নাইয়ার মাসুদের গল্প : বা’ইয়ের শবানুগমনকারীরা



মূল ভাষা হতে ইংরেজিতে অনুবাদঃ 
মুহাম্মদ উমর মেমন
ইংরেজি হতে বাংলায় রূপান্তরঃ 
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


খুব কম লোকই জানে, অথবা কেউই জানে না যে, শৈশবের একটা লম্বা সময় আমি বিয়ের কনেদেরকে ভীষণ ভয় পেতাম। এই ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের বংশের অনেক পুরুষ আগের এক বিয়ের কনেকে ঘিরে গল্প থেকে।

গল্পটি শোনার আগে আমিও বিয়ের কনেদের প্রতি একধরণের আকর্ষন বোধ করতাম। আমার অনেক সঙ্গীদের মতো। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে আমি চেষ্টা করতাম বিয়ের কনের খুব কাছের কোনো জায়গা খুঁজে পেতে। কনের হলুদে রাঙানো হাত, উজ্জ্বল লাল জামা ও অলঙ্কার বারবার ছুঁয়ে দেখতাম। তার শরীর থেকে ভেসে আসা ফুল, আতর ও অন্যান্য জিনিসের গন্ধও আমাকে তার দিকে টানত। এছাড়াও তার অলংকারের মৃদু ঝনঝনানির শব্দকে আমার কাছে মনে হতো মধুরতম সুরের অনুরণন। আমি খেয়াল করেছিলাম যে, প্রতিটা মেয়েই কনে হবার পর আরও কোমল ও সুন্দর হয়ে যেত। সুতরাং, আমি তাদের প্রেমে পড়ে যেতাম। যদিও খুবই সল্প সময়ের জন্যে। নির্দিষ্ট কোনো কনে নয়, প্রতিটা কনের ক্ষেত্রেই এটা ঘটত। এবং প্রতিবারেই বরের সাথে কনে চলে যাওয়ার পর নিজেকে বিধ্বস্ত বলে মনে হতো। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও। মনে হতো কেউ আমার ভালোবাসাকে নিষ্ঠুরভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।

উল্লেখ্য, একদিন মুষলধারে বৃষ্টির সময়ে আমি আমাদের পরিবারের সেই বিয়ের কনেটির গল্প শুনেছিলাম। বিয়ের পর প্রচলিত নিয়মেই তাকে বাপের বাড়ি হতে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্ত তার স্বামীর বাড়িতে যখন তাকে পালকী হতে নামানো হচ্ছিল, তখন তাকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল। সম্ভবত সে পথিমধ্যেই মরে গিয়েছিল এবং সে সম্ভবত তার নীচের ঠোঁটকে কামড়ে ধরেছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তা থেকে রক্ত ঝরে। তার শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছিল। একটা বয়ষ্ক শতপদী বিচ্ছু তার চামড়ার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে, বিচ্ছুর পাগুলো শরীরের চামড়ার ভেতরে ঢোকার পর, সেগুলো ধীরে ধীরে চামড়ার নীচের মাংশের ভেতরে ঢুকতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলো হাড়ে পৌঁছায়। ফলে শেষপর্যন্ত ভুক্তভোগী মারা যায়। আংশিকভাবে বিষ ছড়ানোর কারণে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসহনীয় ব্যাথার কারণে। আমাদের এই কনের ক্ষেত্রে সম্ভবত সে ব্যাথার কারণে মরে গিয়েছিল। তাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল, কেবলমাত্র যদি সে কাউকে বিষয়টা জানতে দিত। কিন্তু সেই সময়কালে এই বিষয়গুলো নিয়ে নববধূর কথা বলাকে অভদ্রতা বলে বিবেচনা করা হতো। সুতরাং কনে মুখ না খুলে ব্যাথা সহ্য করেছিল এবং নিশ্চুপভাবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল।

“আহা, মেয়েটা যদি একবার কাউকে বলত যে, তার চামড়ায় বিচ্ছু বসেছে,” মেয়েটির যে মহিলা আত্মীয় গল্পটি বর্ণনা করছিল, সে আরও বলেছিল,”তাহলে সেটিকে গরম চিমটি দিয়ে সরিয়ে নেওয়া যেত; অথবা এক মুঠ চিনি সেটির ওপরে ছিটিয়ে দিলেই, সাথে সাথে আলাদা হয়ে যেত।

চিনি দিয়ে চিকিৎসার ব্যাপারটি আমি নিজেও সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম। এরপর থেকে বাসার যেকোনো স্থানে বিচ্ছু দেখা গেলে সেটার ওপরে আমরা দ্রুত চিনি ছিটিয়ে দিতাম। সেটি একটু সময়ের জন্যে লাফালাফি করত। তারপর মুহুর্তের ভেতরেই পানি হয়ে যেত।

গল্পটি শোনার পর সেই নীরব কনেটির জন্যে আমার মন কেঁদে উঠেছিল। তার জন্যে একটু ভালোবাসাও আমি অনুভব করেছিলাম। এতগুলো পুরুষ পরেও। কিন্তু গল্পটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বর্ণনাকারীর মতে তার মৃত্যু আনন্দিত ঘরবাড়িতে শোকের মাতম তুলেছিল। উভয় পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাকে অলঙ্কার ও পরিহিত পরিচ্ছদসহ কবর দিতে। সেই মোতাবেক ‘কনেকে হলুদ-কমলা চামড়া ও চকচকে অলঙ্কার’সহ কবরে নামানো হয়েছিল।

তবে কবরে গিয়েও কনেটির শান্তি হয়নি। সেই রাতেই এক লোক গোপনে কবরস্থান এলাকায় গিয়ে তার নতুন খনন করা কবর খুলে তার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু একটু পর তার চিৎকারে চারপাশের লোকজন সেখানে ছুটে গিয়েছিল এবং দেখতে পেয়েছিল যে, কবরে অনুপ্রবেশকারী লোকটি কনের পাশে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। কবরের মধ্যেই। কনের অলঙ্কারের ছাপ লোকটির হাত ও মুখের ওপরে গেঁথেহিল। খবর শুনে শোকাহত দুই পরিবারের সদস্যরাও সেখানে ছুটে গিয়েছিল। তারা দেখতে পেয়েছিল যে, কনের পাশের মানুষটি স্বয়ং তার বর। তাকে যখন কবর থেকে তোলা হচ্ছিল, তখন দেখা গিয়েছিল যে, কনের শরীর তার বরের শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ফলে বরের শরীর কবরের বাইরে টেনে তোলার সময়ে মৃত কনেটির শরীরও তার শরীরের সাথে ওপরে উঠছিল। যদিও একটু পরে সেটি বরের শরীরকে ছেড়ে দিয়ে নীচে পড়ে গিয়েছিল।

কিছু সংখ্যক দাফনকাজ পুনরায় করে কবরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর সবাই মেয়েটির স্বামীর দিকে নজর দিয়েছিল। সে সারাক্ষণ প্রলাপ বকছিল। প্রথমে সে বলেছিল যে, কনের অলঙ্কারগুলো তাকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং সেগুলো তার শরীরের ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল। তারপর সে বলেছিল যে, কনে নিজেই তাকে জড়িয়ে ধরেছিল তার সারা শরীর দিয়ে। প্রথম কথা হলো কী কারণে সে কবরের ভেতরে নেমেছিল? প্রাথমিকভাবে সে এই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও পরে, তার সম্পূর্ণ বোধ ফিরে এলে বলেছিল যে, সে তার স্ত্রীর মুখ শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু এরপর আবার সে বলেছিল যে, তার স্ত্রীর শরীর থেকে অলঙ্কার সরিয়ে আনতে গিয়েছিল।

উল্লেখ্য, ঘটনার পরের কয়েকদিন বরকে বিভ্রান্তের মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গিয়েছিল পুনরায় স্ত্রীর কবরের ওপরে মৃত হিসেবে। এরপর থেকে কবরটিতে যথেষ্ট পরিমাণে অলঙ্কার আছে জেনেও কোনো ডাকাত সেদিকে তাকানোর সাহস করেনি। অতিক্রান্ত সময়ের সাথে এক সময়ে কবরের নিশানাও এক সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল।

গল্পটি শোনার পর প্রথমে কনেটিকেই আমার কাছে ভয়ের বলে মনে হয়েছিল। বৃষ্টির শব্দের মধ্যে আমি তার অলঙ্কারের নিঃশব্দ রুণুঝুণু শব্দ শুনতে পেতাম। এই সময়ে আমার এক বড় ভাই বলেছিলেন,”কনেটি আসলে মৃত ছিল না। লোকজন মৃত ভেবে জীবন্ত অবস্থাতেই তাকে কবর দিয়ে দিয়েছিল। এবং ভদ্রতার কারণে মেয়েটিও তাদেরকে বলতেও পারেনি যে, সে জীবিত ছিল।

কিছু মানুষেরা কথাটি শুনে হেসেছিল এবং বর্ণনাকারী মহিলা আমার ভাইকে বিষয়টি নিয়ে কোনো কৌতুক করতে মানা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কনেটিকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে, এই চিন্তাটি আমাকে আরও ভীত করে তুলেছিল। আমি যখনই ভাবতাম যে, মৃত হিসেবে জীবন্ত মেয়েটি কবরে শুয়ে আছে, তখন তাকে আমার কাছে আরো ভীতিকর বলে মনে হতো।

পরের কয়েকদিন তার চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। কখনো তাকে আমি জীবিত বলে কল্পনা করতাম। কখনো ভাবলাম যে সে মৃত। উভয় ক্ষেত্রেই তাকে আমার আরও ভীতিকর বলে মনে হতো। বিশেষকরে তার অলঙ্কারগুলোকে আমার কাছে বেশি ভীতিকর বলে মনে হতো। এরপর থেকে বিয়ের সময়ে আমি কনেদেরকে ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানকেও ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। তবে কিছুদিন পর আমার ভয় ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিল। তবে সেইসাথে বিয়ের কনেদের প্রতি আমার আগের সমস্ত আকর্ষন আমাকে চিরতরে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

ঠিক এই সময়ে আমাদের পাশের বাড়িতে একটা বিয়ে অনুষ্টিত হয়েছিল, যেখানে আমাকে বাধ্যতামূলকভাবে যেতে হয়েছিল।

***

বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘ঝুলবারান্দার বাড়ি’ হিসেবে। কারণ, বাড়িটির ওপরের তালার দুই রুমের দৈর্ঘ জুড়ে একটি ঝুলবারান্দা পাশের রাস্তার ওপরে ঝুলে ছিল। বাড়িটির সদস্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল। সেই বাড়ির যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছিল, আমি তার ছোট দুই ভাইয়ের বন্ধু ছিলাম। মেয়েটি খুবই হাসিখুশি ও বাচাল প্রকৃতির ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই সে আমাকে সারাক্ষণ উত্যক্ত করত। এমন এমন কথা বলত যাতে আমি বিব্রত অনুভব করতাম এবং তার ধারেপাশে যেতে লজ্জাবোধ করতাম। তবে তার এই জ্বালাতনগুলো আমার খারাপ লাগত না, বরং উপভোগই করতাম। একসময়ে আমি আমার বন্ধুদের সাথে বাড়িটিকে বিয়ের সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। যদিও কয়েকবার আগুণের শিখার মতো আমার মধ্যে কনেটির কাছে যাবার ও তাকে স্পর্শ করার বাসনা জেগেছিল, কিন্তু আমি সেটিকে দ্রুত দমন করে ফেলেছিলাম। বিয়ের পর বাপের বাড়ি হতে তার চলে যাওয়ার সময় হয়ে এলে আমি চেয়েছিলাম এই অনুষ্ঠান হতে নিজেকে দূরে রাখতে। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমাকে জোর করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির প্রবেশ কক্ষের নীচে অলঙ্কার পরে মেয়েরা ভিড় জমিয়েছিল। আমি চুপচাপ একটা দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর কনেকে সেখানে ওপরের রুম হতে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বাইরের রাস্তায় কনেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। মহিলারা এক এক করে কনের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল। তারা তাকে জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কাঁদছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছিল বিয়ে নয়, এই বাসায় কারো মৃত্যু হয়েছে এবং শোকার্ত মানুষেরা দল বেধে কাঁদছে। একজন আরেকজনের চেয়ে উচ্চস্বরে। কিছুসংখ্যক মানুষ এমন মুখভঙ্গি করছিল, যে আমার হাসি পাচ্ছিল। আমি মনে মনে তাদের হরেক রুমের কান্নার স্টাইল নকল করছিলাম, পরে তাদেরকে শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ার জন্যে। এই সময়ে একটা পুরুষ কন্ঠস্বর প্রবেশ দরজার মধ্যদিয়ে শোনা গিয়েছিল। তিনি কঠোর স্বরে মেয়েদেরকে আদেশ দিয়েছিলন কান্না থামানোর জন্যে এবং কনেটিকে তাৎক্ষণিকভাবে গাড়িতে তুলে দিতে। নতুবা তারা ট্রেন মিস করবে। পুরো কক্ষটির ভেতরে নীরবতা নেমে এসেছিল। এরপর মহিলা পরিবৃত হয়ে কনেটি ধীরে ধীরে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে আসছিল। দুই ছোট ভাইয়ের কাঁধে ভর করে। অলঙ্কারের মৃদু শব্দ ছাড়া সবকিছুই নিশ্চুপ ছিল। দুইজন মহিলা কনের পরিচ্ছদের নীচের অংশকে মাটি থেকে একটু ওপরে তুলে ধরে রেখেছিল। লাল রঙের বিয়ের পোশাক ও লম্বা ঘোমটার নীচে কনেকে একেবারেই দেখা যাচ্ছিল না। কেবল তার পায়েলের (যেটি তার এমব্রয়ডারি করা চপ্পল পর্যন্ত নেমে এসেছিল) ওপরের সাদা মাংশপেশী ছাড়া। আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময়ে অবাক হয়ে আমি ভাবছিলাম যে, মেয়েটিকে এতো ছোট লাগছে কেন। পরের মুহূর্তেই ঘাড় টেনে আমার সামনে থাকা দুই মহিলার মধ্যদিয়ে আমি তাকে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলাম। আমি জানি না কীভাবে, কিন্তু সে তার দুটো ঘোমটা এবং মুখের ওপরে ঝুলে থাকা সোনা ও রূপার অলঙ্কারের পেছন থেকে আমার দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছিল। তখনই একটা প্রবল ভয় আমার পুরো শরীরে ছড়িয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল যে, আমার সামনের দুজন মহিলা মুহূর্তের ভেতরেই লীন হয়ে গেছে। বিশাল কোন লাল অস্পষ্টতার ভেতরে। আকস্মিকভাবে নীচু হয়ে মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করেছিল। ফুল, আঁতর ও তার শরীরের মিশ্রিত গন্ধ একসাথে আমার সকল বোধকে আক্রমণ করে বসেছিল। আমি অনুভব করেছিলাম যে, তার রত্নখচিত ব্রেসলেটগুলো আমার কাঁধের গভীরে ঢুকে গেছে। এবং ব্যাথা তার স্পর্শের কোমলতা মুছে দিচ্ছে। মহিলারা তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার সোনার নেকলেসের একটা অংশ আমার জামার কলারের একটা বোতামের সাথে আটকে গিয়েছিল। খুলতে গেলে সেটা আরও জড়িয়ে যাচ্ছিল। কনেটি এই সময়ে আমার থেকে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়েছিল এবং কয়েকজন মহিলা আমার শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল। প্রবেশ কক্ষের ভেতরে কান্নার শব্দ বাড়ছিল। সেই সময়ে আমি দেখেছিলাম যে, কনের অলঙ্কার একজন পুরুষকে আঁকড়ে ধরেছে এবং একই কনে আবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ইতিপূর্বে কেন আমি তার ধুলো-রঙের মুখকে ঘোমটা ও ফুলের দড়ির পেছনে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি অনুভব করেছিলাম যে, সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, মাটিতে পা না ফেলেই। মুহুর্ত পরেই আমার শরীর তার সাথে অথবা তার শরীর আমার সাথে ধাক্কা খাবে। ক্ষণিকের সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করেছিলাম যে, প্রবেশ কক্ষে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু বাস্তবে সেটি কোনো প্রবেশকক্ষ ছিল না। সেটি ছিল একটি সদ্য খোঁড়া একটি কবর, যার খোলা মুখের ওপরে একটি বাঁকা গাছের শাখা উপুড় হয়ে পড়েছিল। আমি শরীরকে সংকুচিত করে পেছনের দিকে এসে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এবং ভিড় ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। কনের নেকলেসের সোনার অংশটা তখনও আমার শার্টের বোতামে আটকে ছিল। আমি দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিলাম।



***

আমি আমার পরিবারের কাউকেই আমি কিছু বলিনি। তবে ঘটনাটি আমার ওপরে একটা খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। যখনই আমি আমাদের বাড়ির কোনো শূন্যস্থানে প্রবেশ করতাম, তখনই আমার মনে হতো যে, কোনো বিয়ের কনে কোনোকিছুর পেছন দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। রাতের বেলায় অস্পষ্ট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত এবং অনুভব করতাম যে, একটা মিষ্টি গন্ধে আমার চারপাশ পূর্ণ হয়ে আছে। বৃষ্টি বা অন্যকোনো অবিরাম ধরণের শব্দের পেছন থেকে আমি কান্না ও অলঙ্কারের অস্পষ্ট ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পেতাম। আধখোলা কোনো অব্যবহৃত রুমের পাশ দিয়ে যাওয়া আমার জন্যে খুবই কঠিন ছিল। কারণ, কয়েকবারই আমি সাদা মাংশপেশী, মাংশের ভেতরে ঢুকে যাওয়া বিচ্ছুকে দেখেছিলাম দূরে সরে যেতে। ঝুলবারান্দার বাড়ির পরিবারটিও বিয়ের পরে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। তাদের পরিবর্তে একটি বয়স্ক দম্পতি সেখানে এসেছিল। যে সময়টাতে বাড়িটি খালি ছিল, সে সময়ে প্রতিবারই প্রবেশকক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে থমকে দাঁড়াতাম। দরজাটিকে খোলা ও ভাঙা বলে মনে হতো। আমি অন্ধকারের মধ্যে অলঙ্কারের ঝলকানি কল্পনা করতাম। বিশ্বাস করতাম যে, আমি যদি দরজার খোলা অংশের ভেতর দিয়ে তাকাই, তাহলে আমি সেখানে কনেটিকে দেখতে পাবো। ঝুলবারান্দার বাড়ির সেই বাকপটু কনে নয়, আমাদের পরিবারের কয়েক পুরুষ আগের সেই কনেটিকে, যে নিঃশব্দে মরে গিয়েছিল। আমি জানতাম যে, এই সবকিছুই ছিল আমার মানসিক বিভ্রম বা মনের কল্পনা। কিন্তু এই কল্পিত দৃশ্যগুলোকেই আমার কাছে সত্যিকার দৃশ্যের চেয়ে বাস্তব বলে মনে হতো। কল্পনাগুলোকে মনে হতো বাস্তব ঘটনার চেয়ে অধিকতর বাস্তব।

***

আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এই ভয়ের শিকার হয়েই সারাজীবন আমাকে কাটাতে হবে। কিন্তু আমি বড় হতে হতে দেখলাম আমার ভয়টা মিলিয়ে গেছে। আরো অন্যান্য ছেলেমানুষির মতো। দিনে দিনে আমাদের সেই কনেটিরও আমার ওপরে অধিকার কমছিল। তারপর থেকে পারিবারিক আলোচনায় তার প্রসঙ্গ আসলে আমি তার গল্পটিতে বিভিন্ন ধরনের অসামঞ্জস্য খুঁজে পেতে লাগলাম। অবাক হতাম আমি তাকে কেন এতো ভয় পেয়েছি তা ভেবে। তবে ভয়ের এই মৃত্যু আমার মধ্যে এক ধরনের অস্পষ্ট বেদনার জন্ম দিয়েছিল। আমি কল্পনা করতাম যে, এমনদিন দূরে নয় যখন কনের মৃত্যুর স্মৃতি ও মৃত্যুর ভয় দুটোই চিরকালের জন্যে আমার মন থেকে উবে যাবে।

কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে দুটোই আমার কাছে ফিরে এলো। যদিও খুব কম সময়ের জন্যে।

***



সেদিন আমাদের এক আত্মীয় মারা গিয়েছিল। আমরা যখন শবাধার বহন করে গোরস্থানে পৌঁছলাম, তখনো তার কবর তৈরি শেষ হয়নি। পরপর তিনটে আলাদা জায়গায় কবরটি অর্ধেক খোঁড়ার পর প্রতিটাতেই আগের কবরের অবশিষ্টাংশ উঠে আসলো। এরপর কবর খননকারী চতুর্থ জায়গায় কোদাল মেরে আমাদেরকে নিশ্চিত করল যে, সেখানে অতীতে কোনো কবর ছিল না বলে সে জানে। যারা শবাধার নিয়ে সেখানে গিয়েছিল, তারা কবরস্থানের ভেতরে ঘোরাঘুরি শুরু করল। সময় কাটানোর জন্যে। আমিও এদের একটি দলের সাথে যোগ দিলাম। আমি গোরস্থানের জায়গাটিকে আরো বেশি আগ্রহ ও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। কারণ, সেখানে আমি অনেকদিন পরেই গিয়েছিলাম। এছাড়াও জায়গাটি ছিল আমাদের পারিবারিক গোরস্থান, যদিও সেখানকার অধিকাংশ কবরই ছিল অন্যদের। আসলে এই গোরস্থানটিতে যে কাউকেই কবর দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু জায়গাটি আমার পূর্বপুরুষরা দান করেছিলেন, সেহেতু এখানে কবর দেওয়ার জন্যে আমাদের পরিবারের অনুমতি দরকার হতো। এতে আমাদের কিছু উপার্জনও হতো। যদিও কবরটির বিশাল আয়তন বিবেচনায় নিলে তা খুবই কম ছিল। বলতে গেলে কিছুই না। আমাদের দলের অন্যান্যরা এই অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়নি।

আমি আদের আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম যে, গোরস্থানে গাছের সংখ্যা আগের চেয়ে কম। এমনকি অনেক গাছকে আমার কাছে বিবর্ণ ও মৃত বলে মনে হলো। রোদ বাড়ার সাথে সাথে আমি গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে খেয়াল করলাম। আমাদের নিকটেই একটা বিকলাঙ্গ গাছের ডালপালাকে দেখলাম। মুচড়ে ও ভেঙে আছে। সেটির উলঙ্গ কালো শাখার কারণে পুরো গাছটিকেই মনে হচ্ছিল শোকার্ত। একটিমাত্র ডাল ছাড়া। গাছের কোটর হতে বের হওয়া এই ডালটি আশ্চর্জনকভাবে উজ্জ্বল সবুজ পাতা দিয়ে এবং মাটির আবরণ দিয়ে ঢাকা ছিল।

কয়েকদিনে ওটাও শুকিয়ে যাবে – ডালটির নীচে দাঁড়িয়ে আমি ধারনা করলাম। এই সময়ে আমাদের দলের একজন মন্তব্য করল, “এই গাছটি সবসময়েই এরকম ছিল – হাড়ের মতো শুকনা এবং পাতাগুলো সব সময়েই উজ্জ্বল ও সবুজ।“

সে ছিল একজন গরীব ও জরাগ্রস্ত মানুষ। আমরা তাকে মনোযোগ দিয়ে শুনছি লক্ষ্য করে সে যোগ করল,”সম্ভবত কোনো বিয়ের কনেকে এখানে কবর দেওয়া হয়েছিল। এই ডালের নীচেই।“

আমাদের মনোযোগ বাড়ছে দেখে সে আরও বলল,”লোকজনেরা বলে কোনো বিয়ের কনে যদি তার বরের বাড়িতে পৌঁছার আগেই মরে যায়, তাহলে তার কবরের ওপরের ডালগুলো কখনোই শুকিয়ে যায় না।“

মুহূর্তের জন্যে আমার সেই শিশুকাল – যা সেই বিয়ের কনে দিয়ে পরিব্যাপ্ত ছিল, তা ফিরে এলো। কথা বলতে বলতে দলটি ইতিমধ্যেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আমি তাদেরকে থামাতে পারলাম না। আমি আমার হাড়ের ভেতরে অনুভব করলাম যে, এটিই সেই কনের অচিহ্নিত কবর। আমার পায়ের নীচের শুকনো মাটি সরে গেল বলে মনে হলো। এবং, মাটির ওপরের একটা ফাটলকে মনে হলো প্রসারিত হলো।

আগের ঘটনাটি আবার শুরু হচ্ছে নাকি? আমি অবাক হলাম। কিন্তু ভয় পেলাম না। মনে হলো বেদনা মাটি থেকে লাফ দিয়ে ওপরে উঠছে। ঢেউয়ের মতো। আমি যখন সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, তখন অনুভব করলাম যে, আমার পুরনো ভয় ফিরে আসছে। আমি অবজ্ঞাপূর্ণভাবে আমার পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেকে দম করলাম। পরিবর্তে শক্তভাবে গরম শুকনো মাটির ওপরে বসে পড়লাম। সম্মোহনের অবস্থাটি কয়েক সেকেন্ডের বেশি দীর্ঘ হলো না। তারপর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো।

ঘোষণা করা হলো যে, কবরটি তৈরি হয়ে গেছে এবং চারদিকে ইতস্তত ঘুরতে থাকা মানুষেরা একটা জায়গায় জড়ো হতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং মানুষজনের দিকে এগোতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে যে, পুরো ব্যাপারটি কীভাবে শুরু হয়েছিল এবং কত দ্রুত তা শেষ হয়ে গেল।

যদিও তখনকার মতো বিষয়টি শেষ হয়ে গেল, একটা ভাবনা আমার মনের ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগল যে, কী কারনে ঘটনাটি ঘটেছিল তা আমি জানি। যদিও সেই সময়ে আমি মনেই আসেনি যে, বা’ই’কেও এই গোরস্থানেই সমাহিত করা হয়েছিল।




বয়স্ক দম্পতিটি চুপচাপ সেই ঝুলবারান্দার বাড়িতে বসতি স্থাপন করল। সময়ের সাথে তারা আরও বয়স্ক হয়ে গেল। পৃথিবীর অজ্ঞতেই। আমি জানি না কখন-কিভাবে প্রথম আমি তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিলাম। এক সময়ে আমি দেখতে পেতাম যে, সেই বাড়ির খোলা প্রশস্ত বাইরের দরজা দিয়ে প্রায়ই একজন বয়স্ক মানুষ প্রবেশকক্ষের তাখতের ওপরে বসে থাকেন।

সাধারণত তাখতের পাশে কয়েকটা রাত্তান (rattan) চেয়ার থাকত এবং সেগুলোতে এলাকার কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষ বসে থাকত। প্রায়ই দেখতাম তারা দাবা খেলাইয় মগ্ন হয়ে আছেন। পড়াশুনায় আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্যে আমি আমাদের বাসার ছাদের একটা একাকী ঘরে চলে গেলাম। রাস্তার পাশের প্রবেশকক্ষের দুটো দরজা এবং ওপরের তালার দুটো কক্ষ এই কক্ষ থেকে সরাসরি দেখা যেত। এক সারি ফুলহীন টবের গাছ ঝুলবারান্দা হতে ঝুলে থাকত। একটি ছোট্ট বালিকা মরিচা ধরা রূপার অলঙ্কার পড়ে প্রতি দুই-তিনদিন পর পর সেগুলোতে পানি দিত। একটা কাঁসার পাত্র দিয়ে। আমাদের এই বাড়ি দুটো শুধুমাত্র সড়ক দিয়ে নয়, আমাদের বাগান দিয়েও আলাদা করা ছিল। ফলে সেই দূরত্ব থেকে তাকে আসলেই একটি ছোট্ট বালিকা বলে মনে হতো। পরবর্তীতে – আমি জানি না ঠিক কখন – আমি জানতে পেরেছিলাম যে, মেয়েটি আসলে ছিল সেই দম্পতির কাজের মেয়ে এবং তার নাম ছিল খানম। সকল প্রতিবেশী ও দোকানদারেরা খানমের খুবই পরিচিত ছিল এবং তারা তার সাথে কৌতুক করত। সে ছিল একটি পাহাড়ি মহিলা এবং সম্ভবত সেই দম্পতির চেয়ে বয়সে বড় ছিল। কিন্তু সে আট বা দশ বছরের কোনো মেয়ের চেয়ে লম্বা ছিল না। সম্ভবত সে কারণেই লোকজন তার সাথে কথা বলত, যেমন করে একজন শিশুদের সাথে কথা বলে। সে এমনভাবে হাঁটত যে, মনে হতো কেউ তাকে পেছন হতে বারবার ঠেলছে। এমনকি তার কথাও তার হাঁটাকে অনুসরণ করত। মনে হতো তার প্রতিটা কথাই তার মুখের মধ্যে আটকে থাকত এবং সেগুলো অপেক্ষা করত পেছনের কথাগুলো থেকে ধাক্কা খেয়ে বের হবার। এলাকার ছেলেপেলেরা, এমনকি কিছু সংখ্যক দোকানদারেরাও তার কথার অনুকরণ করত, যখন তারা তার সাথে কথা বলত। এগুলো কোনো কোনো সময়ে তাকে বিরক্ত করত। সে তাদেরকে ভয় দেখাত এই বলেঃ “আমি তোমার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে নালিশ করব!” কিন্তু তারা সবাই জানত যে, তাদের চেয়ে সেই পুলিশকে বেশি ভয় করে। দুষ্ট ছেলেরা তার পেছন থেকে লুকোচুরি খেলতে খেলতে তার কানের কাছে এসে চিৎকার করত,” পুলিশ!” যা শুনে সে ভয়ে আঁতকে উঠত এবং কয়েক পা দূরে গিয়ে বলত,”আমি পুলিশে দেবো তোমাদেরকে।“ এলাকার বাড়িগুলোতে সে সারাক্ষণ স্বাধীনভাবে যাতায়াত করত। বেশিরভাগ সময়েই সংসারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যে। এবং আমাদের সেই বয়স্ক দম্পতির জন্যে যেকোনো তথ্যের প্রধানতম উৎস ছিল।

সে তার গৃহকর্তীকে ডাকত বা’ই বলে এবং গৃহকর্তাকে সাহেব বলে। আমরা তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম যে, দম্পতিটি সন্তানহীন ছিল। বা’ই এর কোনো পরিবার ছিল না। সাহেবের দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয়স্বজন ছিল। তাদের কেউ কেউ এই শহরেই বাস করত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সামাজিক যোগাযোগ ছিল না। বহুদিন আগে থেকেই। কেবল তাদের ক’জন অসুস্থ্য হয়ে মারা গেলে সাহেব তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। বা’ই কোনোদিনই বাসার বাইরে পা ফেলেনি। তার পায়ের হাটুতে বাত ছিল। ফলে চলাফেরা করা তার জন্যে কষ্টকর ছিল। বিশেষ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা তার জন্যে অসম্ভব ছিল।

একদিন খানম আমার মাকে বা’ইএর দীর্ঘস্থায়ী রোগ সম্পর্কে জানালে মা তাকে খুব সহজ মাখার তেলের একটা রেসিপি দিলেন। তবে তিনি এর বিভিন্ন উপাদানের অনুপাত নিয়ে একটু অনিশ্চিত ছিলেন। খানম চলে যাওয়ার পর আমার পিতা আসলে মা তাকে অনুপাত সম্পর্কে জিগ্যেস করলেন। একারণেই তাদেরকে বা’ই ও সাহেবের সাথে কথা বলতে হলো। দেখা গেল যে, বাবা এই দম্পতি সম্পর্কে কিছু জানতেন। তিনি মা’কে বললেন যে, যৌবনে বা’ই এই শহরের একজন বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন। বা’ই যে নামে সেই সময়ে পরিচিত ছিলেন, সেটাও তিনি মা’কে বললেন। জানালেন যে, এই নামটি প্রত্যেক সঙ্গীত অনুরাগীদের পরিচিত ছিল। তিনি এটাও বললেন যে, সাহেব একটি পুরাতন অভিজাত সন্তান সদস্য ছিলেন। কিন্তু এক সময়ে তারা সহায়সম্পদ হারিয়ে ফেলেন। যাই হোক, তিনি ছিলেন বা’ই এর সবচেয়ে বড় প্রশংসাকারী। সেই সময়ে ইনি বা’ইকে বিয়ে করেন এবং দুজনেই শহর ছেড়ে চলে যান। “তুমি কি কখনো তার গান শুনতে যাওনি?” মা হাসতে হাসতে জিগ্যেস করলেন। বাবাও হাসতে লাগলেন। ”আমি গানের অনুরাগী বা অভিজাত বংশের মানুষ ছিলাম না,” তিনি বললেন। “ঐ দিনগুলোতে আমি একজন ছাত্র ছিলাম। ক্লাসের বেতনের টাকা জোগাড় করতেই হিমশিম খেতাম। সময়ও ছিল না আমার। আমি তার গান শুনিনি। তবে তার সুখ্যাতির কথা শোনা আমার জন্যে অসম্ভব ছিল না।

বেশিরভাগ সময়েই আমি দেখতাম যে, সাহেব প্রবেশকক্ষে বসে আছেন। দূর থেকে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া কঠিন ছিল। যদিও প্রায় সময়েই আমি তাকে বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়ার ও বাড়িতে ফেরার সময়ে দেখতে পেতাম। তার হাতে সব সময়ে আবলুশ রঙের একটি হাঁটার-লাঠি থাকত। তার পরিচ্ছদ ছিল প্রাচ্যদেশীয়, যা তাকে শহরের একজন অভিজাত নাগরিক বলে মনে করিয়ে দিত। তবে তিনি কখনোই ইংরেজ শিকারীর টুপি পরতে ভুলতেন না। হাটার-লাঠি ব্যবহার করে খুব ধীরে ধীরে তিনি হাঁটতেন। আমি তাকে শুধু দূর থেকেই দেখেছিলাম। কয়েকবার আমি তাকে দূরের এক বাজারে দেখেছিলাম এবং, লাঠি ও টুপির কারণে তাকে চিনেছিলাম।

বা’ইকে আমি আরও কম সংখ্যকবার দেখেছি। তাদের দুই কক্ষের একটির দরজা স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকত। অন্য কক্ষের দরজাটি কোনো কোনো সময়ে খোলা থাকত। এই সময়গুলোতে খানম টবের গাছগুলোতে পানি দিত। অবশ্য কোনো কোনো সময়ে গরমের জন্যে তারা কক্ষগুলোর দরজা খুলে দিত বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস কক্ষগুলোতে প্রবাহিত করার জন্যে। এই সময়ে বা’ইকে দেখা যেত কক্ষের ভেতরে বিছানার ওপরে বসে আছেন। কয়েকবার আমি খানমকে দেখেছি তার মাথার চুল আঁচড়ে দিতে। একবার বা’ই নিজেই খানমের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন। তার ক্ষেত্রেও দূর থেকে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্পষ্টভাবে বোঝা যেত না। আমি শুধু বুঝতে পারতাম যে, তিনি ছিলেন একজন সুন্দরী ও অভিজাত মহিলা। প্রথমে আমি সন্দেহ করেছিলাম যে, সাহেব তার থাকার জায়গাটি নীচের তালাতেই স্থায়ীভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু একদিন বা’ই’র দরজা খোলা ছিল। তখন আমি দেখতে পেলাম যে, তিনি তার বিছানার ওপরে বসে থাকা অবস্থায় একটু পর পরই সামনের দিকে ঝুঁকছেন। এই সময়ে খানম দম্পতির দিকে হেঁটে গেল এবং একটু পরেই আবার তাদের কাছে ফিরে এলো। আমি ধারণা করলাম যে, তারা দুজনেই খাচ্ছেন। এই দৃশ্যটি আমি বহুবার দেখেছিলাম। এমনকি একবার আমি এটাও দেখেছিলাম যে, সাহেব বা’ইকে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছেন এবং বৃদ্ধা রা’ই বারবার খেতে অস্বীকার করছেন। মুখ এদিক-সেদিক ফিরিয়ে, তবে মনপ্রাণ দিয়ে হাসতে হাসতে। এই সময়ে খানম পানি নিয়ে সেখানে আসলো। বা’ই তাকে পিঠে চপেটাঘাত করলেন এবং সে মুখে হাসি চেপে বের হয়ে গেল।

***

সম্ভবত আমার পরিবার পরিবার জানত,তবে আমি অনুমান করতে পারতাম না যে, কতদিন যাবত সাহেব ও বা’ই সেই ঝুলবারান্দার বাড়িতে বাস করছিলন। কারণ, তাদের দুইজনের প্রতি আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। দম্পতিটি আমার চারপাশের রংহীন ভূদৃশ্যের অংশের মতো ছিল। আমি তাদের দিকে তাকানো বা না তাকানোতে কিছুই যায় আসত না। সম্ভবত একারণেই আমি লক্ষ্য করতে পারিনি যে, ওপরের তলার কক্ষটি অনেকদিন খোলা হয়নি। এমনকি নীচের তলার প্রবেশ কক্ষের দরজাটিও ভেতর থেকে আটকে রাখা হয়েছিল অনেকদিন। কেবলমাত্র যেদিন খানম আমাদের বাসায় গরম পানির বোতল ধার করতে আসলো, সেদিনই আমরা বুঝতে পারলাম যে, বা’ই গত কয়েকদিন থেকে খুবই অসুস্থ এবং সাহেব শহরের বাইরে অবস্থান করছেন। যখন জিগ্যেস করা হলো কে বৃদ্ধাকে দেখাশুনা করছে, খানম আমাদেরকে অবহিত করল যে, বা’ই সাহেবের দুইজন মহিলা আত্মীয়াকে আসার জন্যে খবর দিয়েছিলেন, যারা খানমের আমাদের বাড়িতে আসার দিনে এসেছে।

বিকেলের দিকে আমি দেখলাম বাই’ইয়ের কক্ষের দরজাগুলো পুরো খোলা। এবং কয়েকজন নতুন মহিলা সেখানে এসেছে। পরদিন সকালে প্রায় আধা ডজন নতুন মহিলা সেখানে আসলো। এবং, তৃতীয়দিনের বিকেলের মধ্যেই তাদের সংখ্যা বেড়ে গেল। চতুর্থদিনে, সূর্য ওঠার একটু পরেই, বাড়িটি হতে কান্নার শব্দ ভেসে আসলো।

কিছুক্ষণ দেখার পর আমি নীচে নেমে আসলাম। আমার পরিবারকে জানানোর জন্যে। দেখতে পেলাম খানম আমাদের বাড়ির উঠোনে বসে কাঁদছে। সে ইতিমধ্যেই সবাইকে খবরটি বলেছেঃ বা’ই কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। তাকে দেখাশুনা করার মহিলারা তাকে পাঠিয়েছে কিছু ধূপ নিয়ে আসার জন্যে। মৃতদেহের পাশে পোড়াবে বলে। কিন্তু দোকান তখনো খোলেনি। আমার মা বারান্দার একটা আলমারির মধ্যে ধূপ খুঁজতে খুঁজতে খানমকে বিস্তারিতভাবে জিগ্যেস করলেন বা’ইএর কী অসুখ হয়েছিল। খানম যা জানত, তার সবই বলল। সে আরও জানাল যে সাহেব এখনো ফিরেননি। তিনি যাবার সময়ে বা’ই সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল এবং, তিনি কোথায় গেছেন তা বা’ই ছাড়া আর কেউই জানে না।

আমি আমার কক্ষে ফিরে এলাম। দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে বা’ইয়ের বাড়ির কান্নার আওয়াজ প্রায় থেমে এলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই একটার পর একটা গাড়ি আসতে লাগল। সেগুলো থেকে মহিলারা প্রবেশ কক্ষের সামনে নামতে লাগল। গাড়ির চালকেরা, যাদেরকে এই এলাকার মানুষ বলে মনে হলো না, তারা প্রবেশ কক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল। এই সময়ে ওপরের তলা থেকে উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল এবং দ্রুত থেমে যাচ্ছিল। কিন্তু এক সময়ে কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। আর থামল না। ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত তা চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিণত হলো। আমি আমার দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। বা’ই’র বাড়িকে মনে হলো একটা দাঙ্গার জায়গা। সেখানে কোনো কান্না ছিল না। ছিল শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি। এখানে খানমের কন্ঠস্বর সবার ওপর দিয়ে শোনা যাচ্ছিল। মহিলারা চিৎকার করতে করতে একজন অন্যজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কান্নাকে পরাজিত করে। একটা ভয়ঙ্কর ধরণের অস্থিরতা তাদের ওপরে ভর করেছিল। এবং, খানম একটা বাদুড়ের মতো ছোটাছুটি করছিল এবং পাগলের মতো অন্যদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। এর একটু পরে রাস্তা থেকে পুরুষ মানুষদের কন্ঠস্বর শোনা গেল। আমি ঝুলবারান্দার নীচের জায়গাটিতে তাকালাম। দেখতে পেলাম একদল মানুষ প্রবেশ কক্ষের সামনে ঝগড়াবিবাদ করছে এবং এলাকার কয়েকজন মানুষ তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত ওপরের ও নীচের তলায় দুই জায়গাতে বিবাদ চলার পর আমি দেখতে পেলাম মহিলারা লাইন দিয়ে প্রবেশকক্ষের দরজা দিয়ে তাদের পুরুষ সঙ্গীদের নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তারা উচ্চস্বরে কথা বলছিল এবং তাদের পুরুষসঙ্গীরা উচ্চস্বরেই তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না তারা কী বিষয়ে কথা বলছিল। আমি ঝুলবারান্দার দিকে আবার তাকালাম, দুই কক্ষেরই দরজা বন্ধ দেখতে পেলাম। এবং সেটা এতই শান্ত ছিল যে, মনে হলো আদৌ কিছু ঘটেনি সেখানে। যদিও আমি বাতাসের সাথে আসা ধূপের গন্ধ নাকে পেলাম।

হৈচৈ সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের জানানোর জন্যে আমি নীচের তলায় গেলাম। কিন্তু খানম আমার আগেই সেখানে ছিল। এবং, সে ইতিমধ্যেই সবাইকে পুরো গল্পটা বলেছে, যা আমাদের মহিলারা পুনরাবৃত্তি করছিল।

খানমের বক্তব্য অনুসারে গত কয়েকদিন বা’ই আধা-অচেতন ছিলেন। এই সময়ে তিনি হঠাত হঠাত জেগে উঠতেন এবং সাহেব কোথায় তা জিগ্যেস করে আবার অবচতনে চলে যেতেন। কিন্তু একদিন আগে তিনি পুরোপুরি সচেতনতা লাভ করেন এবং তাকে যথেষ্টই সুস্থ মনে হচ্ছিল। তিনি কিছু খাবার খেতে চেয়েছিলেন। এরপর খানম তাকে তার অলংকারের বাক্সটা এনে দিয়েছিল। তিনি প্রতিটা অলংকারই পরেছিলেন এবং আবেগপূর্ণভাবে খানমকে বলেছিলেন সাহেবের জন্যে প্রবেশ কক্ষটি খুলে রাখার জন্যে। নিজে সারারাত বিছানায় পুরো জেগেছিলেন। সকালে আবার সাহেব সম্পর্কে জিগ্যেস করেছিলন। খানমকে দিয়ে মাথার চুল আঁচড়িয়ে নিয়েছিলেন, এবং তার কাজলের বাক্সটি চেয়েছিলেন। খানম বাক্সটি নিয়ে ফিরে আসার আগেই বা’ইয়ের মৃত্যু হয়েছিল। তারপর সাহেবের মহিলা আত্মীয়রা সবাই এসেছিল। তারা সবাই কান্নাকাটি করছিল। কিছুক্ষণ পর মহিলারা বা’ইয়ের হাত, পা ও মুখের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নাকাটি ও চিৎকার করছিল। এই সময়ে একজন কান্নারত মহিলা নিজেকে বা’ইয়ের মুখের ওপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। এই সময়ে অন্য এক মহিলা দেখেছিল যে, বা’ইয়ের কানের দুলটি নেই। সে জিগ্যেস করেছিল সেটা কোথায় আছে? তখন প্রথম মহিলাটি তৃতীয় এক মহিলার দিকে নির্দেশ করে বলেছিল,” আংটিটি যেখানে আছে।“ তখন দেখা গিয়েছিল যে, বা’ইয়ের আঙুল থেকে একটি আংটিও হারিয়ে গেছে। এটাই ছিল মারামারির শুরু। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তুলছিল এবং, প্রত্যেকেই নিজেকে বা’ইয়ের সাথে নিকট সম্পর্কের দাবী করে তার অলঙ্কারগুলোর মালিকানা দাবী করছিল। এক পর্যায়ে তারা ধাক্কাধাক্কি করে বা’ইয়ের মৃতদেহ হতে শেষ টুকরা অলঙ্কারও খুলে নিয়েছিল। মহিলাদের কথা অনুযায়ী তারা তাকে ‘উলঙ্গ’ করে ফেলে ফেলছিল।

আমার মনে হলো যে, খানম অতিরঞ্জিত কথা বলছে। আমি বললাম যে, আমি নিজে পুরো ঘটনাটি দেখেছি, তবে লুটপাটের বিষয়টি খেয়াল করিনি। তারপর ছাদের ওপর থেকে আমি কীভাবে ঘটনাটি দেখেছি তা বর্ণনা করলাম। খানম কোনো মনোযোগ না দিয়েই আমার কথা শুনল। এমনকি কিছুটা ঘৃণার সাথে বলল যে, সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। তারপর সে বলল যে, মহিলা আত্মীয়রা বা’ইয়ের শরীরকে এলাকার এক মহিলার কাছে রেখে একসাথে চলে গেছে। সে এখানে এসেছে জানতে যে, সাহেবকে কীভাবে খুঁজে বের করে তাকে খবরটা দেওয়া যায়। বাবাকে ডাকা হলো। তার কোনো ধারণাই ছিল না সাহেব কোথায়। তারপরেও সে একটি কাগজের ওপরে কিছু লিখে আমাদের বাড়ির চাকরকে দিলেন সেটি বহন করে শহরের বর্ষীয়ান কিছু জ্ঞানী মানূষদের কাছে নিয়ে যেতে, যারা সাহেবের সাথে পরিচিত থাকতে পারেন। শুধুমাত্র তখনই প্রত্যেকেই খেয়াল করে দেখল যে, খানমের নাক ও কান দিয়ে একটু একটু রক্ত ঝরছে। এবং তার মুখ, হাত ও পায়ের রূপার অলংকারগুলো নেই। মা চিৎকার করে বললেন,”তারা কি তোমার জুয়েলারিগুলোও লুট করে নিয়ে গেছে?

না, খানম বলল। যা ঘটেছিল তা হলো, যখন সে এক এক করে মহিলাদেরকে জড়িয়ে ধরে বা’ইর অলংকার খোঁজ করছিল, প্রত্যেকটা মহিলাই তাকে বাধা দিচ্ছিল। কাজেই সে নিজেই তার সবগুলো জুয়েলারি ছিড়ে ফেলে তাদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিল। এই বলে যে, নাও, এটাও নাও।

“কারণ, তারাও আমার বা’ই ছিল,” বলে সে কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ শান্তনা দেওয়ার পর সে শান্ত হলো। সে আমাদেরকে তার আঘাতের জায়গায় মলম দিতে দিলো, যাতে রক্ত বন্ধ হয়। তারপর সে সার্ভেন্টের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরই সার্ভেন্ট জবাবগুলো নিয়ে ফিরে এলো। কেউই বলতে পারেননি যে, সাহেব কোথায় গেছেন। এমনকি তারা এটাও জানেন না যে, তিনি শহরে ফিরে এসেছেন কিনা।

খানম যখন চলে যাচ্ছিল, তখন চাকর নতুন খবর নিয়ে এলো। কেউ একজন পুলিশকে খবর দিয়েছে যে, বা’ইকে দিনের উজ্জ্বল আলোতে খুন করা হয়েছে এবং তার অলংকার লুটপাট করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এলো এবং বা’ইয়ের মৃতদেহ দায়িত্বে নিয়ে খানমের খোঁজ করল তার সাক্ষ্য নেয়ার জন্যে। সে কতটা ভয় পেয়েছিল,পুলিশ তা এখন বুঝতে পারল। জুয়েলারি ছাড়া তার মুখকে খুবই ম্লান এবং মৃতের মতো মনে হচ্ছিল। আমাদের লোকজন যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল, তখন সে তাদের দিকে মৃতের মতো তাকিয়েছিল। এইসময়ে আমার এক মামা, যিনি একজন আইনজ্ঞ ছিলেন, যিনি কানপুর হেকে এখানে এসেছিলেন নিজের কিছু কাজে, তিনিও তাকে বারবার ভয় দেখালেন যে, বিষয়টা আজই শেষ হবে না। এরপরেও খানমকে বারবার ডাকা হবে সাক্ষী হিসেবে। তখন তাকে পুলিশ ও এটর্নি আবার জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এরপর যখন তাকে জবানবন্দি দেওয়া চালিয়ে যেতে বলা হলো, সে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে গেল এবং শরীরে মোচড় দিতে লাগল। সে কারও কথাই শুনল না এবং এক রুম হতে অন্যরুমে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে। অবশেষে, বাধ্য হয়ে তাকে বাইরে অপেক্ষা করা চাকরদের কাছে হস্তান্তর করলাম আমরা।

যেহেতু খানম চিৎকার করছিল এবং তার ছোট্ট হাত-পা ছুড়ছিল, বাধ্য হয়ে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি লক্ষ্য করলাম যে, মামা আমার মা ও বাবাকে একপাশে ডেকে নিলেন। তাদেরকে ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন। তারপর তিনি আমাকে তার দিকে যেতে ইশারা করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, আমাকে নিয়ে তিনি এক্ষুনি কানপুরে চলে যাচ্ছেন।

“এবং মনে রেখো,” তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন,” এখানে অথবা কানপুরে কাউকে বলো না যে, তুমি কিছু দেখেছ। জানলে তারা তোমাকে কোর্টে টেনে নিয়ে যাবে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে।“

মা দ্রুত আমার জামাকাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন যাত্রার জন্যে। আমরা পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। অন্য একটা রাস্তা অনুসরণ করে ট্রেন স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

এক সপ্তাহের কম সময়ের ভেতরেই আমাকে কানপুর থেকে ডেকে আনা হলো। ফিরে আসার পর আমি মাত্র তিনটি নতুন বিষয় বের করতে পারলাম। প্রথমত, খানম আমাদের এক চাকরের আত্মীয়ের সাথে ঘটনার পরের দিনই পালিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয়ত, বা’ইকে আমাদের গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছে, আমার পিতার অনুমোদন সাপেক্ষে। এবং তৃতীয়ত, এখন পর্যন্ত সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আমি ওপরের তলায় গেলাম এবং বাড়িটির দিকে তাকালাম। ঝুলবারান্দার প্রায় সবগুলো গাছের চারাই শুকিয়ে গেছে। ওপর ও নীচের দুই তলার সবগুলো কক্ষই তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। আমার মনে হলো যে, বছরের পর বছর সেগুলো খোলাই হয়নি।




চতুর্থদিন বিকেলে সাহেবকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেখা গেল। আগের মতোই তিনি শিকারির টুপি পরেছিলেন এবং হাঁটার লাঠিতে ভর করে হাঁটছিলেন। আমি আমাদের বাড়ির সামনে বাগানে একটি ফুলের কেয়ারী তৈরি করছিলাম এবং আমার পিতা পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাহেব আমাদের কাছে আসলেন। পিতা তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে এগিয়ে গেলেন এবং সমবেদনা জানালেন। সাহেব বা’ইকে আমাদের গোরস্থানে কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্যে আমার পিতাকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর ড়াতাড়ি চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু পিতা তাকে আরও কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। তারা পাশের উঠোনে গিয়ে তুঁতগাছের নীচের চেয়ারে বসলেন এবং কথা বলতে শুরু করলেন। আমি আমার বাগানের কাজ করতে লাগলাম। সাহেব যতটুকু আশা করা হয়েছিল তা চেয়ে বেশি সময় থাকলেন। তিনি মৃদুস্বরে কথা বলছিলেন। সুতরাং আমি তাকে স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না। তবে আমি অনুমান করলাম যে, তিনি বা’ইয়ের গুণগান করছেন, যেভাবে মৃতদেরকে প্রশংসা করা হয়ে থাকে, তাদের জীবনের কিছু গল্প বর্ণনা করে।

শেষ পর্যন্ত তিনি উঠে দাঁড়ালেন। পিতা তাকে গেটের দিকে এগিয়ে দিলেন, যা বড় রাস্তার দিকে খোলা ছিল। তিনি নিজেই তাকে বাগানের পাশের চত্বরের সীমা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সাহেব চত্বরের শেষপ্রান্তে এসে থামলেন, পিতার সাথে করমর্দন করলেন, এক অথবা দুই সিঁড়ি নীচে নামলেন, তারপর আবার থামলেন, এবং শরীরের ভর হাঁটার-লাঠির ওপরে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন।

“অনুগ্রহ করে আমাকে শুধু একটা কথা বলুন,” তিনি উচ্চস্বরে বললেন। কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করেই চুপচাপ হয়ে গেলেন।

পিতা তাকে সহানুভূতিমূলক কিছু কথা বললেন। তারপর সাহেব উল্টো ঘুরে লাঠিতে ভর করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং গেটের কাছে এসে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “ওট অনেক দূরে, পুত্র। তুমি দীর্ঘজীবি হও।“ তারপর গেট পেরিয়ে রাস্তার ওপরে চলে গেলেন।

একই সপ্তাহে একদিন আমি যখন আমার কক্ষের রাস্তার দিকে মুখ করা দরজাটি খুললাম, আমি কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেলাম। সেগুলো গৃহস্থালির জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি ছিল এবং দাঁড়িয়েছিল সাহেবের প্রবেশ কক্ষের সামনে। এলাকার কিছু লোকজনও সেখানে দাঁড়িয়েছিল এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। আমি আরও দেখলাম যে, ঝুলবারান্দা হতে টবের গাছগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যে জায়গায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে নড়লাম না। একটু পর সাহেব প্রবেশ কক্ষ হতে বেরিয়ে এলেন। পেছনের দরজা বন্ধ করলেন। চেইন বাঁধলেন। একটা বড় তামার তৈরি তালা দিলেন। তারপর চাবিটি এলাকার একজন বর্ষীয়ান মানুষের হাতে দিলেন। এরপর তিনি এক এক করে সবার সাথে কোলাকুলি করলেন। এই সময়ে তার মাথা হতে টুপিটি পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিবারেই তিনি সেটিকে ঠিক করে নিলেন। পরের জনের সাথে কোলাকুলি করার আগে। সামনের গাড়িটি চলতে শুরু করল। সাহেব তার গাড়িতে উঠে কোচম্যানের পাশে গিয়ে বসলেন। সামনের আসনে। গাড়িটি যাত্রা শুরু করে আবার থামল। সাহেব নামলেন এবং কোচম্যানকে কিছু একটা বললেন। কোচম্যান অন্যদিক দিয়ে পেছনের আসনে গেল। একটি ছোট্ট ট্রাংক ও কাঠের হাতলওয়ালা পানির পাত্র বের করে আনল এবং সেগুলোকে সামনের আসনে নিয়ে গেল। সাহেব পেছনের আসনে এসে বসলেন। তার সামনে দাঁড়ানো লোকজনের দিকে তাকালেন এবং বিদায়ের জন্যে হাত নাড়লেন। ঘোড়ার লাগাম একটু নড়তেই সামনের গাড়ির পেছনে তার গাড়িটি চলতে শুরু করল। রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে দুটো গাড়িই ট্রেন ষ্টেশনের দিকে ঘুরল।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ