঠলাম, একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “ঠিক আছে! ঠিকই আছে! ওটা একটা স্বপ্ন ছিল। তুমি স্বপ্ন দেখছিলে! ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওটা কেবলই একটা স্বপ্ন!”
তা সত্ত্বেও, যা নিয়ে বলছিলাম, সেটি বলেই যেতে থাকলাম, বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে ওঠার জন্য আরও একটু জোরে, প্রায় অশরীরী একটি সত্তাকে উদ্দেশ্যে করে, যে আমার পুত্র। চোখ যখন খুললাম, দেখি ঈয়ো’ হাঁটু মুড়ে আমার পাশে বসে, দুই বাহু প্রসারিত করে আমার শরীরকে শান্ত করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে; আগুনের আলোয় ঘন, অস্পষ্ট দেখানো ভুরুর নীচে কালো দুটি চোখ দিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি উঠে বসতেই, খুব তৎপরতার সঙ্গে – যে তৎপরতা ও মাঝে মাঝেই দেখিয়ে থাকে - খুদে চিয়োকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে, আমার ঘুমোনোর জন্য খানিক জায়গা করে দিল। নিজেও আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল, আমি ওর পাশেই শুয়ে পড়লাম, চিৎ হয়েই, তারপর দুজনের ওপরেই লেপটা টেনে নিলাম।
মদের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকার জন্য, পরক্ষণেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, ঈয়ো’র চমকপ্রদ কথা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই। এক পলকের জন্য মনে হয়েছিল যেন বসার ঘর সংলগ্ন ডাইনিং রুমের পাশে খুলে রাখা দরজাটা দিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে অন্ধকারে মধ্যে কারোর চলে যাবার শব্দ পেলাম।
ঘুম যখন ভাঙল, ঈয়ো’ আমার পাশে নেই, ফায়ারপ্লেসের কাছে, যেখানে আমি শুয়েছিলাম, সেখান থেকে সব চেয়ে দূরের জানলাটি খোলা, আর ঘরে আলো আসছে। ঘরের ভেতরে ভরে ওঠা ধোঁয়ার গন্ধ ছাপিয়ে পাইনের এমন উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগল যে আমার মাথা ভার হয়ে গেল। শরীরটা গড়িয়ে জানলার পাশে নিয়ে গেলাম। আবিষ্কার করলাম, আমার আর আলোয় সাদা হয়ে যাওয়া জানলার মাঝখানে রাখা চেয়ারগুলির একটিতে সিলুয়েট হয়ে যাওয়া প্রতিবিম্বের মত একটি ছায়ামূর্তি সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে। ছায়ামূর্তিটি আমার স্ত্রীর হতে পারে ভেবে সেদিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই সূর্যালোকিত জানলার বাইরের দৃশ্য নজরে এল – কেমন যেন অস্বাভাবাবিক – অসম্পূর্ণ। তাছাড়া আলো ঝলমলে ওই স্থানে, কালো, চ্যাপ্টামত কিছু একটা দেখা দিয়েই আবার হারিয়ে যাচ্ছে –কিছু একটা যেন ওপরে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, ফিরে আসতে না আসতেই আবার ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। বহু দিনের অভ্যাসবশত, মাথার আশেপাশে হাতড়ে চশমা খুঁজতে লাগলাম। চশমাটি পেলাম, যদিও সেটি ওখানে থাকার কথা নয়। কালো বস্তুটি চিনতে পারলাম – একটি কাক – বেশ নধর, বড়সড়, পাখিটি আমার অতিপরিচিত। বিশাল পাইন গাছটির ডালের ওপর এসে বসবে, তারপর আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে, ঠিক যেন দেহচর্চা করছে। চোখের সামনে থেকে উড়ে গিয়ে উধাও হয়ে যাবে, তারপর আবার জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ফিরে আসবে। আজ গাছের ওপরের দিকের সেই ডালপালা – বসার জায়গাটি অদৃশ্য হয়ে গেছে, সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে গেছে পুরো পাইন গাছটি।
“ঈয়ো’ই তোমার চশমাটা খুঁজে পেল। আর কারোর হাতে দিতেই চাইল না তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য,” আমার স্ত্রী বলল। “ওরা সবাই বাইরেই আছে, জায়গাটা পরিষ্কার করছে। ভেঙে যাওয়া ডালপালা জড়ো করছে, জ্বালানি কাঠের জন্য।”
“বড় পাইন গাছটা নিশ্চয়ই পড়ে গেছে! কত পুরোনো গাছ – এতদিন সব ঝড় জল সহ্য করে দাঁড়িয়ে ছিল– আর এক রাতের ঝড়েই উপড়ে গেল! কী আশ্চর্য!”
“একেবারে রাস্তার ওপর ভেঙে পড়েছে। টেলিফোন লাইনগুলো অচল হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই শব্দ পেয়েছিলে?"
“পেয়েছিলাম। তুমি পাওনি?”
“আমরা তো আজ ভোরেই এলাম।”
“তাই বুঝি? কাল শেষ রাতে মনে হচ্ছিল যে তুমি করিডরে দাঁড়িয়ে আছ!”
পলকের জন্য ছায়ামূর্তির শরীর যেন শক্ত হয়ে উঠল; তারপর আমার স্ত্রীর আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ শুনতে পেলাম, “ওখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের চলে যেতে দেখা সম্ভব ছিল না। ইতো’র একটা বাণিজ্যিক হোটেলে রাত কাটিয়েছি আমরা তিনজন।”
ঈয়ো’ আর আমি রওনা হয়ে যাওয়ার পরে, আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়ে নিজেরাই ইজ়ুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে – টোকিয়ো স্টেশন থেকে বুলেট ট্রেনে। ঘূর্ণিঝড়ের জন্য বুলেট ট্রেনও ধীরে চলতে বাধ্য হচ্ছিল। ইতো’তে যখন পৌঁছল, রাত প্রায় দশটা। স্টেশন থেকে যে ট্যাক্সিটি ওরা ভাড়া করল, ঘটনাচক্রে সেটিই ঈয়ো’ এবং আমাকে পাহাড়ের ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়েছে। ওরা চাইলে ড্রাইভারের ওদেরও পৌঁছে দিতে আপত্তি ছিল না, যদিও ঝোড়ো বৃষ্টির দাপট তখন ঘন্টাদুয়েক আগের থেকে আরও খারাপ হয়েছে। তবে জানিয়ে দিল যে থানায় নেমে ঘটনাটিকে সাম্ভাব্য পারিবারিক আত্মহত্যার প্রচেষ্টা হিসেবে দর্জ করানো দরকার … এরপর, সম্পূর্ণভাবে হতোদ্যম বউ আর ছেলেমেয়েদের, ইজ়ুর অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে, জীবিত অবস্থায় ইতো’র একটি বাণিজ্যিক হোটেলে নিয়ে গিয়ে রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করে দিল।
“পারিবারিক আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, কী অদ্ভুত কথা!” হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার স্ত্রীর ছায়ামূর্তির টানটান ভাবটা থেকেই গেল।
আবার শুয়ে পড়লাম। স্ত্রী কথা বলতে থাকল – যেন মনে মনে এসব কথা এতক্ষণ চেপে রেখেছিল। “সাকু” – আমাদের ছোট ছেলে – “গতকাল বলল, বাড়ি পৌঁছানোর পর ঈয়ো’ হয়ত শান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু ইজ়ু পৌঁছে পাপা কী ভাবতে থাকবে, সেটা জানার কোনও উপায় নেই। ‘তাই মনে হয় আমাদেরও বেরিয়ে পড়া উচিৎ,’ ও বলল, “অন্তত পাপার কথা ভেবে!’”
বৃষ্টি ধরে গিয়ে বাতাসের বিঘ্নহীন শব্দ আর ছেলেমেয়েদের কলরব কানে আসছিল। বিশেষ করে ঈয়ো’র। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ছোট ভাইবোনকে ছোট ছোট কাঠের টুকরো জড়ো করবার নির্দেশ দিচ্ছিল, আর বড় বড় কাঠ সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছে নিজে। শুয়ে শুয়ে মনে অস্বস্তি নিয়ে ভাবছিলাম, কী করে বউয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াব আর মুখের একটা দিক ফুলে যাওয়ার জন্য কী কৈফিয়ত দেব। কাল যেরকম বাজে ব্যবহার করেছি, আমার উচিৎ এই মুহুর্তেই বউ আর অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার হালকা করে নেওয়া। আলোর দিকে মুখ করে উঠে বসলাম; তারপর যেন নিজেই নিজেকে এবং অন্যদের উৎসাহ দিচ্ছি এই রকম গলায় বলতে শুরু করলাম; আমার ফুলে যাওয়া মুখ দেখে স্ত্রী যে শিউরে উঠল, সেটা বুঝলাম। “ঈয়ো’ স্বপ্ন দেখে না। তবে অন্যরা যে স্বপ্ন দেখে, সেটা ওর অজানা নয়। আরও একটু বড় হওয়ার পর, এমন একদিন সত্যিই যদি আসে, যেদিন ও স্বপ্ন দেখবে, সেদিন ওটা যে স্বপ্ন ছিল সেটা বুঝতে পারবে বলেই মনে হয়। এই কথাটা জানতে পারলাম বলেই কালকের রাতটা খুব মূল্যবান।”
মনে একটা ভয় ছিল, ঈয়ো’র দেখা প্রথম স্বপ্নটি হয়ত খুবই যন্ত্রণাদায়ক হবে, আমি হয়ত বেঁচে থাকব না সেই সময় ওর পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তবে আজ আমি জেনে গেছি, যদি এরকম কিছু কখনও ঘটে, একজন স্বপ্নদর্শী হিসেবে ঈয়ো’ নিজেকে বলতে পারবে, “এটা কোনও ব্যাপার নয়! কোনও ব্যাপারই নয়! এটা তো শুধুই একটা স্বপ্ন।” তাহলে আমি কেন এটা ভেবে এত হয়রান হয়ে পড়ি? ঈয়ো’ নিজেই নিজেকে আশ্বস্ত করতে থাকবে, “তুমি তো স্বপ্ন দেখছিলে! ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। ওটা তো কেবল একটা স্বপ্ন!”
-----------------------------------------------------------------
(জাপানি থেকে গল্পটির ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন জন নাথান)
টীকাঃ
* ঈয়ো’ – এ এ মিলনে’র উইনি দ্য পূহ্কে নিয়ে লেখা বইগুলির হতাশাপীড়িত, মনমরা, বিষণ্ণ, দুঃখবাদী একটি কাল্পনিক চরিত্র (পুরুষ গাধা)।
১ বেন্টো – জাপানী লাঞ্চ-প্যাক।
২ সুশি – একটি জাপানী ডিশ – চাল, সি-ফুড এবং অন্যান্য সবজি (অনেক সময় কাঁচা সবজি) মিশিয়ে বানানো হয়।
৩ চিয়ো – একটি জাপানী শব্দ যার অর্থ সহস্র প্রজন্ম বা বিশ্ব – কাছাকাছি বাংলা শব্দ – সসাগরা পৃথিবী। এটি মেয়েদের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৪ সাকে – এক ধরণের জাপানি ওয়াইন।
৫ দ্য ফোর জোয়াজ – ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক রচিত একটি মহাকাব্যিক কবিতা। থার্মাস হলে চারটি জ়োয়ার একটি।
লেখক পরিচিতিঃ
কেনজাবুরো ওয়ে (জন্ম ৩১ জানুয়ারি ১৯৩৫) – সমসাময়িক জাপানি সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র। ওঁর উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধে ফরাসী এবং মার্কিন সাহিত্যের প্রভাব লক্ষণীয়। ১৯৯৪ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ় পান। ওঁর উল্লেখযোগ্য রচনাঃ ‘এ পার্সোনাল ম্যাটার’, ‘দ্য সাইলেন্ট ক্রাই’।
অনুবাদক পরিচিতি
উৎপল দাশগুপ্ত
অনুবাদক। ফটোগ্রাফার।
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।
কলকাতায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ