গল্পপাঠ।। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য।। ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।। মে-জুন।। ২০২২ খ্রিস্টাব্দ।। সংখ্যা ৮২

সম্পাদকীয়
বিজ্ঞান ভাবনা -

কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় চিন্তাবিদ অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের সহৃদয় আমন্ত্রণে তাঁর অকালপ্রয়াতা ভাগ্নীর স্মৃতির উদ্দেশ্য নিবেদিত ‘অয়িঋদ্ধি স্পর্শমণি ফাউন্ডেশনের’ “মানবিকী বিদ্যাচর্চায় বিজ্ঞান ভাবনার গুরুত্ব” শিরোনামের বার্ষিক বক্তৃতায় বলেছিলাম, আমরা সবাই পৃথিবী নামের এক মহাকাশযানের নাবিক। এই মহাকাশযান দেশকালে বা spacetimeএ ঊর্ধ্বশ্বাসে চলেছে মহাবিশ্বের কোনো এক অজানা প্রান্তের উদ্দেশ্যে। এই জাহাজের সোয়ারীরা একে অপরকে চেনে না, বা চিনতে চায় না, কিন্তু মহাকাশযাত্রার এই যে জ্ঞান সেটা তাদের মধ্যে সঞ্চার করতে পারত এমন একটি একাত্মবোধ যা কিনা জাতি, রিলিজিয়ন, বর্ণের ওপরে উঠে মানবসমাজকে তার যৌথ ভবিষ্যতকে এই অসীম মহাশূন্যমাঝে দেখতে সাহায্য করবে।

মাঝে মধ্যে আমরা এই জাহাজের ক্ষুদ্র কেবিন থেকে বের হয়ে ছোট ছোট হলঘরে মিলিত হই। ‘গল্পপাঠ’ এরকম একটি হলঘর হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই চারিদিকের বদ্ধ দেয়াল সেই হলঘরকে করে দেয় অচলায়ন। বিশাল হলঘরও আমাদের কেবিনগুলোর মত ক্ষুদ্র হয়ে যায়, বাইরের সমুদ্র দেখতে দেয় না। আমরা হয়ে যাই ট্রাইবাল। এইসব কথা অনেকের কাছে নিতান্তই cliché মনে হতে পারে, কারণ আমরা সবাই এখন অসূয়ক, সব ব্যাপারে সন্দিহান, তাই এরকম উপমাকে বালখিল্য বলে অগ্রাহ্য করে যে সাহিত্য রচনা হবে তাকেই আমরা এখন গুরুত্বপূর্ণ বলি।

সমাজে ও প্রকৃতিতে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। একজন বিজ্ঞান-শিক্ষক হিসেবে বিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে মানবিক বিদ্যাচর্চার প্রতি উদাসীনতা দেখে আমি শঙ্কিত হই, কারণ মানবিক শিক্ষা মনকে উন্মুক্ত করে, এমনকী বৈজ্ঞানিক বা কারিগিরী প্রকৌশল যুক্তি গ্রহণে এবং বৃহত্তর সামাজিক কর্মকাণ্ডে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সাহায্য করে। এই আমার বিশ্বাস। সেখানে সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম।

কিন্তু এই ধরণের সমতা মানবিক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজন চিন্তাশীল নাগরিকের জন্য শুধুমাত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে বিজ্ঞান শিক্ষার দরকার তা নয়, বরং সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্বের গুরুত্ব ও গভীরতা বুঝতে সেই শিক্ষার দরকার আছে। প্রথমটি হল পৃথিবী নামের মহাকাশযানের ভেতরে কী ঘটছে আর দ্বিতীয়টি হল বাইরের বিশাল মহাকাশ সমুদ্রে সেই যানটির আপাত অবস্থান। তবু প্রশ্ন থেকে যায় একজন সাহিত্যিকের জন্য এটি প্রয়োজনীয় কিনা। একজন সাহিত্যিকের বিজ্ঞানচিন্তা থাকা উচিত কিনা, কিংবা তার থেকেও বড় কথা তার বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া উচিত কিনা।

১৯৫৯ সনে প্রভাবশালী অস্ট্রিয়ান দার্শনিক কার্ল পপারের ইংরেজী বই The Logic of Scientific Discovery প্রকাশ পায়। সেখানে পপার বললেন, বিজ্ঞানের দর্শনে ভ্রান্তিকরণের (falsifiability) ধারণা থাকতে হবে, অর্থাৎ একটি অনুকল্পকে (hypothesis) তখনই বৈজ্ঞানিক বলা যাবে যদি সেটিকে মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো সুযোগ থাকে। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল “সব রাজহাঁস সাদা” – এই বাক্যাটি। এটি একটি বৈজ্ঞানিক অনুকল্প কারণ রাজহাঁসকে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন কিছু নয়, এবং সেই পর্যবেক্ষণে একটি রাজহাঁসকেও যদি কালো বা অন্য রঙের দেখতে পাওয়া যায় তাহলে অনুকল্পটি মিথ্যা বা ভ্রান্ত প্রমাণ হবে এবং “সব রাজহাঁস সাদা” বাক্যটি একটি তত্ত্বে পরিণত হবে না। বিজ্ঞানে তত্ত্ব হল এমন একটা জিনিস যা সমস্ত পর্যবেক্ষণ উত্তীর্ণ হয়েছে, যেমন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব।

অন্যদিকে আমরা যদি বলি “এই ঘরটি এমন বিশেষ অদৃশ্য কণা দিয়ে ভর্তি যা কিনা কোনো পর্যবেক্ষণ দ্বারাই দৃশ্যমান হবে না” সেটি কোনো বৈজ্ঞানিক অনুকল্প হবে না, কারণ এই প্রস্তাবটি প্রথমেই বলে দিয়েছে যে, কোনো উপায়েই সেই কণা দেখা যাবে না, অর্থাৎ এই প্রস্তাবটিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো পদ্ধতি নেই। এর মানে এই নয় যে, ওই ঘরে ‘বিশেষ অদৃশ্য কণা’ নেই, অদৃশ্য কণা থাকতেই পারে, কিন্তু ভ্রান্তিকরণের কোনো সুযোগ না দেবার জন্য অনুকল্পটি বিজ্ঞানের আওতায় পড়বে না।

এই ধারনার ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির যে প্রক্রিয়াগুলি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা একমত হলেন তা হল (১) একটি অনুকল্পের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ভাবীকথন (prediction) করবেন, (২) তারপর হয়ত একটি এক্সপেরিমেন্ট প্রস্তুত করবেন যার ফলাফল সেই ভাবীকথনকে সত্য বা মিথ্যা (অথবা এদের কোনো মিশ্রিত রূপ) প্রমাণ করবে এবং (৩) সেই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অনুকল্পটির পরিমার্জন করে আবার নতুন এক্সপেরিমেন্ট করা হবে। যেখানে এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব নয় (যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, ভূবিদ্যা ইত্যাদি) সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অনুকল্পটিকে প্রতিষ্ঠা বা পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা রাখতে হবে। অবশেষে সমস্ত ভাবীকথন উত্তীর্ণ হলে অনুকল্পটি একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে theoryতে পরিণত হবে। বিজ্ঞানের বাইরে theory কথাটা মনে করা হয় অপ্রমাণিত একটি জিনিস, কিন্তু বিজ্ঞানে theory হল একটি প্রমাণিত নীতি।

ইদানিংকালে অবশ্য কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ‘ভ্রান্তিকরণ’ ধারণাটিকে উন্নত তত্ত্বের গবেষণাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে দাবি করছেন। যেমন আমাদের মহাবিশ্বর বাইরে অন্য মহাবিশ্ব আছে – যাকে বহুমহাবিশ্ব (multiverse) অনুকল্প বলা হয় – এই নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী কাজ করছেন, কিন্তু এই ধারণাটিকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার কোনো হাতিয়ার তাঁরা দিতে পারছেন না। তো ভ্রান্তিকরণ নীতি দিতে পারছেন না বলে তারা সমালোচনার মুখে পড়ছেন, তখন তাঁরা বলছেন ‘ভ্রান্তিকরণ’ নীতিটির পরিবর্তন দরকার। সমস্যা হল সেই অনুকল্পের সত্যতা যৌক্তিক অনুমানের ভিত্তিতে নির্ধারিত করতে হয়, ‘ভ্রান্তিকরণ’ নীতি সেখানে কাজ করে না। কিন্তু যেহেতু এই ধরণের প্রস্তাব বৃহত্তর বিজ্ঞানী মহলে এখনো গৃহীত হয়নি, তাই আমরা অনুকল্প, ভাবীকথন, এক্সপেরিমেন্ট বা পর্যবেক্ষণ, উপসংহার, নতুন অনুকল্প, পরিবর্তিত এক্সপেরিমেন্ট বা পর্যবেক্ষণ, নতুন উপসংহার – এই ধরণের ক্রমটিকেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে গ্রহণ করছি। আমার মনে হয় সাহিত্যচর্চারত মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক হতে এই পদ্ধতিটি জানা প্রয়োজন।

বিজ্ঞান আমাদেরকে নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখায়। প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ তার মধ্যে প্যাটার্ন আবিষ্কার করা; সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষন করে অনুকল্প প্রণয়ন করা এবং সেই অনুকল্পের সঙ্গে ফলাফলের তুলনা, প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া বিজ্ঞানের এই যে প্রক্রিয়া সেটি অর্জন করা এক ধরণের স্কিল – সেটি মানবিকী কি কারিগরী উভয় ছাত্রর জন্যই সত্য। সাহিত্যিকদের জন্যও।

ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস ব্যাকন (১৫৬১ – ১৬২৬) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এই ক্রমটিকে লিপিবদ্ধ করেন। ব্যাকনকে অভিজ্ঞতাবাদের (empiricism) স্রষ্টাও বলা হয়। পরীক্ষা, সরাসরি পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানার্জন অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে পড়ে। ব্যাকনের সমসাময়িক ইতালীয় গ্যালিলেও গ্যালিলেইকে (১৫৬৪ – ১৬৪২) আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদের প্রথম বিজ্ঞানী বলা হয়। গ্যালিলিওর কথা বাংলায় (বা ভারতে) পৌঁছাতে দু শ বছর মত লেগেছিল, ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা বিদ্যাসাগর (১৮২০ – ১৮৯১) ইংরেজী বইসমূহের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লিখলেন (১৮৪৯ সনে) কয়েকজনের জীবনী, তাদের মধ্যে ছিলেন কোপের্নকাস, গ্যালিলেও, নিউটন ও হার্শেল (ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কর্তা) প্রমুখ। গ্যালিলিও প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন -

“অজ্ঞ লোকেরা বোধ করিয়া থাকে, বস্তুর গুরুত্ব অর্থাৎ ভার আছে বলিয়া উহা ভূতলে পতিত হয়। আর যাহার গুরুত্ব যত অধিক তাহা তত শীঘ্র পতিত হয়। পূর্ব কালে অরিস্টোটল প্রভৃতি অতি প্রধান ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা এই মত প্রতিপন্ন করিয়া গিয়াছিলেন, এবং আমাদের দেশের নৈয়ায়িকদেরও এই মত। কিন্তু ইহা ভ্রান্তিমূলক, প্রকৃতির নিয়মানুগ নহে। … পরীক্ষা দ্বারা স্থিরীকৃত হইয়াছে, নির্বাত স্থানে গুরু ও লঘু বস্তু, যুগপৎ পরিত্যক্ত হইলে, যুগপৎ ভূতলে পতিত হয়।”

দুঃখের বিষয় অন্যান্য অনেক ভ্রান্ত ধারনার মত, যেমন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, কিংবা পৃথিবী মোটামুটিভাবে সমতল, ভারি বস্তু হাল্কা বস্তুর চাইতে দ্রুত মাটিতে পড়ে এই ধারনাটি হাজার হাজার বছর ধরে যেমন বিরাজ করেছে, এমনকী আধুনিক যুগেও সমস্ত ধরনের শিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই ভুলগুলি আমাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করে। এটা ভাগ্যের পরিহাসই বলতে হবে যে, বর্তমানে বিশ্বায়নের উন্নত প্রকৌশলের সময়, এই ভ্রান্ত ধারণার প্রচার আন্তর্জালের মাধ্যমে আরো বেশি প্রচার পাচ্ছে।

গ্যালিলেওর আকাশ পর্যবেক্ষণ নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন –

“গ্যালিলেয় [ঈশ্বরচন্দ্রর বানান], এই দৃষ্টিপোষক নলাকার নূতন যন্ত্র নভোমণ্ডলে প্রয়োগ করিয়া, দেখিতে পাইলেন, চন্দ্রমণ্ডলের উপরিভাগ অত্যন্ত বন্ধুর; সূর্যমণ্ডল সময় সময়ে কলঙ্কিত লক্ষ্য হয়; ছায়াপথ সূক্ষ্মতারকাস্তবকমাত্র; বৃহস্পতি পারিপার্শ্বিকচতুষ্টয়ে পরিবেষ্টিত; শুক্রগ্রহের চন্দ্রের ন্যায়, হ্রাস বৃদ্ধি আছে; শনৈশ্চরের উভয় পার্শ্বে পক্ষাকার কোনো পদার্থ আছে। ওই পক্ষ এক্ষণে অঙ্গুরীয় বলিয়া সিদ্ধান্তিত হইয়াছে।”

একটি বাক্যে জ্যোতির্বিদ্যায় গ্যালিলেওর সমস্ত আবিষ্কারের কথাই উল্লেখ করা হল। কোপেরনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মহাজগতের কথা প্রচার করে গ্যালিলেও চার্চের রোষানলে পড়লেন, ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষায় “যাজকেরা তাঁহার নামে ধর্মবিপ্লাবক বলিয়া উপস্থিত করাতে, ১৬১৫ খৃঃ অব্দে, তাঁহাকে রোমনগরীর ধর্মসভার সম্মুখে উপস্থিত হইতে হইল।” গ্যালিলেওর এই ভাগ্যকে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের সঙ্গে তুলনা করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর বিধবা বিবাহ প্রচলন ও বহু বিবাহ রোধের প্রস্তাবনা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কাছ থেকে যে প্রতিরোধ পেয়েছিল সেটিকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমে ইউরোপে ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ১৬৩৩ সনে গ্যালিলিওকে যখন আবার রোমে ডাকা হল তাঁর বিজ্ঞান ধারণাকে পরিত্যাগ করার জন্য, যাজক বিচারকরা গ্যালিলিওকে বললেন (ঈশ্বরচন্দ্রের ভাষায়) –

“তোমাকে আমাদের সম্মুখে আঁঠু পাড়িয়া ও বায়বল [বাইবেল] স্পর্শ করিয়া কহিতে হইবেক, আমি পৃথিবীর গতি প্রকৃতি যাহা যাহা প্রতিপন্ন করিয়াছি সে সমুদায় অস্বর্গ্য, অশ্রদ্ধেয়, ধর্মবিদ্বিষ্ট ও ভ্রান্তিমূলক। গ্যালিলেয়, সেই বিষম সময়ে মনের দৃঢ়তা রক্ষা করিতে না পারিয়া, যথোক্ত প্রকারে পূর্বনির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করিলেন। কিন্তু গাত্রোত্থান করিবামাত্র, আন্তরিক দৃঢ় প্রত্যয়ের বিপরীত কর্ম করিলাম, এই ভাবিয়া মনোমধ্যে ঘৃণারোষসহকৃত যৎপরনাস্তি অনুতাপ উপস্থিত হওয়াতে, তিনি পৃথিবীকে পদাঘাত করিয়া উচ্চৈস্বরে কহিলেন, ইহা এখনো চলিতেছে।”

‘ইহা এখনো চলিতেছে’ (ইংরেজীতে And yet it moves, ইতালীয় ভাষায় এপ্পুর সি মুয়েভে) মানুষের শত প্রতিরোধের মুখে সত্য প্রকাশের এক বলিষ্ঠ বাণী। বিপদের সম্মুখীণ হয়েও গ্যালিলেও বলতে চাইলেন, তোমরা যাই বল, পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে এবং সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সে স্থির নয়, এই হল সত্য। এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু আমরা জানি এই বিচারের পরে গ্যালিলওকে বৃদ্ধ বয়সে আবার নির্বাসন ভোগ করতে হল। এটা ভাবা বোধহয় অযৌক্তিক হবে না যে, বিদ্যাসাগর গ্যালিলিওর সঙ্গে সহমর্মিতা বোধ করতেন। যদিও তাঁদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন ছিল, কিন্তু আমি বলব তৎকালীন সমাজের জড়বুদ্ধির আঁধার কাটাতে তাদের সেই কর্মের চরিত্র একই ছিল। গ্যালিলেও যে ব্যাকনীয় পন্থায় (অভিজ্ঞতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে) সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মপদ্ধতিকে অনেকটা সেই আলোকে দেখা যেতে পারে। এটি আমার একটি অনুকল্প, কিন্তু বিদ্যাসাগরে মানবিক কর্মকাণ্ডে গ্যালিলিয়র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রভাব রেখেছিল সেটি মনে করা অযৌক্তিক হবে না। প্রশ্ন হল এই ঘটনাটি ঈশ্বরচন্দ্রকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল সেভাবে সমকালীন সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করতে পারে কিনা।

ইদানীংকালের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের কাহিনি “এপ্পুর সি মুয়েভের” মতই একটি কিংবদন্তি। আমার কাছে এটি একটি ‘গ্যালিলেয় মুহূর্ত।’ এখানে ইনকুইজিশনের দায়িত্ব চার্চের মতই পালন করছে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রদ্বারা উৎসাহিত এক বিরাট গোষ্ঠী। আমি বলব এই ছাত্র বা তার প্ররোচনাকারীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সামান্যতম ধারনা যদি থাকত তবে, আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস যে প্রক্রিয়ার প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে সূক্ষ্ম ও গভীর চিন্তার বিকাশ খুঁজছিলেন, সেই প্রক্রিয়ার কিছুটা অংশ তারা এই কথোপকথনে আবিষ্কার করতে পারতো এবং সেই আবিষ্কারে হয়তো বিস্মিত হতো, আলোকিত হতো। অনেক সাহিত্যকর্মী ঘটনাটিকে এড়িয়ে গেছেন, আমি বলব সেই এড়ানোর প্রক্রিয়ায় তাঁরা নিজেদেরকে একটি মহাআখ্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সুযোগ হারিয়েছেন।

আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক নাট্যকার এস্কালেস (Aeschylus) লিখে গিয়েছিলেন ‘Prometheus Bound’ যেখানে প্রমেথিয়াস মানবজাতিকে আগুন উপহার দিয়ে দেবতারাজা জিউসের রোষের শিকার হয়েছিলেন। মানুষের কর্ম যে নিয়ত প্রকৃতি, দেবতা বা ভাগ্যের প্রতিকূলতা অতিক্রম করার এক নিরলস প্রয়াস সেরকম চিত্র এরপরে বহু রচনায় উঠে এসেছে। মধ্যযুগের পর থেকে বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে মানুষ কী ধরণের বিপদের সম্মুখীণ হতে পারে তা বলা হয়েছে ক্রিস্টোফার মারলোর ‘ডক্টর ফাউস্টাস’ বা মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেন্স্টাইন’ উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তেও যন্ত্রসভ্যতার বন্ধনে মানুষের অসহয়তা প্রকাশিত। এগুলির কোনোটিকেই কিন্তু প্রথমে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বলে আখ্যায়িত করা হয়নি, বরং মানব সমাজের নৈতিক ও কারিগরী বিচারবুদ্ধির পথনির্দেশক হিসেবে সেগুলো আখ্যায়িত হয়েছে। এই কাতারে পড়বে বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ যাকে কিনা নিতান্ত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আখ্যান দিয়ে এটির প্রগতিশীল নারীবাদী চেতনার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

যে রচনাগুলোর উল্লেখ করলাম সেগুলোকে মহাআখ্যান (grand narrative) বলা যেতে পারে। পশ্চিমে একসময়ে গ্রীক নিয়তিবাদ, খ্রিস্টীয় পাপমোচন, বুর্জোয়া প্রগতিবাদ ও মার্ক্সীয় ইউটোপিয়ার মধ্যে এই মহাআখ্যানগুলি নিবন্ধিত করা হত, কিন্তু উত্তর-আধুনিক যুগে সেই শ্রেণীকরণের অবলুপ্তি হয়েছে। প্রশ্ন হল আমরা কি কোনো স্থানীয় মহাআখ্যান তৈরি করতে পেরেছি?
বর্তমানের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, কিংবা বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি, অথবা সামাজিক মাধ্যমের যথার্থ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক শিক্ষা যে প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। চরম আদর্শিক মতবাদের পরিবেশে, বিশেষত ধর্মীয়অন্ধত্ব প্রসূত রাজনৈতিক ও সামাজিক দেশ-কালে বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিকের প্রয়োজন যে কতটা তা আমরা জানি, মহাআখ্যান সৃষ্টিতেও সেটি বাঞ্ছনীয়।
 
গল্পপাঠের এবারের সংখ্যাটি ৮২তম সংখ্যা। এ সংখ্যায় যথারীতি নিয়মিত বিভাগগুলোর পাশাপাশি দুটি চমৎকার সংযোজন রয়েছে। সদ্য বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতাঞ্জলি শ্রী'কে নিয়ে একটি, এবং অন্যটি ও'হেনরি পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদ গল্পের আয়োজন। প্রিয় পাঠক, গল্পপাঠ পড়ুন এবং এবারের আয়োজন নিয়ে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত দিন।
 
--দীপেন ভট্টাচার্য

প্রয়াত শামীম মনোয়ারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

এ বছরের ৪ এপ্রিল গল্পকার ও অনুবাদক শামীম মনোয়ার প্রয়াত হয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। ঢাকাতে চাকরিও করেছেন কর্পোরেট সংস্থায়। কিন্তু এক সময় ফিরে গেছেন সিরাজগঞ্জে। সেখানে থিতু হয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। লিখেছেন গল্প। নিয়মিত করেছেন অনুবাদ।গল্পপাঠের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কয়েকটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ও অনুবাদ করেছিলেন।তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। তাঁর এই আকস্মিক প্রয়াণে গল্পপাঠ টিম শোকাহত। তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
শামীম মনোয়ারের কয়েকটি অনুবাদের লিঙ্ক--

বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০২২

স্মৃতি ভদ্র
--
 আউটলুক ইন্ডিয়া. কম'কে দেওয়া গীতাঞ্জলি শ্রী'র সাক্ষাৎকার--
অনুবাদক : বিপ্লব বিশ্বাস
--
অনুবাদক : ঋতো আহমেদ

ও হেনরি পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প

১৯১৯ সালে শুরু হওয়া ছোট গল্পের জন্য ও’ হেনরী পুরস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছোটগল্পের শিল্পসত্তাকে শক্তিশালী করা। প্রতিবছর আমেরিকা ও কানাডার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছোটগল্প থেকে বিশটি গল্প বাছাই করা হয় এই পুরস্কারের জন্য। ব্যাতিক্রমধর্মী যোগ্যতার ছোটগল্প মূলত নির্বাচিত হয় ও’ হেনরী পুরস্কারের জন্য।পৃথিবীর নানাভাষায় নানামাত্রায় লেখা ছোটগল্পের আদৃত হয় ও’ হেনরী পুরস্কারের মাধ্যমে। এ বছরে বাংলাভাষার কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের গাঁওবুড়ো গল্পটি ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছে। গল্পটি তিনি ৪৫ বছর আগে লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় লেখা কোনো গল্পকার হিসেবে অমর মিত্রই প্রথম এই ও হেনরি পুরস্কারটি পেয়েছেন। এ পর্যন্ত ছয় বছরে পাওয়া ছয়টি ও হেনরি পুরস্কার পাওয়া গল্পের অনুবাদ প্রকাশিত হলো। 
অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত
অনুবাদক : রঞ্জনা ব্যানার্জী

অনুবাদক : বিপ্লব বিশ্বাস

অনুবাদক : এলহাম হোসেন

অনুবাদক : অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
অমর মিত্র'র সাক্ষাৎকার ইউটিউব

পুরুষোত্তম সিংহ

জয়া চৌধুরী'র অনুবাদে মূল স্প্যানিশ থেকে ৪ টি গল্পের বঙ্গানুবাদ: 

যুক্তরাষ্ট্রের গল্প
অনুবাদক : মাজহার জীবন

চিলির গল্প
অনুবাদক : রঞ্জনা ব্যানার্জী

অনুবাদক : প্রতিভা সরকার


আফ্রিকান সাহিত্য নিয়ে আলোচনা--
এলহাম হোসেন



 

সাদিয়া সুলতানার পাঠপ্রতিক্রিয়া : 




বই নিয়ে আলাপ
২০২০ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ডগলাস স্টুয়ার্টের উপন্যাস শ্যাগি বেন :
এতিম কিশোর অথবা মদ্যপ মায়ের স্মৃতির আখ্যান
--কুলদা রায়



আলী নূর'এর ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : 

শাহাব আহমেদের 
ধারাবাহিক উপন্যাস : 


মার্গারেট মিচেলের ধারাবাহিক উপন্যাস :  
পর্ব ২৮
ভাষান্তর : উৎপল দাশগপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ