কাল রাতে পুরাতন বাড়িতে আমার সঙ্গে ব্যাপারটি ঘটে গেল। ঐযে ঐ রাত। ওটাকে তো আমি হলফ করে গত রাতই বলতে বলব। সাবেকি এবং সমসাময়িক- এই দুই চেহারার কোনটাই ধরে রাখতে না পারলেও বাড়িটির একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি তো এখন একটি প্রাচীন স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। অবস্থানগত কারণেই এটি জানান দিচ্ছে, কায়রো শহরের জন্মের সময়ই এর জন্ম হয়েছে। জন্মসূত্রে পাওয়ার কারণে এই বাড়িতেই আমরা বেড়ে উঠেছি। বংশপরম্পরায় আসতে আসতে এক পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে আর বনিবনা না হওয়ায় এই পাথরের দেয়ালে রূদ্ধ সরু গলির নাগপাশ ছিঁড়ে দূরে একটি নতুন, চকচকে পরিবেশে চলে যাবার ইচ্ছে আমাদের পেয়ে বসলো।
চপলা শরতের সিগ্ধ আবহাওয়ায় বাড়ির বৈঠকখানায় একটি ভাঙ্গাচোড়া সোফায় বসে আছি। সোফাগুলো বাদ দিতে হবে বলে ঠিক করেছি। দারুচিনি মেশানো চায়ে চুমুক দিচ্ছি, আর সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা কলসটা দেখছি। এটি ছোট্ট। পিতলের তৈরি। এর মধ্যে জাভার আগরবাতি জ্বলছে। ধীরে ধীরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোয়া উঠছে। বাতি জ্বলছে। নিভৃতে। বলা নেই কওয়া নেই, এই নীরবতা আমার অনুভূতিগুলোকে অসার করে দিচ্ছে। এক ধরনের রহস্যময় অস্বস্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নিজেকে শক্ত করে নিই। কিন্তু আমার পুরো জীবন কুণ্ডলী পাকিয়ে একটি বলের আকৃতি ধারণ করে আমারই চোখের সামনে দিয়ে মহাজাগতিক গতিতে ছুটে চলল। দ্রুতই অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর অজানা-অচেনা এক অতল সত্তার গভীরে তলিয়ে গেল।
নিজে নিজেই বলে উঠলাম, আমি তো এ রকম ধোকার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। আগামীকালের বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারটি অবশ্য বলে-কয়ে ঠিক করা হয়নি। তবুও এটি আমাকে বারবার আমার অগ্যস্ত যাত্রার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। উটচারক শেষবারের মতো উটকে ঘরে ফিরিয়ে আনার সময় যেমন উচ্চস্বরে গান গায়, এটি ঠিক তেমন ব্যাপার। বাড়ি ছাড়ার বেদনা ভুলে থাকার জন্য আমি প্রশস্ত রাস্তায় বেড়ে ওঠা ঘন লজ্জাবতী গাছের ছায়ায় ঘেরা নতুন বাড়ির কথা ভাবতে লাগলাম। এতে ভেতরে ভেতরে পুলক বোধ করলাম। দারুচিনির চা আমার শরীরের ভেতরে থিতু হতে না হতেই বাস্তবতা ছেড়ে অন্য আর এক সত্তায় প্রবেশ করলাম। তখনই আমার গহীন ভেতর থেকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের আহ্বান শুনলাম। এটি আমাকে দ্বার খুলে, পর্দা সরিয়ে একটি সুনম্য ও মার্জনার আবহকে আলিঙ্গন করতে আহ্বান জানায়। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার সব উদ্বিগ্নতা এবং ভাবনা-চিন্তা উবে যায়। মনটা মুগ্ধতা ও পরম আনন্দে নাচতে থাকে। উচ্ছাসে উদ্বেলিত হয়ে পড়ি।
আমার ভেতরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তারপর এটি একজন মানুষের অবয়ব ধারণ করল। সে এসে আমাকে এক গ্লাস মদিরা পরিবেশন করলো। নরম করে বলল, “এই অতিলৌকিক উপঢৌকন গ্রহণ কর।” কিছু একটা ঘটবে বলে আমি আশঙ্কা করেছিলাম। ঘটলোও তাই। আমার ড্রইং রুমটি বিরাট একটি আঙ্গিনায় পরিণত হলো। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। অবশেষে এটি সাদা, মোটা দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো। এই আঙ্গিনার কোথাও চক্রাকারে আবার কোথাও বাঁকা চাঁদের মতো স্থানে স্থানে ঘাস ছড়িয়ে আছে। মাঝখানে একটি কুয়া। কাছেই একটি উঁচু পামগাছ। আমি টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে গেলাম। এ এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি। মনে হলো, যে দৃশ্য তখন আমি দেখেছি, তা আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু আরেক ধরনের অনুভূতি আমাকে বলল, আমি যা দেখছি তার মধ্যে আমাকে বিস্মিত করার মতো কিছু নেই। একই সঙ্গে দু’ধরনের দৃশ্যই দেখছি। এবার জোরে মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিলাম। কল্পনা ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসতে চাইলাম। ভাবলাম, মনটা এলোমেলো হয়ে গেল কিনা। কোন লাভ হলো না। বরং দৃশ্যটা আরো পরিষ্কার হয়ে আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরল। কুয়া আর পামগাছের মাঝখানের স্থানে একজন লোককে দেখলাম। এই লোকটি কালো জুব্বা আর সবুজ পাগড়ি পরা। সে আর কেউ নয়; সে তো আমি নিজেই। তার মুখে লম্বা দাড়ি। কিন্তু মুখটা তো আমারই। আরেকবার মাথাটা নড়ালাম। লাভ হলো না। দৃশ্যটা বরং আগের চাইতে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠলো। চারপাশের তামাটে আলো ঘোষণা করছিল, সূর্যটা অস্তাচলে যাচ্ছে। কুয়া আর পামগাছের মাঝখানের দণ্ডায়মান লোকটি মধ্যবয়সী। পোশাক-আশাকে ঠিক আমার মতো দেখতে। দেখলাম, সে আমার হাতে একটি বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল,“আজকাল কোন রকমের নিরাপত্তা নেই। মাটি খুঁড়ে এটি লুকিয়ে রাখ।”
“লুকিয়ে ফেলার আগে একটু খুলে দেখলে ভালো হয় না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না, না” সে দৃঢ়ভাবে বলল। “তা করলে তুমি এক বছর যেতে না যেতেই তাড়াহুড়ো করে নিজের ধ্বংস নিজেই টেনে আনবে।” “তাহলে আমাকে কি এক বছর অপেক্ষা করতে হবে?”
“কমপক্ষে তাই। এরপর পরবর্তী নির্দেশনা অনুসরণ করবে।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলো, “দিনগুলো সত্যিই অনিশ্চিত,” সাবধান করে দিয়ে বলল। “ তোমার বাড়ি তল্লাশি করা হবে। কাজেই, গভীরভাবে মাটি খুঁড়ে এটি লুকিয়ে রাখ।” ওদের দু’জন পামগাছের কাছে গর্ত খুঁড়তে রওনা দিলো। গর্ত খুঁড়ে বাক্সটি এর মধ্যে রেখে মাটিচাপা দিলো। তারপর সতর্কতার সঙ্গে মাটি সমান করে দিলো। এবার মধ্যবয়সী লোকটি বলল, “আমি তোমাকে খোদার হাওলায় রেখে যাচ্ছি। সাবধান, খারাপ সময় আসছে।”
“না, না” সে দৃঢ়ভাবে বলল। “তা করলে তুমি এক বছর যেতে না যেতেই তাড়াহুড়ো করে নিজের ধ্বংস নিজেই টেনে আনবে।” “তাহলে আমাকে কি এক বছর অপেক্ষা করতে হবে?”
“কমপক্ষে তাই। এরপর পরবর্তী নির্দেশনা অনুসরণ করবে।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করলো, “দিনগুলো সত্যিই অনিশ্চিত,” সাবধান করে দিয়ে বলল। “ তোমার বাড়ি তল্লাশি করা হবে। কাজেই, গভীরভাবে মাটি খুঁড়ে এটি লুকিয়ে রাখ।” ওদের দু’জন পামগাছের কাছে গর্ত খুঁড়তে রওনা দিলো। গর্ত খুঁড়ে বাক্সটি এর মধ্যে রেখে মাটিচাপা দিলো। তারপর সতর্কতার সঙ্গে মাটি সমান করে দিলো। এবার মধ্যবয়সী লোকটি বলল, “আমি তোমাকে খোদার হাওলায় রেখে যাচ্ছি। সাবধান, খারাপ সময় আসছে।”
এরপর এই দিবাস্বপ্ন এমনভাবে মিলিয়ে গেল যেন এতক্ষণ কিছুই ঘটেনি। পুরাতন বাড়ির ড্রইং রুম আবার ফিরে এলো। তখনও আগরবাতির কিছু অংশ বাকি রয়ে গেছে। শীঘ্রই সম্মোহন কাটিয়ে উঠে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। যদিও এরপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত এক ধরনের উত্তেজনায় বুদ হয়ে রইলাম। এটি কি শুধুই কল্পনা? ব্যাখ্যা করলে হয়ত বিষয়টি তাই দাঁড়াবে। কিন্তু যে দৃশ্য এতটা স্পষ্ট তাকে আমি কল্পনা বিবেচনা করি কীভাবে? যে দৃশ্য এমন সত্যের নির্যাসে আমাকে সিক্ত করে দেয়, তাকে আমি কল্পনাপ্রসূত বলি কীভাবে? আমার অতীত-বাস্তবতার মতো বর্তমান-বাস্তবতাও অকাট্য সত্য। আমি নিজেকে অথবা আমার একজন পূর্বপুরুষকে দেখেছি। এটি একটি যুগের অংশবিশেষ যা আমি অতিবাহিত করে এসেছি। নিজের মন ও অনুভূতিকে সন্দেহ না করলে আমার পক্ষে এটি অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই আমি জানি না, ব্যাপারটি কীভাবে ঘটলো। তবে বিষয়টি যে ঘটেছে, তা তো সত্যি। একটি প্রশ্ন আমাকে বেশ পীড়া দিতে থাকলো: কেন এটি ঘটলো? কেন এটি গতরাতে আমার পুরাতন বাড়িতেই ঘটলো? হঠাৎই অনুভব করলাম, আমার কিছু একটা করা দরকার। এর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই।
ওটা কি তাহলে সেই অন্য আরেকজন যে এক বছর পরে বাক্সটি বের করে নির্দেশ মতো কাজ করেছিল? সে কি তার ধৈর্যের শেষ কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল? তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল? সেই অনিশ্চয়তায় ভরা দিনগুলোতে তার পরিকল্পনাগুলো কি তারই বিরুদ্ধে গিয়েছিল? জানার আকাঙ্ক্ষা কতই না অপ্রতিরোধ্য! এক অদ্ভূত ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো। ঐ অন্য জনকে যখন বাক্সটি নিতে বাধা দেওয়া হয় তখন অতীত আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকদিন পর যখন বিষয়টি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে তখন আমাকে মাটি খুঁড়ে এটিকে উদ্ধার করতে বলা হলে অতীত আমার সামনে পথ আগলে দাঁড়ায়। এটি আমাকে পুরাতন বাড়ি ছেড়ে যেতে প্ররোচিত করে। তবে সে-সময় এখনও আসেনি। যদিও পুরো বিষয়টি স্বপ্নের চাদরে আচ্ছাদিত এবং পুরোপুরিভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে দেখতে অদ্ভুত মনে হয়, তবুও এটি একটি সর্বগ্রাসী শক্তি দিয়ে আমাকে কাবু করে ফেলে। আকাঙ্ক্ষায় গা ভাসানোর আনন্দ আর বেদনার দোলাচলে আমার হৃদয় নাচতে থাকে।
সে-রাতে আমি এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারলাম না। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো, সেখানে আমার মন ঘুরে বেড়ালো। যেন মাতাল হয়ে আমি সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেছি। এখন আর এই বাড়ি ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না। অতীতের মাটি খুঁড়ে কালের গর্ভ থেকে অনেক দিন ধরে লুক্কায়িত শব্দটি খুঁজে বের করার বাসনায় আমি বিভোর হয়ে রইলাম। এরপর কী করব, তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। যে দৃশ্যপট চলে গেছে তার সঙ্গে আসন্ন দৃশ্যের তুলনা করলাম। মনে হলো- যেখান থেকে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার সিঁড়ি উঠে গেছে পাম গাছটা ঠিক সেখানেই। এখান থেকে সামান্য সরে খোঁড়াখুঁড়ি অবশ্যই শুরু করতে হবে। ড্রয়িং রুমের ঠিক জানালা সংলগ্ন জায়গা।
সম্মতি দেওয়ার পরেও আমি যে আবার বাড়ি না বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা আমার ভাই-বোনকে জানানোর ব্যাপারে সমস্যায় পড়ে গেলাম। আমরা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার ভাই আমার চাইতে এক বছর পেছনে প্রকৌশল শাস্ত্রের ছাত্র। আর আমার ছোট বোন আমার থেকে দুই বছর পেছনে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ছে।
আমার কোন যুক্তিই ওদের কাছে গ্রাহ্য হলো না। ওরা প্রতিবাদ করল। ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অনড়। নতুন বাড়িতে উঠবে। ওদের আশা, এখন না উঠলেও পরে আমি ওদের সঙ্গে যোগ দেব। যাওয়ার সময় ওরা আমাকে মনে করিয়ে দিলো, পুরাতন বাড়িটি কিন্তু বিক্রি করে দেওয়ার কথা হচ্ছে আর অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করলে ওদের লাভ হবে। আমি অবশ্য কোন প্রতিবাদ করলাম না। এভাবে আমরা জীবনে প্রথমবার আলাদা হলাম। আমি তো ভেবেছিলাম, কেবল বিয়ে আর মৃত্যু মানুষকে আলাদা করে দেয়।
সে-রাতে আমি এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারলাম না। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে যে বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো, সেখানে আমার মন ঘুরে বেড়ালো। যেন মাতাল হয়ে আমি সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে গেছি। এখন আর এই বাড়ি ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না। অতীতের মাটি খুঁড়ে কালের গর্ভ থেকে অনেক দিন ধরে লুক্কায়িত শব্দটি খুঁজে বের করার বাসনায় আমি বিভোর হয়ে রইলাম। এরপর কী করব, তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। যে দৃশ্যপট চলে গেছে তার সঙ্গে আসন্ন দৃশ্যের তুলনা করলাম। মনে হলো- যেখান থেকে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার সিঁড়ি উঠে গেছে পাম গাছটা ঠিক সেখানেই। এখান থেকে সামান্য সরে খোঁড়াখুঁড়ি অবশ্যই শুরু করতে হবে। ড্রয়িং রুমের ঠিক জানালা সংলগ্ন জায়গা।
সম্মতি দেওয়ার পরেও আমি যে আবার বাড়ি না বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা আমার ভাই-বোনকে জানানোর ব্যাপারে সমস্যায় পড়ে গেলাম। আমরা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার ভাই আমার চাইতে এক বছর পেছনে প্রকৌশল শাস্ত্রের ছাত্র। আর আমার ছোট বোন আমার থেকে দুই বছর পেছনে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ছে।
আমার কোন যুক্তিই ওদের কাছে গ্রাহ্য হলো না। ওরা প্রতিবাদ করল। ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অনড়। নতুন বাড়িতে উঠবে। ওদের আশা, এখন না উঠলেও পরে আমি ওদের সঙ্গে যোগ দেব। যাওয়ার সময় ওরা আমাকে মনে করিয়ে দিলো, পুরাতন বাড়িটি কিন্তু বিক্রি করে দেওয়ার কথা হচ্ছে আর অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করলে ওদের লাভ হবে। আমি অবশ্য কোন প্রতিবাদ করলাম না। এভাবে আমরা জীবনে প্রথমবার আলাদা হলাম। আমি তো ভেবেছিলাম, কেবল বিয়ে আর মৃত্যু মানুষকে আলাদা করে দেয়।
কাজ শুরু করা ছাড়া আর কিছুই বাকি রইলো না। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই আবিষ্কৃত হবে না। কিন্তু কী যেন একটা শক্তি আমাকে ফিরে যেতে বাধা দিল। গোপনে রাতে মাটি খুঁড়তে মনস্থির করলাম। একটা কুড়াল, একটা শাবল, একটা ঝুড়ি আর বুকে অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম। সারা শরীর শীঘ্রই ধুলিধুসরিত হয়ে গেল। ফুসফুসটা ধুলোয় পূর্ণ হয়ে গেল। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি আমার নাসারন্ধ্রে এসে জমাট বাঁধলো। একেবারে আমার উচ্চতার সমান গভীর করে গর্ত শুধু খুঁড়েই চললাম আর খুঁড়েই চললাম। শুধু একটিমাত্র ভাবনাই আমাকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছিল। তা হলো- আমি সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছি। এরপর কুড়ালের কোপ বসালে একটি অদ্ভুত শব্দ আমার কানে ভেসে এলো। আমার হৃৎপিণ্ড এতই জোরে জোরে পাঁজরে আঘাত করছিল যে, আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। মোমবাতির আলোয় দেখলাম , ধূলিমাখা বাক্সটি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যেন দীর্ঘদিন দেরি করার কারণে এটি আমাকে তিরস্কার করছে। এত বছর যাবৎ একটি শব্দকে আটকে রাখার জন্য এটি যেন আমাকে ভর্ৎসনা করছে। একই সঙ্গে আমি একটি সত্যের সন্ধান পেয়ে গেলাম। একেবারে অকাট্যভাবে। এটি অনস্বীকার্য, অলৌকিক ব্যাপার। সময়কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এটি বুক চেতিয়ে আছে।
বাক্সটি উপরে তুলে আনলাম। এরপর এটি নিয়ে দ্রুত দৌড়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম সাক্ষ্য-প্রমাণ, যা আমাকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবতায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এটি গ্রাহ্য সকল ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায়। ধুলো ঝাড়লাম। বাক্সটি খুললাম। ভেতরে লিনেন কাপড়ে মোড়ানো একটি চিঠি দেখলাম। সন্তর্পনে ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলাম।
হে বৎস, ঈশ্বর তোমায় রক্ষা করুন।
পুরাতন বছর চলে গেছে, নতুনের আগমন ঘটেছে পুরাতনের পথ ধরে। এই বাড়ি ছেড়ে যেও না, কারণ এটি কায়রোর সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। বিশ্বাসীরা এই বাড়ি ছাড়া আর কোন নিরাপদ স্থান খুঁজে পাবে না। পুণ্যভূমির মালিকের সঙ্গে তোমার সাক্ষাতের সময় এসে গেছে। আমাদের মুনিব আরিফ আল বাকাল্লানি। যাও তোমার বাড়িতে। আরাম গৌর এর গলিতে প্রবেশ করলে হাতের ডানের তৃতীয় বাড়িটিই এটি। ওকে পাসওয়ার্ডটা বলে দাও: আমি না থাকলে সে আসে আর সে এলে আমি থাকি না। এভাবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করলে নিয়তি তোমার সহায় হবে। তুমি অন্য সব বিশ্বাসীর মতই তোমার মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে।
হে বৎস, ঈশ্বর তোমায় রক্ষা করুন।
পুরাতন বছর চলে গেছে, নতুনের আগমন ঘটেছে পুরাতনের পথ ধরে। এই বাড়ি ছেড়ে যেও না, কারণ এটি কায়রোর সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। বিশ্বাসীরা এই বাড়ি ছাড়া আর কোন নিরাপদ স্থান খুঁজে পাবে না। পুণ্যভূমির মালিকের সঙ্গে তোমার সাক্ষাতের সময় এসে গেছে। আমাদের মুনিব আরিফ আল বাকাল্লানি। যাও তোমার বাড়িতে। আরাম গৌর এর গলিতে প্রবেশ করলে হাতের ডানের তৃতীয় বাড়িটিই এটি। ওকে পাসওয়ার্ডটা বলে দাও: আমি না থাকলে সে আসে আর সে এলে আমি থাকি না। এভাবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করলে নিয়তি তোমার সহায় হবে। তুমি অন্য সব বিশ্বাসীর মতই তোমার মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে।
চিঠিটা আমি এতবার পড়লাম যে, একসময় মনে হলো- আমি যন্ত্রের মতো কোন অর্থ না বুঝেই শুধু পড়ে যাচ্ছি। আমার পুরাতন সহযোগীর ভাগ্যে কী ঘটলো সে-ব্যাপারে আমার আর কোন ধারণাই নেই। তারপরও আমি নিশ্চিত যে, এই বাড়িটি এখন আর কায়রোর সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি নয় এবং বিশ্বাসীদের জন্যও এটি আর নিরাপদ আশ্রয় নয়। মোদ্দা কথা হলো, এই বাড়ির মালিক বাকাল্লানির তো আর কোন অস্তিত্বই নেই। তাহলে এই কল্পনা কেন? খাটাখাটিই বা কীসের জন্য? কোন কারণ ছাড়াই কি এমন অলৌকিক ব্যাপার ঘটতে পারে? এটা কি তাহলে ধারণা প্রসূত নয় যে, আরাম গৌর গলির তৃতীয় বাড়িটিতে আমার যাওয়া উচিত কোন এক অদৃশ্য কারণে? আমার এই অতুলনীয় অলৌকিক ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেওয়ার প্রণোদনা কি আমার ভেতরেই আমি বোধ করেছি? রাতের কালো পর্দা ভেদ করে পথ চলেছি। যখন যাওয়ার কথা ছিল তারও কয়েক শ’ বছর পরে। দেখলাম, গলিটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ঝাপসা আলো এর অন্ধকার গহ্বরে ঠিকরে পড়ছে। কয়েকজনকে রাস্তা পার হতে দেখলাম। এছাড়া আর কোন জনমানব নেই। প্রথম বাড়ি অতিক্রম করে গেলাম দ্বিতীয় বাড়ির কাছে। তৃতীয় বাড়ির সামনে এসে থামলাম। যেন স্বপ্নের মধ্যে আছি। সে ভাবেই বাড়িটির দিকে ঘুরলাম। মনে হলো এতে একটি ছোট উঠান আছে। চারপাশে নীচু দেয়াল। ঝাপসা কিছু মানুষের অবয়ব। পেছনে ফেরার চেষ্টা করে সফল হওয়ার আগেই দরজাটা খুলে গেল। ইউরোপীয় পোশাক পড়া লম্বা দু’জন লোক বেরিয়ে এলো। চোখের পলকে ক্ষীপ্রগতিতে ওরা আমার পথ আগলে দাঁড়ালো। একজন বলল, “ভেতরে যাও। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ, যাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর।”
বিস্মিত হয়ে বললাম, “আমি কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসিনি। তবে এই বাড়িতে যিনি থাকেন তাঁর নাম জানতে পারলেই আমি খুশি হব।”
“তাই? কেন?”
ভয়-ডর ঠেলে ফেলে দিয়ে বললাম, “এই বাড়িতে যিনি এখন বাস করছেন তিনি আল বাকাল্লানি বংশের লোক কিনা, তা জানতে চাই।”
“আল বাকাল্লানির ব্যাপারে যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছিলে সেখানে যাও।”
আমার কাছে মনে হলো ওদের দু’জন নিরাপত্তা কর্মী। দ্বিধা আর ভয় পেয়ে বসলো। “কোথাও যাওয়ার কথাও নেই, সাক্ষাৎও নেই,” আমি বললাম।
“তোমার সিদ্ধান্ত তাহলে পাল্টাবে না।”
ওরা আমার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে জোর করে ভেতরে নিয়ে গেল। স্বপ্ন দেখতে দেখতে এবার দুঃস্বপ্নের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। আমাকে একটি আলো ঝলমলে অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একজন লোক সাদা জোব্বা পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে হাতকড়া পড়ানো। চারপাশে তাকিয়ে আমাকে যে দু’জন ধরে নিয়ে গেছে তাদের মতো আরো কয়েকজনকে দেখলাম। দু’জনের একজন বলল, “সে তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।”
একজনকে এই দলের নেতা বলে মনে হলো। তিনি গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দিকে ঘুরলো, “আপনার অন্যতম সঙ্গী?” তাঁকে জিজ্ঞেস করলো।
“আমি ওকে আগে দেখিনি, “তরুণ লোকটি বিষণ্ন মুখে উত্তর দিলেন।
আমার দিকে তাকিয়ে নেতা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি একই গল্প আবার বলবে, না-কি ঝামেলা থেকে নিজেও বাঁচবে আর আমাদেরকেউ বাঁচাবে?”
“আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, “আমি খুব জোর দিয়ে বললাম, “আপনারা যা সন্দেহ করছেন তার কোন কিছুর সঙ্গে আমার কোন রকম সম্পর্ক নেই।”
সে হাত বাড়িয়ে দিলো, “তোমার পরিচয়পত্র দাও।” পরিচয়পত্র দিলাম। পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কেন এসেছ?”
দু’জনের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “ওরা আমাকে এখানে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।”
“ওরা তোমাকে রাস্তার ওপার থেকে ধরে নিয়ে এসেছে?”
“আমি আল বাকাল্লানি বংশ সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে এই গলিতে এসেছিলাম।”
“কী কারণে তাঁদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করছ?”
একেবারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। জেরার মুখে পড়ে যে কেউ যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে আমি ঠিক সেভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। “ওঁদের ব্যাপারে আমি ইতিহাসে পড়েছি। পড়ে জেনেছি যে, ওঁরা এই গলিতে ডানদিকের তৃতীয় বাড়িটাতে থাকতেন।”
“যে বইয়ে পড়েছ সেই বইয়ের নাম বল।”
আমি আরও বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কোন উত্তর দিতে পারলাম না।
“মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ হবে না। এতে বরং তোমার ক্ষতি হবে।”
“আমার কাছে কী চান,” আমি নিরাশ হয়ে জানতে চাইলাম।
“জেরা করার জন্যই আমরা তোমাকে ভেতরে ধরে নিয়ে এসেছি,” তিনি আস্তে আস্তে বললেন।
“সত্য কথা বললে তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না,” আমি চিৎকার করে বললাম।
“কী সেই সত্য কথা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মুখের ভেতরে ধুলো জমে গেছে। এবার বলতে শুরু করলাম। “আমি আমার বাড়ির বৈঠকখানায় বসেছিলাম ...।”
এবার ওদের পিড়াপিড়িতে আমি গোপন কথা সবিস্তারে ফাঁস করে দিলাম।
আমার কথা শেষ হলে লোকটি নিস্পৃহভাবে বললেন, “পাগলের ভান করেও কোন ফায়দা হবে না।”
পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে বললাম, “এই যে এবার প্রমাণ নিন।”
তিনি এটি তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “অদ্ভূত কাগজ তো। এর রহস্য শীঘ্রই উদঘাটন করা হবে।” সতর্কতার সঙ্গে চিঠির লাইনগুলো পড়তে শুরু করলেন। তাঁর ঠোটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলে থাকলো। “স্পষ্ট কোড”, বিড়বিড় করে বললেন। এবার তিনি বাড়ির মালিকের দিকে তাকালেন যাকে হাতকড়া পড়ানো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আরিফ আল বাকাল্লানি? এটি কি আপনার সাংকেতিক নাম?”
“আমার কোন সাংকেতিক নাম নেই,” তরুণ লোকটি ঘৃণাভরে উত্তর দিলেন। “আর এই লোক আপনার ভাড়া করা জোকার, আর একে ধরে নিয়ে এসেছেন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য। কিন্তু আমি আপনার ফন্দি খুব ভালো করেই বুঝি।”
নেতার একজন সহকারী বলল, “ অন্য কেউ যেন এই ফাঁদে না পড়ে তার জন্য কি আমাদের থামা উচিত নয়?”
“আমরা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করব।” নেতা বললেন। আমাকে যে দু’জন ধরে দাঁড়িয়েছিল তাদের দিকে ঈশারা করলেন। পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও ওরা আমাকে হাতকড়া পরাতে শুরু করলো। বিশ্বাস হলো না, কীভাবে সবকিছু পাল্টে গেল। কীভাবে ওরা এমন বিস্ময়কর অলৌকিক ব্যাপার দিয়ে শুরু করলো এবং কীভাবে নিয়তি পুরোই ঘুরে গেল? এটা যে ঘটতে পারে তা আমার বিশ্বাসও হলো না আবার আমি হালও ছাড়লাম না। তখন আমি আকণ্ঠ ঝামেলায় নিমজ্জিত। কিন্তু তবুও এই স্বপ্নবিভার আমাকে আনন্দ দেয়নি। আমি আমার অর্বাচীনতাপ্রসূত দোষের কথা স্বীকার করি। সবকিছুকে পুনর্বিবেচনা করতেও আমি রাজি আছি। আর সময়কে তো বিশ্বাস করিই।
বিস্মিত হয়ে বললাম, “আমি কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসিনি। তবে এই বাড়িতে যিনি থাকেন তাঁর নাম জানতে পারলেই আমি খুশি হব।”
“তাই? কেন?”
ভয়-ডর ঠেলে ফেলে দিয়ে বললাম, “এই বাড়িতে যিনি এখন বাস করছেন তিনি আল বাকাল্লানি বংশের লোক কিনা, তা জানতে চাই।”
“আল বাকাল্লানির ব্যাপারে যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছিলে সেখানে যাও।”
আমার কাছে মনে হলো ওদের দু’জন নিরাপত্তা কর্মী। দ্বিধা আর ভয় পেয়ে বসলো। “কোথাও যাওয়ার কথাও নেই, সাক্ষাৎও নেই,” আমি বললাম।
“তোমার সিদ্ধান্ত তাহলে পাল্টাবে না।”
ওরা আমার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে জোর করে ভেতরে নিয়ে গেল। স্বপ্ন দেখতে দেখতে এবার দুঃস্বপ্নের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। আমাকে একটি আলো ঝলমলে অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একজন লোক সাদা জোব্বা পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে হাতকড়া পড়ানো। চারপাশে তাকিয়ে আমাকে যে দু’জন ধরে নিয়ে গেছে তাদের মতো আরো কয়েকজনকে দেখলাম। দু’জনের একজন বলল, “সে তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।”
একজনকে এই দলের নেতা বলে মনে হলো। তিনি গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দিকে ঘুরলো, “আপনার অন্যতম সঙ্গী?” তাঁকে জিজ্ঞেস করলো।
“আমি ওকে আগে দেখিনি, “তরুণ লোকটি বিষণ্ন মুখে উত্তর দিলেন।
আমার দিকে তাকিয়ে নেতা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি একই গল্প আবার বলবে, না-কি ঝামেলা থেকে নিজেও বাঁচবে আর আমাদেরকেউ বাঁচাবে?”
“আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, “আমি খুব জোর দিয়ে বললাম, “আপনারা যা সন্দেহ করছেন তার কোন কিছুর সঙ্গে আমার কোন রকম সম্পর্ক নেই।”
সে হাত বাড়িয়ে দিলো, “তোমার পরিচয়পত্র দাও।” পরিচয়পত্র দিলাম। পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কেন এসেছ?”
দু’জনের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “ওরা আমাকে এখানে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।”
“ওরা তোমাকে রাস্তার ওপার থেকে ধরে নিয়ে এসেছে?”
“আমি আল বাকাল্লানি বংশ সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে এই গলিতে এসেছিলাম।”
“কী কারণে তাঁদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করছ?”
একেবারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। জেরার মুখে পড়ে যে কেউ যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে আমি ঠিক সেভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। “ওঁদের ব্যাপারে আমি ইতিহাসে পড়েছি। পড়ে জেনেছি যে, ওঁরা এই গলিতে ডানদিকের তৃতীয় বাড়িটাতে থাকতেন।”
“যে বইয়ে পড়েছ সেই বইয়ের নাম বল।”
আমি আরও বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। কোন উত্তর দিতে পারলাম না।
“মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ হবে না। এতে বরং তোমার ক্ষতি হবে।”
“আমার কাছে কী চান,” আমি নিরাশ হয়ে জানতে চাইলাম।
“জেরা করার জন্যই আমরা তোমাকে ভেতরে ধরে নিয়ে এসেছি,” তিনি আস্তে আস্তে বললেন।
“সত্য কথা বললে তো আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না,” আমি চিৎকার করে বললাম।
“কী সেই সত্য কথা?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মুখের ভেতরে ধুলো জমে গেছে। এবার বলতে শুরু করলাম। “আমি আমার বাড়ির বৈঠকখানায় বসেছিলাম ...।”
এবার ওদের পিড়াপিড়িতে আমি গোপন কথা সবিস্তারে ফাঁস করে দিলাম।
আমার কথা শেষ হলে লোকটি নিস্পৃহভাবে বললেন, “পাগলের ভান করেও কোন ফায়দা হবে না।”
পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে বললাম, “এই যে এবার প্রমাণ নিন।”
তিনি এটি তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “অদ্ভূত কাগজ তো। এর রহস্য শীঘ্রই উদঘাটন করা হবে।” সতর্কতার সঙ্গে চিঠির লাইনগুলো পড়তে শুরু করলেন। তাঁর ঠোটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলে থাকলো। “স্পষ্ট কোড”, বিড়বিড় করে বললেন। এবার তিনি বাড়ির মালিকের দিকে তাকালেন যাকে হাতকড়া পড়ানো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আরিফ আল বাকাল্লানি? এটি কি আপনার সাংকেতিক নাম?”
“আমার কোন সাংকেতিক নাম নেই,” তরুণ লোকটি ঘৃণাভরে উত্তর দিলেন। “আর এই লোক আপনার ভাড়া করা জোকার, আর একে ধরে নিয়ে এসেছেন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য। কিন্তু আমি আপনার ফন্দি খুব ভালো করেই বুঝি।”
নেতার একজন সহকারী বলল, “ অন্য কেউ যেন এই ফাঁদে না পড়ে তার জন্য কি আমাদের থামা উচিত নয়?”
“আমরা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করব।” নেতা বললেন। আমাকে যে দু’জন ধরে দাঁড়িয়েছিল তাদের দিকে ঈশারা করলেন। পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও ওরা আমাকে হাতকড়া পরাতে শুরু করলো। বিশ্বাস হলো না, কীভাবে সবকিছু পাল্টে গেল। কীভাবে ওরা এমন বিস্ময়কর অলৌকিক ব্যাপার দিয়ে শুরু করলো এবং কীভাবে নিয়তি পুরোই ঘুরে গেল? এটা যে ঘটতে পারে তা আমার বিশ্বাসও হলো না আবার আমি হালও ছাড়লাম না। তখন আমি আকণ্ঠ ঝামেলায় নিমজ্জিত। কিন্তু তবুও এই স্বপ্নবিভার আমাকে আনন্দ দেয়নি। আমি আমার অর্বাচীনতাপ্রসূত দোষের কথা স্বীকার করি। সবকিছুকে পুনর্বিবেচনা করতেও আমি রাজি আছি। আর সময়কে তো বিশ্বাস করিই।
এক গভীর নিস্তব্ধতা আমাদের গিলে ফেলল। নতুন বাড়ির কথা মনে পড়লো। ওখানে বসবাসরত আমার ভাই, বোন এবং পুরাতন বাড়িতে হা করে তাকিয়ে থাকা গর্তের কথা মনে পড়লো। বাইরের যে-কারো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যেমন মনে হয়, পরিস্থিতিটা আমার কাছে ঠিক সে রকমই মনে হলো। না হেসে পারলাম না। কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকালও না, নিস্তব্ধতাও ভাঙ্গলো না।
----------------
লেখক পরিচিতি: খ্যাতনামা মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের জন্ম কায়রোতে ১৯১১ সালে। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আরবি ভাষাভাষী লেখদের মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল জয়ী লেখক। নাগিব মাহফুজ শতাধিক ছোটোগল্প এবং ত্রিশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'কায়রো ট্রিলজি' প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। ২০০৬ সালে নাগিব মাহফুজ মৃত্যু বরণ করেন।
এলহাম হোসেন
ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি।
পেশা অধ্যাপনা।
অনুবাদক। প্রাবন্ধিক।
ঢাকায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ