এ অঞ্চলের মানুষের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে তিনটি বড় ঘটনা হলো সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন।
বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ করে ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, উপলব্ধি, তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা এসব গল্পের প্রধান অনুষঙ্গ। একথা ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত কোন গল্পেই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠেনি, ছোটগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে তা সম্ভবও নয় তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত সবগুলো গল্প পড়লে বাঙ্গালির এ বিশাল আত্মত্যাগ ও অর্জনের একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।
গল্পপাঠের এ সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত বিখ্যাত কয়েকজন লেখকের গল্প থাকলো যা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভ্যাসকে তুলে ধরবে না তবে যুদ্ধের ভয়াবহতার একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
এ সংখ্যার আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন মোমিনুল আজম, এমদাদ রহমান, অলাত এহসান, বনি আমিন, সাজেদা হক, উৎপল হালদার, বিথী মিস্ত্রী, জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা । প্রচ্ছদের ছবিটি তুলেছেন লেখক তারেক অণু।
গল্পপাঠের লেখাগুলো লিঙ্ক আকারে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো লেখার ওপরে ক্লিক করুন। তারপর পড়ুন। একটি মন্তব্য রাখুন। যদি ভালো লাগে--তাহলে কেনো ভালো লাগলো, যদি মন্দ লাগে তাহলে কেনো মন্দ লাগলো-- লিখুন। আমাদের ইচ্ছে গল্পপাঠের পাঠকও লেখক হয়ে উঠুক।
বিজয় দিবসের গল্প
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প--রেইনকোট
রেইনকোট গল্পটির বিষয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। গল্পের মুল চরিত্র নুরুল হুদা একজন কলেজের লেকচারার। যুদ্ধের সময় নীরিহ পারিবারিক জীবন, আপোষকামী মনোভাব নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এবং তার ওপর মিলিটারির অত্যাচারে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। যুদ্ধের মারদাঙ্গা বর্ণনা এতে নেই। তবে আছে বর্ণনার ঘনঘটা। সে বর্ণনা পরিবেশ পরিস্থিতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। তাঁর গল্প এতো সরল গরল নয় যে তা পাঠককে গরগর করে টেনে নিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। তার সৃষ্টির রস আস্বাদন করতে হলে কিছুটা সময় কষ্ট করে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। তারপর পাঠক পাবেন তাঁর বাস্তবতার যাদু, যার সন্মোহনী ক্ষমতা পাঠককে দীর্ঘসময় বুদ করে রাখবে। রেইনকোট গল্পে ডিটেইল বর্ণনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের যে রূপ ধরা পড়েছে তাই আসলে আমাদের সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের রূপ।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অসাধারণ গল্প হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি মফস্বল শহরে প্রিয়জনের খোঁজে আসে লোকটি। গল্পে লোকটির কোন পরিচয় নেই। ভয়াল শহরে সে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। একসময় ধরা পড়ে মিলিটারির হাতে। তার উপর যে নির্যাতন হয় তাকে এককথায় বলা যায় থেতলানো মাংসের ভয়ানক পরিস্থিতি। অবশেষে লোকটি খুঁজে পায় তার প্রিয়জনকে। সে বর্ণনা আরও ভয়াবহ। মাটির নীচ থেকে সে বের করে আনে সে প্রিয়জনের বুকের পাজর, যা তলোয়ারের মতো বাঁকা। সে মাটি খুড়তে থাকে। আসলে সে পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ বের করে আনতে চায়।

গল্পটির গল্প নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, মতভেদ থাকতে পারে সেটি ভিন্ন বিষয় কিন্তু গল্পের বয়ানটি তিনি যেভাবে গেয়েছেন তাতে তা প্রকৃত গল্প হয়ে উঠেছে। গল্পটি পড়ার পর চোখের সামনে ভাসতে থাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র।

খুব সাদামাটাভাবে শুরু হয়েছে টোপ গল্পটি। একজন দেশীয় রাজাবাহাদুর নেমন্তন্ন করেছেন এক ছাপোষা লেখককে। সেজন্য আয়োজন করা হয়েছে বাঘ শিকারের। উদ্দেশ্য লেখককে রাজাবাহাদুরের দুঃসাহসী কীর্তি দেখানো। শিকারটি যখন হল--বাঘটি লাফ দিয়ে পড়ে নিহত হল। পড়ে মনে হবে খুব নিরীহভাবে শেষ হয়ে গেল গল্পটি। কিন্তু এর মধ্যেই সতর্কপাঠক আবিষ্কার করবেন গল্পটি ঠিক বাঘ শিকারের নয়। মানুষ শিকারের। এই গল্পের পরতে পরতে বিস্ময়কর চমকের খেলা করেছেন গল্পকার।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : টোপ
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে আলাপ : টোপ
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা

গাছের পাতায় মর্মর ধ্বনি জাগে। গাছটি একটি বুড়ো শিবের থানে আছে। বল্লাল সেনের আমলে এই বুড়ো শিব আসলে ন্যাড়া বুদ্ধদেবের মূর্তি ছিল। বুদ্ধরা বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গেলে নিম্নবর্গের হিন্দুরা বুদ্ধদেবকে তাদের শিব ঠাকুর বানিয়ে পূজো করতে শুরু করে। এই বুদ্ধ বা শিব ঠাকুর নিয়ে গল্প লেখেননি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। গল্পটি গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি। কয়েকজন লোক নির্জনে একাকী গাছটির কাছে গেলে মরমর নয়--শোনে তাদেরকে বলছেন, তোরা মর। তোরা মর। ফলে শুনে লোকগুলো মারা যায়।
গাছের পাতার মর্মর ধ্বনিকে যে যাদু বাস্তব অসামান্য গল্পের পরিণত করা যায় সেটা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখে দেখিয়েছেন।

ভূষণ নামে এক লোক সদ্য বিয়ে করেছে। বিয়ে করেই আবিষ্কার এই রহস্যময় জগতের সন্ধান পেয়েছে। এই রহস্যের নেই। তবে আছে প্রবল আকর্ষণ। এর তুল্য সুখ জীবনে আর কিছু নেই। ভূষণের বউ ঝুমকোলতা বিয়ের তিনদিন পরে স্নান করতে কলতলায় গেছে। নবীন যুবক সাবেক স্বদেশী বিপ্লবী অকৃতদার ঝ্যাঠা মশাইয়ে ঘরে লুকিয়ে বউয়ের স্নান করা দেখবে। এটা দেখতে গিয়েই তার মনে জ্যাঠামশাইয়ের জীবনটা অসুখী এবং অর্থহীন। কিন্তু ঘটনাচক্রে যুবকটি আবিষ্কার করে জ্যাঠা মশাইয়ের জীবন অর্থপূর্ণ। । সাধারণ বিষয়কে আকর্ষণীয়ভাবে দার্শনিকতায় টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে শীর্ষেন্দুর।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প : ঝুমকোলতার স্নানের দৃশ্য ও লম্বোদরের ঘাটখরচ

পাড়ায় একজন মধ্যবয়স্ক লোক আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী আছে। স্বচ্ছলতা আছে। তাকে কখনো অসুখী দেখা যায়নি। তবু কেনো লোকটি আত্মহত্যা করলেন? এই প্রশ্নটির উত্তর নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এই গল্পে। এ গল্পটি নিয়ে মৃণাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এ ধারার আরেকটি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র রশোমন।
রমাপদ চৌধুরীর গল্প : পোস্ট-মর্টেম
রমাপদ চৌধুরীর গল্প ‘পোস্টমর্টেম’ নিয়ে আলোচনা
আলোচক : অলাত এহসান


বিজয় দিবসের গল্প
১৯৭১-এ পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করার সময় জেনারেল টিক্কা খান তাঁর সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,-‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’। আর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন,-‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি রক্ত দিয়ে লাল করে দেয়া হবে’। জেনারেলদের সংকল্পটি সফল হবার দিনগুলোয় সুদূর ইউরোপ মহাদেশের জনৈক সংবাদকর্মী চরকির মতো সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশীদের চলাচলের ওপর সরকারি নজরদারী ও বিধিনিষেধ থাকলেও সংবাদকর্মীর মনের জোর ছিল অজেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন পাঠাতেন। পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল ও সংঘাতমুখর হয়ে উঠছিল। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা বা গৃহযুদ্ধ দমনের নাম করে পাক সেনারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে সেখানে। পাকিস্তানের প্রতি বৈরী ও পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অনেকে ধারণা করছিলেন আরেকটি পাক-
ভারত যুদ্ধ বোধহয় আসন্ন । অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকচক্র ভারতকে পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে পাকিস্তানের সীমানালগ্ন ভারতীয় এলাকাগুলো অরক্ষিত করার ফন্দি আঁটছিলো। সংকটপূর্ণ সেই পরিবেশের মধ্যে বিদেশী এই সাংবাদিক রক্তক্ষয়ী একাত্তরকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার দায়িত্বটি পালন করছিলেন।
সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেলের এই আলেখ্যটি রচনা করেছেন আহমদ মিনহাজ।
আহমদ মিনহাজ

বিজয় দিবসের গল্প
শামসুজ্জামান হীরা ব্যক্তিগতজীবনে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অস্ত্র হাতে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন-বাজী রেখে লড়াই করেছেন। আজীবন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে তাঁর গল্প মানেই হল প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
শামসুজ্জামান হীরার গল্প :

বিজয় দিবসের গল্প
মনিরা কায়েসের ধুলোমাটির জন্মসূত্র গল্পগ্রন্থের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, 'অনেকেই গল্প লেখেন; কিন্তু মনিরা কায়েস গল্প বোনেন।' তাঁর লেখা সম্পর্কে এর চেয়ে সঠিক এবং গ্রাফিক বর্ণনা আর কিছু হতে পারে না। একজন বয়নশিল্পীর মতোই নানা রঙের আর টেঙ্চারে তৈরি তাঁর কাহিনীর শরীর। এই নির্মাণে ভাষাই তার প্রধান উপকরণ, বিষয় নির্বাচনের পর যা ন্যারেটিভকে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রচণ্ড শক্তিতে এবং সাবলীলভাবে। বিষয়ের বাস্তবতা এবং পরিবেশের আনুষঙ্গিকতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে তাঁর ভাষপ্রকরণ, যার জন্য তাঁকে একজন ভাষাচিত্রীই বলতে হয়।
পড়ুন মুক্তিযুদ্ধের গল্প : অখিল চন্দ্রের হিসেব-নিকেশ

বিজয় দিবসের গল্প
স্বকৃত নোমানের গল্প : আবদুল আহাদের মুখ
স্বকৃত নোমানের প্রিয় বিষয় ইতিহাস। ইতিহাসের মধ্যে থেকে বের করেন আখ্যানের ঘন মুখ--সংগ্রামী বাঙালীর মুখ। মুখোশ লেখেন না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ তার গল্পে বহুরৈখিক হয়ে ধরা পড়ে। বহুরৈখিতকা আনতে গিয়ে নোমান কখনো বর্ণনা বোঝা চাপেন না। সরাসরি আখ্যান নির্মাণের বিরল ক্ষমতা রাখেন।
এই গল্পটি শুরু হয়েছে পাকিস্তানের করাচি শহরে। দুজন মানুষ--একজন বাঙালী আরেকজন পাকিস্তানী। দুজনেই কর্মসুত্রে পটুয়াখালি শহরে ছিলেন ১৯৭১ সালে। গল্পটি একাত্তর সালের। এবং একালের।




৩. রীতিবিরুদ্ধ গল্প পদ্ধতি


এমদাদ রহমানের আয়োজন
গল্পকার এমদান রহমান বাড়ি সিলেটে। থাকেন লন্ডনে পড়াশুনা ও পেশার সূত্রে। কিন্তু লেখালেখির জন্য থাকেন জগৎজুড়ে। তিনি অনুবাদ করেন। তার নিজের একটি মাধুর্যময় গুরুগম্ভীর ভাষা আছে।
এমদাদ রহমান গল্পপাঠের জন্য গল্প লেখেন। বিশ্ব-খ্যাত লেখকদের সাক্ষৎকার অনুবাদ করেন। এখন শুরু করেছেন লেখকদের নোটবুক অনুবাদ করা। আলবেয়ার কামু'র নোটবুকটি ধারাবাহিকভাবে চলবে।
১. আলবেয়ার কামু’র নোটবুক : পর্ব ২
২. কার্লোস ফুয়েন্তেসের সাক্ষাৎকার
৩. জর্জ অরওয়েলের গদ্য : জনৈক গ্রন্থ-সমালোচকের স্বীকারোক্তি
৪. ওয়াল্ট হুইটম্যানের দু’টি গদ্য
৫. আবদু গুবেইর এর গল্প: তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?
৬. ব্রেইতেন ব্রেইতেনবাখ এর গদ্য : পাঠক, সুরভিত পাঠক


বিজয় দিবসের গল্প
গল্পটি একটি হাতির। হাতি এসেছে ইয়েমেন দেশ থেকে--জাহাংগীর বাদশার আমলে। বরিশালের গৌরনদীর পীর দুধকুমারের বরকতে হাতিটি প্রাপ্ত হন পালরদি গ্রামের শ্রী লক্ষ্মণ দাস। তিনি গড়ে তোলেন দি লক্ষমণ দাস সার্কাস। সেটা সাত চল্লিশ সালের ঘটনা।
এই হাতিটি পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে আগৌলঝাড়ার এক বিলে নিহত হয় একাত্তর সনে। পুরান, কিংবদন্তী, ইতিহাস ও সমকালকে গাঁথা হয়েছে যাদু বাস্তবতার সূতোয়।
বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ করে ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, উপলব্ধি, তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা এসব গল্পের প্রধান অনুষঙ্গ। একথা ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত কোন গল্পেই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠেনি, ছোটগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে তা সম্ভবও নয় তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত সবগুলো গল্প পড়লে বাঙ্গালির এ বিশাল আত্মত্যাগ ও অর্জনের একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।
গল্পপাঠের এ সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত বিখ্যাত কয়েকজন লেখকের গল্প থাকলো যা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভ্যাসকে তুলে ধরবে না তবে যুদ্ধের ভয়াবহতার একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
এ সংখ্যার আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন মোমিনুল আজম, এমদাদ রহমান, অলাত এহসান, বনি আমিন, সাজেদা হক, উৎপল হালদার, বিথী মিস্ত্রী, জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা । প্রচ্ছদের ছবিটি তুলেছেন লেখক তারেক অণু।
গল্পপাঠের লেখাগুলো লিঙ্ক আকারে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো লেখার ওপরে ক্লিক করুন। তারপর পড়ুন। একটি মন্তব্য রাখুন। যদি ভালো লাগে--তাহলে কেনো ভালো লাগলো, যদি মন্দ লাগে তাহলে কেনো মন্দ লাগলো-- লিখুন। আমাদের ইচ্ছে গল্পপাঠের পাঠকও লেখক হয়ে উঠুক।
বিজয় দিবসের গল্প
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প--রেইনকোট

বিজয় দিবসের গল্প
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি অসাধারণ গল্প হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি মফস্বল শহরে প্রিয়জনের খোঁজে আসে লোকটি। গল্পে লোকটির কোন পরিচয় নেই। ভয়াল শহরে সে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। একসময় ধরা পড়ে মিলিটারির হাতে। তার উপর যে নির্যাতন হয় তাকে এককথায় বলা যায় থেতলানো মাংসের ভয়ানক পরিস্থিতি। অবশেষে লোকটি খুঁজে পায় তার প্রিয়জনকে। সে বর্ণনা আরও ভয়াবহ। মাটির নীচ থেকে সে বের করে আনে সে প্রিয়জনের বুকের পাজর, যা তলোয়ারের মতো বাঁকা। সে মাটি খুড়তে থাকে। আসলে সে পৃথিবীর ভিতরটা নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ বের করে আনতে চায়।

বিজয় দিবসের গল্প
হুমায়ুন আহমেদ এর একটি ছোটগল্প পাপ। গল্পটি গায়ে গতরেও ছোট অথচ কতো বিচিত্র লীলা এই ছোট্ট বয়ানটি নিজের শরীরে লুকিয়ে রেখেছে। ঘটনাটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ কী রূপে উপস্থিত হতে পারে, তার একটা পরিচ্ছন্ন ছবি আছে এ গল্পে।গল্পটির গল্প নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, মতভেদ থাকতে পারে সেটি ভিন্ন বিষয় কিন্তু গল্পের বয়ানটি তিনি যেভাবে গেয়েছেন তাতে তা প্রকৃত গল্প হয়ে উঠেছে। গল্পটি পড়ার পর চোখের সামনে ভাসতে থাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র।

খুব সাদামাটাভাবে শুরু হয়েছে টোপ গল্পটি। একজন দেশীয় রাজাবাহাদুর নেমন্তন্ন করেছেন এক ছাপোষা লেখককে। সেজন্য আয়োজন করা হয়েছে বাঘ শিকারের। উদ্দেশ্য লেখককে রাজাবাহাদুরের দুঃসাহসী কীর্তি দেখানো। শিকারটি যখন হল--বাঘটি লাফ দিয়ে পড়ে নিহত হল। পড়ে মনে হবে খুব নিরীহভাবে শেষ হয়ে গেল গল্পটি। কিন্তু এর মধ্যেই সতর্কপাঠক আবিষ্কার করবেন গল্পটি ঠিক বাঘ শিকারের নয়। মানুষ শিকারের। এই গল্পের পরতে পরতে বিস্ময়কর চমকের খেলা করেছেন গল্পকার।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : টোপ
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে আলাপ : টোপ
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা

গাছের পাতায় মর্মর ধ্বনি জাগে। গাছটি একটি বুড়ো শিবের থানে আছে। বল্লাল সেনের আমলে এই বুড়ো শিব আসলে ন্যাড়া বুদ্ধদেবের মূর্তি ছিল। বুদ্ধরা বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গেলে নিম্নবর্গের হিন্দুরা বুদ্ধদেবকে তাদের শিব ঠাকুর বানিয়ে পূজো করতে শুরু করে। এই বুদ্ধ বা শিব ঠাকুর নিয়ে গল্প লেখেননি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। গল্পটি গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি। কয়েকজন লোক নির্জনে একাকী গাছটির কাছে গেলে মরমর নয়--শোনে তাদেরকে বলছেন, তোরা মর। তোরা মর। ফলে শুনে লোকগুলো মারা যায়।
গাছের পাতার মর্মর ধ্বনিকে যে যাদু বাস্তব অসামান্য গল্পের পরিণত করা যায় সেটা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখে দেখিয়েছেন।

ভূষণ নামে এক লোক সদ্য বিয়ে করেছে। বিয়ে করেই আবিষ্কার এই রহস্যময় জগতের সন্ধান পেয়েছে। এই রহস্যের নেই। তবে আছে প্রবল আকর্ষণ। এর তুল্য সুখ জীবনে আর কিছু নেই। ভূষণের বউ ঝুমকোলতা বিয়ের তিনদিন পরে স্নান করতে কলতলায় গেছে। নবীন যুবক সাবেক স্বদেশী বিপ্লবী অকৃতদার ঝ্যাঠা মশাইয়ে ঘরে লুকিয়ে বউয়ের স্নান করা দেখবে। এটা দেখতে গিয়েই তার মনে জ্যাঠামশাইয়ের জীবনটা অসুখী এবং অর্থহীন। কিন্তু ঘটনাচক্রে যুবকটি আবিষ্কার করে জ্যাঠা মশাইয়ের জীবন অর্থপূর্ণ। । সাধারণ বিষয়কে আকর্ষণীয়ভাবে দার্শনিকতায় টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে শীর্ষেন্দুর।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প : ঝুমকোলতার স্নানের দৃশ্য ও লম্বোদরের ঘাটখরচ

পাড়ায় একজন মধ্যবয়স্ক লোক আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী আছে। স্বচ্ছলতা আছে। তাকে কখনো অসুখী দেখা যায়নি। তবু কেনো লোকটি আত্মহত্যা করলেন? এই প্রশ্নটির উত্তর নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এই গল্পে। এ গল্পটি নিয়ে মৃণাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এ ধারার আরেকটি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র রশোমন।
রমাপদ চৌধুরীর গল্প : পোস্ট-মর্টেম
রমাপদ চৌধুরীর গল্প ‘পোস্টমর্টেম’ নিয়ে আলোচনা
আলোচক : অলাত এহসান


বিজয় দিবসের গল্প
১৯৭১-এ পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করার সময় জেনারেল টিক্কা খান তাঁর সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,-‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’। আর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন,-‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি রক্ত দিয়ে লাল করে দেয়া হবে’। জেনারেলদের সংকল্পটি সফল হবার দিনগুলোয় সুদূর ইউরোপ মহাদেশের জনৈক সংবাদকর্মী চরকির মতো সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশীদের চলাচলের ওপর সরকারি নজরদারী ও বিধিনিষেধ থাকলেও সংবাদকর্মীর মনের জোর ছিল অজেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন পাঠাতেন। পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল ও সংঘাতমুখর হয়ে উঠছিল। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা বা গৃহযুদ্ধ দমনের নাম করে পাক সেনারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে সেখানে। পাকিস্তানের প্রতি বৈরী ও পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অনেকে ধারণা করছিলেন আরেকটি পাক-
ভারত যুদ্ধ বোধহয় আসন্ন । অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকচক্র ভারতকে পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে পাকিস্তানের সীমানালগ্ন ভারতীয় এলাকাগুলো অরক্ষিত করার ফন্দি আঁটছিলো। সংকটপূর্ণ সেই পরিবেশের মধ্যে বিদেশী এই সাংবাদিক রক্তক্ষয়ী একাত্তরকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার দায়িত্বটি পালন করছিলেন।
সংবাদকর্মী রিচার্ড গেরহার্ড কোনেলের এই আলেখ্যটি রচনা করেছেন আহমদ মিনহাজ।

বিজয় দিবসের গল্প
শামসুজ্জামান হীরা ব্যক্তিগতজীবনে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অস্ত্র হাতে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন-বাজী রেখে লড়াই করেছেন। আজীবন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে তাঁর গল্প মানেই হল প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হওয়া।
শামসুজ্জামান হীরার গল্প :

বিজয় দিবসের গল্প
মনিরা কায়েসের ধুলোমাটির জন্মসূত্র গল্পগ্রন্থের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, 'অনেকেই গল্প লেখেন; কিন্তু মনিরা কায়েস গল্প বোনেন।' তাঁর লেখা সম্পর্কে এর চেয়ে সঠিক এবং গ্রাফিক বর্ণনা আর কিছু হতে পারে না। একজন বয়নশিল্পীর মতোই নানা রঙের আর টেঙ্চারে তৈরি তাঁর কাহিনীর শরীর। এই নির্মাণে ভাষাই তার প্রধান উপকরণ, বিষয় নির্বাচনের পর যা ন্যারেটিভকে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রচণ্ড শক্তিতে এবং সাবলীলভাবে। বিষয়ের বাস্তবতা এবং পরিবেশের আনুষঙ্গিকতাকে প্রাণবন্ত করে তোলে তাঁর ভাষপ্রকরণ, যার জন্য তাঁকে একজন ভাষাচিত্রীই বলতে হয়।
পড়ুন মুক্তিযুদ্ধের গল্প : অখিল চন্দ্রের হিসেব-নিকেশ

স্বকৃত নোমানের গল্প : আবদুল আহাদের মুখ
স্বকৃত নোমানের প্রিয় বিষয় ইতিহাস। ইতিহাসের মধ্যে থেকে বের করেন আখ্যানের ঘন মুখ--সংগ্রামী বাঙালীর মুখ। মুখোশ লেখেন না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ তার গল্পে বহুরৈখিক হয়ে ধরা পড়ে। বহুরৈখিতকা আনতে গিয়ে নোমান কখনো বর্ণনা বোঝা চাপেন না। সরাসরি আখ্যান নির্মাণের বিরল ক্ষমতা রাখেন।
এই গল্পটি শুরু হয়েছে পাকিস্তানের করাচি শহরে। দুজন মানুষ--একজন বাঙালী আরেকজন পাকিস্তানী। দুজনেই কর্মসুত্রে পটুয়াখালি শহরে ছিলেন ১৯৭১ সালে। গল্পটি একাত্তর সালের। এবং একালের।

বিজয় দিবসের গল্প

গল্প
সুমন সুপান্থ'র গল্প : ধ্বংসকালীন বোবা গল্প
পিয়াস মজিদের গল্প : মনে করি এই গল্পটি গার্সিয়া মার্কেজের
মিলটন রহমানের গল্প : উজান


একই সঙ্গে দুটি লেখা পড়ুন
অলাত এহ্সানের গল্প ও গল্প লেখার গল্প :
কান্নার শব্দ শোনা যায়, যায় না

অনুবাদ গল্প
মূলঃ ওয়ান জি অনুবাদঃ ফজল হাসান
মূল : খোয়াকিম মারিয়া মাচাদো দি আসিস
অনুবাদ : রওশন জামিল

সাজেদা হকের গল্পের টিপস

স্মৃতিচারণ
মিহির সেনগুপ্ত

এমদাদ রহমানের আয়োজন
গল্পকার এমদান রহমান বাড়ি সিলেটে। থাকেন লন্ডনে পড়াশুনা ও পেশার সূত্রে। কিন্তু লেখালেখির জন্য থাকেন জগৎজুড়ে। তিনি অনুবাদ করেন। তার নিজের একটি মাধুর্যময় গুরুগম্ভীর ভাষা আছে।
এমদাদ রহমান গল্পপাঠের জন্য গল্প লেখেন। বিশ্ব-খ্যাত লেখকদের সাক্ষৎকার অনুবাদ করেন। এখন শুরু করেছেন লেখকদের নোটবুক অনুবাদ করা। আলবেয়ার কামু'র নোটবুকটি ধারাবাহিকভাবে চলবে।
১. আলবেয়ার কামু’র নোটবুক : পর্ব ২
২. কার্লোস ফুয়েন্তেসের সাক্ষাৎকার
৩. জর্জ অরওয়েলের গদ্য : জনৈক গ্রন্থ-সমালোচকের স্বীকারোক্তি
৪. ওয়াল্ট হুইটম্যানের দু’টি গদ্য
৫. আবদু গুবেইর এর গল্প: তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশনটাকে দেখেছ?
৬. ব্রেইতেন ব্রেইতেনবাখ এর গদ্য : পাঠক, সুরভিত পাঠক

ধারাবাহিক উপন্যাস
আহমেদ খান হীরক

বিজয় দিবসের গল্প
গল্পটি একটি হাতির। হাতি এসেছে ইয়েমেন দেশ থেকে--জাহাংগীর বাদশার আমলে। বরিশালের গৌরনদীর পীর দুধকুমারের বরকতে হাতিটি প্রাপ্ত হন পালরদি গ্রামের শ্রী লক্ষ্মণ দাস। তিনি গড়ে তোলেন দি লক্ষমণ দাস সার্কাস। সেটা সাত চল্লিশ সালের ঘটনা।
এই হাতিটি পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে আগৌলঝাড়ার এক বিলে নিহত হয় একাত্তর সনে। পুরান, কিংবদন্তী, ইতিহাস ও সমকালকে গাঁথা হয়েছে যাদু বাস্তবতার সূতোয়।
0 মন্তব্যসমূহ