নাওয়াল এল সা’দয়ি'র গল্প : জন্নতে তার কোনো ঠাঁই নেই



ইংরেজি ভাষান্তরঃ শার্লি এবের
বাংলা ভাষান্তরঃ সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত

শরীরের নিচের মেঝেটা সে নিজের হাতের তালু দিয়ে ছোঁয়, কিন্তু কোনো মাটির উপস্থিতি টের পায় না। ওপরের দিকে তাকায়, ঘাড় ঘোরায় আলোর দিকে। লম্বা, ক্ষয়াটে তার মুখ, গাঢ় চামড়া, পুরোটাই কালো দেখাচ্ছে।

অন্ধকারে সে নিজের মুখ দেখতে পায় না, হাতে আয়নাও নেই। স্বচ্ছ আলোর রেখা তার হাতের উল্টোদিকে পড়ায় তা ফরসা দেখাচ্ছে। তার কুতকুতে চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে, আলোকময়। টানা, উজ্জ্বল চোখ দুটি কোনো হুরির চোখের মত মনে হয়।

হতবাক হয়ে, সে তার মাথা ডান দিক-বাঁ দিকে ঘোরায়। ছায়ায় বসে সে দেখে তার আর একটা পাতায় ঢাকা গাছের মধ্যে বিস্তৃর্ণ একটা ফাঁক। পাশ দিয়ে রুপোলি তারের মত জলের ধারা বইছে, মুক্তোর মত ছড়িয়ে পড়ছে জলের ফোঁটা, যেন কানায় কানায় পূর্ণ এক থালা ---

চোখের পাতা শক্ত করে রাখে যাতে চোখ পুরোটা খুলে দেখা যায়, যদিও দৃশ্য সব আগের মতই, পাল্টায়নি। সে নিজের বোরখা স্পর্শ করে এবং অনুভব করে সেটা রেশমের মত নরম। ঘাড়ের কাছ থেকে তার জামা (গাউন) থেকে সুরভিত হচ্ছে কস্তুরীর সৌরভ বা খাঁটি কোনো খুশবু।

সে নিজের হাত-চোখ সব অসাড় করে রেখেছে এই ভয়ে, যদি সামান্য চোখের পলক ফেলায় এই দৃশ্যপট যায় বদলে, বা অদৃশ্য হয়ে যায় আগের মতই।

চোখের কোণ দিয়ে নিজের সামনে সে দেখতে পায় অনন্ত এক ছায়াময় পরিসর, আর সবুজ বৃক্ষের কান্ডের মাঝখানে প্রাসাদের মত লাল ইটের এক বাড়ি, তার মার্বেলে গড়া সিঁড়ি শোবার ঘর বরাবর উঠে গেছে।

সে তার দৃষ্টি অকুস্থলে স্থির রেখেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও না। তার মৃত্যু হয়েছিল এবং তারপর আবার সে জেগে উঠেছে, বারবার এই একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি তাকে যেমন বিচলিত করে রেখেছে, আর কোনো কিছুই তত বিচলিত করতে পারেনি। স্বপ্নটাকে অসম্ভব বলেই তার মনে হয়েছিল, কারণ মৃত্যুটাই অসম্ভব, মৃত্যুর পরে আবার জেগে ওঠা তো আরও অসম্ভব, আর স্বর্গে পৌঁছে যাওয়াটা তো চতুর্থ অসম্ভাব্যতা।

ঘাড় আরও বেশি  সোজা করে চোখের কোণ দিয়ে সে আলোর দিকে তাকায়। সামনের দৃশ্যাবলি এখনও সেই একইরকম, পাল্টায়নি। লাল বাড়িটা, ঠিক ওমডাদের মত, উঁচু সিঁড়ি শোবার ঘরের দিকে উঠে যাচ্ছে, ঘরটা যেন সাদা আলোয় গোসল করছে। জানলা দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে দিগন্ত, প্রশস্ত শয্যা, তার ছতরিগুলোয় লাগানো রেশমের পর্দা, সব কিছু এখনও একইরকম।

ব্যাপারটা এতটাই বাস্তব যে অস্বীকার করার উপায় নেই। যেখানে ছিল সে এখনও ওখানেই আছে, সরতে ভয় পাচ্ছে। ভয় হচ্ছে বিশ্বাস করতে। এটা কি সম্ভব, মৃত্যুর পর এত তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা আর তারপর জন্নতে চলে যাওয়া?

সবচেয়ে অবাক লাগে এতসব কাণ্ড এত তাড়াতাড়ি ঘটায়। মৃত্যু, যদিও সহজ। প্রত্যেকেই মারা যায়, আর তার মৃত্যুটা অন্যের চাইতে সহজ, কারণ তার জীবনটাই ছিল জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে আটকানো, মৃত্যুরই কাছাকাছি প্রায়। মেয়েটির জন্মের সময় নিজের শরীরের পুরো ভার মেয়েটির ওপর রেখেছিলেন তার মা, যাতে সে মারা যায়। মেয়েটির বাবা একটা নিড়ানি দিয়ে ওকে ততক্ষণ মারতেন যতক্ষণ না সে মারা যায়। প্রতিটি প্রসবের পর তার জ্বর হত, এমন কি অষ্টম সন্তান পর্যন্ত, যখন তার স্বামী তার পেটে লাথি মারত, যখন সূর্যের চড়া রশ্মি তার মাথার ভেতর অবধি ঝাঁঝিয়ে দিয়ে যেত।

বেঁচে থাকাটাই মেয়েটির কাছে ছিল বরং কঠিন, মরে যাওয়ার চেয়ে। মৃত্যুর পর জেগে ওঠাও সোজা, কেন না কেউ মরে না, আবার জেগেও ওঠে না। প্রত্যেকেই মারা যায়, জেগে ওঠে। একমাত্র জন্তুরা ছাড়া, তারা মরে যায় আর মৃতই থাকে।

জন্নতে মেয়েটির পক্ষে পৌঁছনো ছিল অসম্ভব। কিন্তু মেয়েটি না পৌঁছলে, কারা যায় জন্নতে? সারাটা জীবন ধরে মেয়েটি এমন কিছু করেনি, যা আল্লাহ বা তাঁর পয়গম্বরের রাগের কারণ হতে পারে। সে তার রুক্ষ কালো চুল একটা সুতির কাপড়ে জড়িয়ে বিনুনি করে রাখত, সেই বিনুনি আচ্ছাদিত করত একটা সাদা রঙের মাথার রুমাল দিয়ে, তারপর পুরো মাথা ঢেকে নিত কালো শালে। তার বোরখার তলা দিয়ে পায়ের গোড়ালি ছাড়া আর কিছুই দেখা যেত না। জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যুর সময় অবধি মেয়েটি শুধু জানত একটিই কথা ---ঠিক আছে।

ভোর হবার আগে সে যখন বিছানায় শুয়ে, তার মা তাকে একটা চড় মেরে ঘুম ভাঙিয়ে পাঠিয়ে দিতেন মাথায় করে গোবরের ঝুড়ি বয়ে আনার জন্য, সে বলত “ঠিক আছে”। গরুটা অসুস্থ থাকায় মেয়েটির বাবা যখন তাকে গরুর জায়গায় বেঁধে জোয়ালে ঘোরাত সে বলত –--“ঠিক আছে”। নিজের স্বামীর দিকেও সে কখনও চোখ তুলে তাকায়নি। জ্বরে আক্রান্ত থাকাকালেও মেয়েটির স্বামী তার ওপরে শুত, তখন মেয়েটি শুধু উচ্চারণ করত ---ঠিক আছে।

সারা জীবন মেয়েটি কিছু চুরি করেনি, মিথ্যেও বলেনি। খিদেয় মরে গেলেও সে অন্যের খাবার কখনওই খায়নি, এমনকি সেই খাবার যদি হত তার বাবার, ভাই, বা স্বামীর তবু সে খেতো না। মেয়েটির মা একটা গোটা পাউরুটির মধ্যে খাবার মুড়ে মেয়েটির হাত দিয়ে পাঠাত মাঠে তার বাবার জন্য, মেয়েটি মাথায় চাপিয়ে সেটা নিয়ে যেত। মেয়েটির স্বামীর জন্য ঠিক এভাবেই খাবার বেঁধে দিতেন মেয়েটির শাশুড়ি। একা পথ দিয়ে যাবার সময় মেয়েটির লোভ হত ছায়ায় দাঁড়িয়ে সেই মোড়ানো খাবার খোলার জন্য, কিন্তু সে একটিবারের জন্যেও কোনোদিন দাঁড়ায়নি। যখনই মোড়ানো খাবার খোলার চিন্তা মাথায় আসত, মেয়েটি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হত কুচিন্তার থেকে মুক্তি পাবার আশায়। আর পেটের ক্ষিধে যখন অসহ্য হয়ে পড়ত তখন মেয়েটি নিরুপায় হয়ে রাস্তার ধারের বুনোঘাস ছিঁড়ে রবারের মত চিবোতে শুরু করত, আর খালের পাড় থেকে আঁজলা ভরে জল খেত যতক্ষণ না তেষ্টা মেটে। তারপর বোরখার হাতা দিয়ে মুখ মুছে মেয়েটি বিড়বিড় করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিত, পরপর তিনবার। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত মেয়েটি, জমিতে মাথা ঠেকিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাত। জ্বর হোক কি মাথায় আগুনের হলকার মত রক্ত চড়ে গেলেও মেয়েটি ঈশ্বরের প্রার্থনা করত। রোজার দিনগুলোয় সে রোজা রাখত, রান্নার দিনে রান্না করত, ফসল বোনার সময় ফসল বুনত, শোকের দিনে সে তসবীহ নিয়ে চলে যেত গোরস্থানে।

কোনোদিন তার বাবা, ভাই বা স্বামীর প্রতি ধৈর্যহারা হয়নি সে। স্বামী যখন মারতে মারতে প্রায় মেরে ফেলত তাকে, সে ফেরত আসত বাপের বাড়ি। বাবা তাকে আবার পাঠিয়ে দিতেন স্বামীর বাড়ি। আবার বাবার কাছে ফিরে এলে বাবাও মারতে মারতে পাঠিয়ে দিতেন স্বামীর কাছে। স্বামী যদি বা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিত বের না করে দেওয়ার বদলে, তাহলে আবার মারত। তখন মেয়েটি যেত মায়ের কাছে, তাঁর মা তাকে বোঝাতেনঃ ফিরে যাও, জাইনাব। এসবের পরে জন্নাত থাকবে তোমার অপেক্ষায়।

জন্মানোর পর থেকেই মায়ের কাছ থেকে সে শুনে আসছে স্বর্গের কথা। প্রথম যেদিন শোনে সেদিন প্রখর রোদে মেয়েটি হাঁটছিল। মাথায় ছিল এক ঝুড়ি গোবর, পায়ের পাতা মাটির তাপে পুড়ে যাচ্ছিল। তখন কল্পনায় সে স্বর্গ দেখতে পেল, বিস্তৃত এক ছায়াঘেরা স্থান যেখানে তার মাথায় গোবরের ঝুড়ি নেই, আর তার পায়ে প্রতিবেশির ছেলে হাসানের মত জুতো। সে মাটিতে পা ফেলছে ঠিক হাসানের মত করে। ছেলেটি তার হাত ধরে, আর তারা দুজন বসে সেই ছায়াবৃত স্থানটিতে।

হাসানের কথা মনে এলে মেয়েটির কল্পনার দৌড় ছিল এটুকুই, সে ছায়ায় ঘেরা জন্নতে হাসানের হাত ধরে বসে আছে। কিন্তু মা ধমক দিলেন, বললেন, হাসান বা কোনও প্রতিবেশীর ছেলে, কেউই জন্নাতে থাকবে না। যদি বিয়ের আগেই আমি মরে যাই তাহলে বাবা আর ভাইকেই দেখতে পাব আর বিয়ের পর যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে আমি জন্নাতে গিয়ে স্বামীকে পাব। কিন্তু যদিও তার মন জাগ্রত বা নিদ্রা কোনো অবস্থাতেই স্বামী ছাড়া আর কারুর কথা কল্পনা করে তার হাত না ধরলেও, তা বলে সে স্বর্গের এক ঝলকও চোখে দেখতে পাবে না, বা হাজার মিটার দূর থেকেও পাবে না স্বর্গের সৌরভ।

এরপর থেকে, যখনই মেয়েটি বিছানায় যেত ঘুমোতে, স্বামীকেই দেখত। স্বর্গে, তার স্বামী তাকে মারছে না। তার মাথার ওপর আর ঝুড়ি ভর্তি গোবর নেই। রোদের প্রচণ্ড তাপে তার পায়ের পাতাও পুড়ে যাচ্ছে না। তাদের কালো মাটির বাড়ির বদলে এখন লাল ইটের বাড়ি, ভেতরে উঠে গেছে সিঁড়ি, আর তারপর একটা বড় বিছানা পাতা যেখানে তার স্বামী বসে আছেন তার হাতটি নিজের হাতে ধরে।

মেয়েটি নিজের কল্পনায় ---স্বর্গে তার স্বামী তার হাত ধরে বসে আছে, এর বেশি কিছু ভাবতে পারত না। সারা জীবনে মেয়েটি কখনও তার স্বামীর হাত ধরেনি। আটটি ছেলে-মেয়ে হয়েছে স্বামীর সংস্পর্শে, কিন্তু হাত ধরার অনুভূতি হয়নি। গরমের রাতগুলোয় স্বামী মাঠে শোয়, আর শীতে শস্য-গোলায় বা উনুনের পাশে। একবারও পাশ না ফিরে সারাটা রাত সে শুয়ে থাকত চিত হয়ে, আর পাশ ফিরলে মেয়েটিকে ডাকত শেয়ালের মত গলায় –এই মেয়ে! মেয়েটির সাড়া দেওয়া বা “আচ্ছা” বলার কোনো তোয়াক্কা না করে লাথি মেরে স্ত্রীকে চিত করত আর তারপর তার শরীরে চড়াও হত। যদি মেয়েটি কোনো শব্দ করত বা দীর্ঘশ্বাস ফেলত তাহলে স্বামী আবার লাথি মারত, মেয়েটি যদি নিঃশব্দ থেকে দীর্ঘশ্বাসও না ফেলত তবু তার ভাগ্যে জুটত তৃতীয়বারের লাথিটি, তারপর চতুর্থ লাথিটি যতক্ষণ না মেয়েটি শব্দ করত। কোনোদিনও তার স্বামী তার হাত ধরেনি বা নিজের হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেনি।

মেয়েটি এমন কোনো যুগল দেখেনি সে মানুষের বা অন্য কিছুরই হোক, যারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। শুধু পায়রার খোপে দেখা যেত, যখন মেয়েটি ওদিকে যেত, পাঁচিলের ওপরে একজোড়া পায়রা, একটির ঠোঁট ছুঁয়ে আছে অন্যের ঠোঁট। অথবা যখন গরুর খোঁয়াড়ে যেত দেখত একজোড়া গরু আর ষাঁড়, কিম্বা মোষ নয়ত জোড়া-কুকুর। মা তখন একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে আস্ফালন করে ওগুলোকে চাবকাতেন আর গালাগাল দিতেন।

জীবনে কখনোই সে তার মাথা থেকে কালো শালটি সরায়নি বা তার নিচের সাদা রুমালটি খোলেনি, শুধুমাত্র যখন কেউ মারা যেতেন তখন সাদা রুমালটি খুলতে হত, আর কালো শাল দিয়ে মাথা ঢেকে নিত। যখন তার স্বামী মারা গেল, তখন তিনটে বছর সে কালো শালটি দু-ফেত্তা করে পেঁচিয়ে কপালে বেঁধে শোকের পোশাক পরেছিল। একজন লোক ছেলেমেয়েদের দায় না নিয়েই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। মেয়েটির মা বিরক্তিতে থুতু ফেলে, মেয়েটির মাথার কালো শাল কপাল অবধি টেনে দিয়ে বিড়বিড় করেন –কী লজ্জার কথা! এক মা তার ছেলেমেয়ে ছেড়ে চলে যাবে একটা পুরুষের জন্য? ক’বছর পর আবার আরেকজন মেয়েটির পাণিপ্রার্থী হয়ে এল। এবার ছেলেমেয়ে সমেত। মেয়েটির মা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেনঃ একটা মেয়ের মা হওয়া আর স্বামী মারা যাওয়ার পর আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

একদিন তার ইচ্ছে হল কালো শালটা সরিয়ে শুধুই সাদা রুমালটা বাঁধতে, কিন্তু সে ভয় পিছিয়ে যায়। যদি সকলে ভাবে, সে স্বামীর কথা ভুলে গেছে। তাই মেয়েটি কালো শাল আর শোকের পোশাক পরেই বাকি জীবনটা কাটায় যতদিন না শোকে তার মৃত্যু হল।

কবরের ভেতর একটা রেশমের কাফনে আচ্ছাদিত অবস্থায় মেয়েটি নিজেকে দেখে। শবযাত্রার পেছন থেকে, তাঁর মা আর্তনাদ করে কাঁদছেন, আর তা শোনাচ্ছে ঠিক যেন রাতের ট্রেনের বাঁশিঃ তুমি স্বামীর সাথে স্বর্গে মিলিত হবে জাইনাব।

এরপর কোলাহল থেমে যায়। নৈঃশব্দ্য ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, মাটি ছাড়া আর কোনও ঘ্রাণও সে পায় না। শরীরের নিচের মাটি তুলোর মত নরম। মেয়েটি বললঃ এটা নিশ্চয়ই কাফনের কাপড়। মাথার ওপরের দিক থেকে কর্কশ স্বরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, দু’জন লোক ঝগড়া করছে। সে বুঝতে পারে না, কেনই বা ওরা ঝগড়া করছে। কিন্তু সে মন দিয়ে ওদের ঝগড়া শোনে, এমন কি তার নিজের নামও ওদের মুখে সে শুনতে পায়। শুনতে পায় কেউ একজন বলছে, তার নাকি কবরের ভেতরকার অত্যাচার ছাড়াই সরাসরি স্বর্গে পৌঁছনো উচিত। কিন্তু আরেকজন তাতে রাজি নয়। সে জোর করে বলছে, মেয়েটির কবরের মধ্যে খানিকটা অত্যাচার প্রাপ্য, একটু হলেও। কিন্তু প্রথমজন সেই গোঁ ধরে আছে, মেয়েটি এমন কিছু করেনি যাতে তাঁর কবরে অত্যাচারিত হওয়ার কথা থাকতে পারে, মেয়েটি তার স্বামীর প্রতি একশো ভাগ বিশ্বস্ত ছিল। দ্বিতীয় লোকটি তর্ক করে যায় এই বলে, মেয়েটির চুল সাদা রুমালের তলা দিয়ে দেখা যেত, আর মেয়েটি হেনা দিয়ে নিজের চুল রাঙিয়ে রাখত, এমন কি বোরখার তলা দিয়ে হেনার ছোপ ধরা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত দেখা যেত তার।

প্রথম লোকটি প্রত্যুত্তরে বলে, না মেয়েটির চুল কখনওই দেখা যায়নি। যেটা তুমি দেখেছ, সেটা চুল ঢাকার সুতির জটা। তার বোরখা খুবই লম্বা আর পুরু ছিল, আর ভেতরকার স্কার্ট ছিল আরও লম্বা আর মোটা, তাই কেউই মেয়েটির লাল গোড়ালি দেখেনি। কিন্তু তার সহচর মানতে নারাজ। সে তর্ক করতে থাকে এই বলে যে, মেয়েটির পায়ের লাল গোড়ালি দেখে গ্রামের অনেক পুরুষই মেয়েটির প্রতি প্রলুব্ধ হয়েছে।

দুজনের তর্কাতর্কি চলে সারারাত। মাটির দিকে মুখ রেখে সে শুয়ে থাকে, নাক মুখ মাটিতে চেপে যায়। নিঃশ্বাস আটকে মরার অভিনয় করে যেতে থাকে। ওরা যদি জানত যে সে মরেনি তাহলে অত্যাচার আরও বাড়ত, মৃত্যুই হয়ত তাকে বাঁচাল। মেয়েটি আর কিছুই শুনতে পেল না। কাউকে দেখলও না। মানুষ বা আত্মা, মৃত্যুর পর কবরের মধ্যে যেমন সব ঘটে থাকে, কিছুই ঘটল না। কেউ যদি কোনোভাবে কিছু শুনে ফেলে, তবে তাকে না শোনার-না বোঝার ভান করতে হবে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই লোক দুটো কবরখানার ফেরেশতা নয়। কোনও ফেরেশতাই নয়। কারণ কোনো ফেরেশতা এই সত্যকে অস্বীকার করবে না, যা সারা গ্রামবাসী নিজের চোখে এতকাল দেখে এসেছে। তার গোড়ালিতে কখনওই লাল রঙ ধরেনি যেমনটা ছিল ওমডার মেয়ের, বরং তাঁর মুখ আর হাতের তালুর মতই তাঁর পায়ের গোড়ালিও ছিল ফাটা-ফাটা আর মাটির মত কালো।

ভোরের আগেই লোক দুটির তর্ক শেষ হয়, তার ওপর অত্যাচার ছাড়াই। কথাবার্তা থামার পর সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। তার শরীর হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে শূন্যে ওড়ার মত। সে যেন আকাশে ভাসতে থাকে, তারপর খুব ধীরে যেন তাঁর শরীর নেমে এসে নরম মাটিতে অবতরণ করে। ভেজা জমি, খাবি খেয়ে মেয়েটি বলে ওঠেঃ জান্নাত।

সন্তর্পনে মাথা তুলে মেয়েটি দেখে চারদিকে বিস্তৃত সবুজ আর ঘন পাতায় ঘেরা গাছ। ছায়ায় ঘেরা গাছের আচ্ছাদন। মাঠের ওপর বসে সে দেখতে পায়, সামনে অসীম বিস্তৃত বৃক্ষরাজি। টাটকা হাওয়া তার বুকে ঢুকছে, তার ভেতরের ধুলো-ময়লা সব অপসারিত হচ্ছে, আর সেইসঙ্গে গোবরের গন্ধ। একটু নড়েচড়ে সে আবার উঠে দাঁড়ায়। গাছের গুঁড়ির মধ্যে দেখা যাচ্ছে লাল ইটের একটা বাড়ি, আর তার ঠিক চোখের সামনেই বাড়িতে ঢোকার প্রবেশদ্বার।

মেয়েটি দ্রুত ঢোকে, ঊর্ধ্বশ্বাসে। ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। শোবার ঘরের সামনে এসে মেয়েটি এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায়, নিজেকে সামলায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলছে, বুক ধুকপুক করছে।

দরজাটা বন্ধ। দরজায় সাবধানে হাত রাখে সে, ঠেলা দেয়। দেখতে পায়, খাটের চারটি ছতরি আর তাতে একটা সিল্কের পর্দা (মশারি) দেওয়া। মাঝখানে বড় একটা বিছানা, তার ওপরে বসে তার স্বামী, ঠিক যেন বিয়ের পাত্র। তাঁর ডান দিকে একটি মেয়ে, বাঁদিকে আরেকটি। দুজনেরই পরনে স্বচ্ছ পোশাক যার ভেতর থেকে প্রকাশ পাচ্ছে তাদের শুভ্র মধুর ত্বক। তাদের চোখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, হিরের চোখের মত।

মেয়েটির স্বামীর মুখ এদিকে ফেরানো ছিল না, তাই তাকে সে দেখতে পেল না। মেয়েটির হাত এখনও দরজায় ধরা। পেছন ফিরে দরজা টেনে বন্ধ করে দিল মেয়েটি। পৃথিবীতে ফিরে আসা সেই মেয়ে, নিজেকেই শোনায়, কালো মেয়ের জন্য স্বর্গে কোনও ঠাঁই নেই।



***************************

লেখক পরিচিতিঃ

মিশরের এক ছোট গ্রামে নাওয়াল এল সা’দয়ি’র জন্ম। পেশায় ডাক্তার। আরব মহিলাদের ওপর যৌন এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নকে তাঁর লেখা বইতে অনাবৃত করে দেওয়ার জন্য ১৯৭০-এর দশকে উনি একজন জনপ্রিয় লেখিকা হয়ে ওঠেন। তিনি বহু উপন্যাস এবং ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর লেখা চোদ্দটি বই ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তাঁরই স্বামী এবং লেখক শরীফ হেতাতা। নাগীব মাহফুজ়ের পরেই তিনিই বিশ্বের জনপ্রিয়তম আরব লেখক। ১৯৮১ সালে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার এল সাদাত তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৯০-এর দশকে যখন মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দেয়, তিনি মিশর ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। অনেক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়েই তিন অধ্যাপনা করেছেন। তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব,কারণ আরব দুনিয়ায় তাঁকে এক রকম নজরে দেখে, আর পাশ্চাত্য দুনিয়া দেখে অন্য নজরে।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ